এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : দেশের ইতিহাসে ব্যতিক্রমী এক নির্বাচন। ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে ভোট হচ্ছে প্রথমবারের মতো। যে ভোটে অংশ নিচ্ছে প্রধান বিরোধী জোটসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল। নির্বাচনের আর তিন দিন বাকি। চলছে শেষ মুহূর্তের প্রচার- প্রচারণা। তবে অনেকটা একতরফা। বিরোধী প্রার্থীরা হয় মাঠে নেই আর না হয় চাপে কোণঠাসা। কেউ কেউ বাসা থেকেই বের হতে পারছেন না।
বের হলে হামলার শিকার হচ্ছেন। সর্বশেষ সোমবার একদিনেই বিরোধী জোটের পাঁচজন প্রার্থী হামলায় রক্তাক্ত হয়েছেন। হামলা হয়েছে কর্মী- সমর্থকদের ওপরও। গতকাল হামলায় রক্তাক্ত হয়েছেন ঢাকা-৩ আসনের বিএনপির প্রার্থী ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
খোদ রাজধানীতেই নানামুখী চাপে দাঁড়াতে পারছেন না বিরোধী প্রার্থীরা। মামলা-হামলায় কাবু বিরোধী শিবিরে আলোচনা ছিল ভোটের মাঠে সেনা মোতায়েনের পর পরিস্থিতি পাল্টাবে। তবে গতকাল তারা দাবি করেছে গত দুইদিনে দৃশ্যপট বদলায়নি। এ অবস্থার প্রতিকার চেয়ে গতকাল নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ নিয়ে গিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। ব্যাপক হামলা-বাধার কারণে গতকাল মঙ্গলবার অনেকস্থানেই প্রচারে নামেননি বিরোধী জোটের প্রার্থীরা। দুপুরে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নেতাদের বৈঠক মাঝপথে থেমে যায় দুই পক্ষের তর্ক-বিতর্কের মধ্যে।
ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের অভিযোগ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার তাদের অভিযোগের বিষয়ে গুরুত্ব না নিয়ে অশোভন আচরণ করেছেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওই সভা বয়কট করেন তারা। ইসির বৈঠকে ফল না পাওয়ায় সন্ধ্যায় করণীয় নির্ধারণে বৈঠক করেন ঐক্যফ্রন্ট, বিএনপি ও ২০ দলের নেতারা। যদিও ইসির সঙ্গে বৈঠকের পরই নেতারা জানান, পরিস্থিতি যাই হোক তারা ভোটের মাঠ ছেড়ে দেবেন না।
নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের কয়েক দিন আগে উৎসবমুখর থাকে গোটা দেশ। প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা, ব্যানার ও পোস্টারে উৎসবের রূপ পায় অলিগলি, পাড়া- মহল্লা। এবারের দৃশ্যপট অনেকটা ভিন্ন। একপক্ষীয় প্রচার-প্রচারণা চলছে তফসিল ঘোষণার পর থেকেই। ব্যানার- পোস্টারেও আধিপত্য এক পক্ষের। গ্রেপ্তার, হামলা ও হয়রানির ভয়ে শুরু থেকেই বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা মাঠে অনুপস্থিত। ধারণা ছিল শেষ মুহূর্তে তারা মাঠে নামবেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তেও পরিস্থিতি পাল্টায়নি। মামলা-হামলায় কোণঠাসা প্রার্থীদের অভিযোগ ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি পুলিশ ও প্রশাসনের চাপে তারা প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারছেন না। প্রচারে বাধা দেয়া হচ্ছে।
যারা প্রচারে বের হচ্ছেন তাদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনী উৎসবের পরিবর্তে এখন নানামুখী উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। বিরোধী পক্ষ নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করছে এমন অভিযোগ করা হচ্ছে খোদ ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে। বিরোধী পক্ষ বলছে, সরকার ও নির্বাচন কমিশন যৌথভাবে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে। সব মিলিয়ে অনেকটা ভয়ের পরিবেশ বিরাজ করছে ভোটের মাঠে। সাধারণ ভোটাররা নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন এমনটা এখন আর কেউ জোর দিয়ে বলতে পারছেন না। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোটের আগে প্রচার-প্রচারণায় এমন বাধা ও হামলার ঘটনা নজিরবিহীন। এর আগে অংশগ্রহণমূলক কোনো জাতীয় নির্বাচনে এমনটি দেখা যায়নি।
এদিকে নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার দায়িত্বে থাকা নির্বাচন কমিশনের ওপর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অনাস্থা জানিয়ে আসছে তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি ও সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির প্রতি কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বানও ছিল দলগুলোর। কিন্তু কার্যত তেমন কোনো ভূমিকাই দৃশ্যমান করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। বরং একের পর এক নতজানু সিদ্ধান্ত ও নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণে অনাস্থা অবিশ্বাসে ঘুরপাক খাচ্ছে ইসি।
ভোটগ্রহণের সংবাদ সংগ্রহে আগ্রহী সংবাদকর্মীদের জন্য নীতিমালায় এবারই প্রথম সাংবাদিকদের চলাফেলায় কড়াকড়ি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। এবারের নির্বাচনে ভোটের দিন প্রিজাইডিং অফিসারের অনুমতি ছাড়া সাংবাদিকরা ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবেন না। একাধিক সাংবাদিক একই ভোটকেন্দ্রের একই ভোটকক্ষে একসঙ্গে প্রবেশ করতে পারবেন না। এমনকি ভোটকক্ষ থেকে সরাসরি সমপ্রচার বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সরাসরি প্রচার করা যাবে না। কেন্দ্রের ছবি তুলতেও প্রিজাইডিং অফিসারের অনুমতি লাগবে। যাতায়াতের ক্ষেত্রেও সাংবাদিকরা মোটরবাইক ব্যবহার করতে পারবেন না। ওই নীতিমালায় সাংবাদিকদের এক ডজনের বেশি দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যা অমান্য করলে বা ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্ট সংবাদ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আইন, বিধি ও কোড অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে। সাংবাদিকদের মোটরসাইকেলের স্টিকার না দেয়ার সিদ্ধান্ত এবারই প্রথম।
এ ছাড়া নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেছে কমিশন। নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের জন্য নীতিমালার বাইরে মৌখিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশের আগে তাদের গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতেও নিষেধ করা হয়েছে। ভোটকেন্দ্রের ছবি তোলা বা সরাসরি সম্প্রচারেও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এবার ভোট পর্যবেক্ষণে থাকবে মাত্র ২৬ হাজার পর্যবেক্ষক। এই প্রথম সংস্থাগুলোকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য আসন নির্ধারণ করে দিয়েছে কমিশন। একটি আসনে ৫০ জনের বেশি পর্যবেক্ষকের অনুমোদন দেয়া হয়নি। এ ছাড়া এবার নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকের সংখ্যাও সর্বনিম্ন। ভিসাসহ নানা জটিলতার কারণে অনেক পর্যবেক্ষক আসতে পারেন নি। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও পর্যবেক্ষক জোট আনফ্রেলের পক্ষ থেকে হতাশা প্রকাশ করা হয়েছে।