এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালদের রাজত্ব। দালালরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা গরিব অসহায় রোগীর স্বজনদের পকেট কাটছে। নানা অজুহাত ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে সরকারি হাসপাতালে স্বল্প মূল্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে বঞ্চিত করছে রোগীদের। এতে করে স্বল্প মূল্যে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বেসরকারি হাসপাতালের মতো ব্যয় হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে ঘিরে টেস্ট বাণিজ্যের জন্য বড় ধরনের কয়েকটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তারা হাসপাতালে আসা রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়েই দেদারসে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আর তাদেরকে রোগীর টেস্ট পেতে সাহায্য করছে খোদ হাসপাতালের কিছু অসাধু চিকিৎসক, ল্যাব কর্মকর্তা, অন্য স্টাফরা। বিনিময়ে তারা পাচ্ছেন মোটা অঙ্কের কমিশন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢামেক ঘিরে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ধানমন্ডি ও শান্তিনগর শাখা, গ্রিন রোডের এসআরএল ও ল্যাব সায়েন্স, প্রাইম ডায়াগনস্টিক সেন্টার, চানখারপুলের পিওর, দি প্যাথলজি, বকশি বাজারের মডার্ন হেলথ প্যাথলজি, লালবাগের পিপলস কেয়ার, ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ন ছাড়াও নামে বেনামে আরো অসংখ্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার সক্রিয় রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ১০/১৫ জন করে প্রতিনিধি রাত-দিন ঢামেকে অবস্থান করেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের যখন চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেন তখন তারা সেটি লুফে নেন। এ ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব প্যাডেই চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার নাম লিখে দেন। সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের একজন প্রতিনিধির মোবাইল নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করার কথা বলা হয়।
সরজমিন হাসপাতালের নতুন ও পুরাতন ভবনের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, কর্তব্যরত চিকিৎসকের পেছনে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রতিনিধিরা তাদের নিজস্ব প্যাড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ভর্তি রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হলে তারা তাদের প্যাড বাড়িয়ে দেন। তখন চিকিৎসকরা বলে দেন পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো দ্রুত করিয়ে আনতে হবে। ঢামেকে করালে অনেক সময় লাগবে। আবার অনেক সময় রোগীর স্বজনরা স্বল্প মূল্যে করানোর জন্য ঢাকা মেডিকেলকেই বেছে নেন। স্লিপ নিয়ে ল্যাবে গেলে দেখানো হয় নানা অজুহাত। কখনও মেশিন নষ্ট, কখনও রিপোর্ট পেতে দেরি হবে। এরকম নানা অজুহাতে ঢামেক বিমুখ করা হয় রোগীর স্বজনদের। ভুক্তভোগী রোগীরা তখন বাধ্য হয়েই বাইরে থেকে পরীক্ষা করিয়ে আনেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের মেডিসিন ওয়ার্ড ৭০১। এই ওয়ার্ডেই ভর্তি ফরিদপুরের আহসান মিয়া (৪৮)। ভর্তির পরপরই চিকিৎসকরা তাকে জরুরি ভিত্তিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটি বেসরকারি হাসপাতালের স্লিপে নাম লিখে স্লিপে থাকা মোবাইল নম্বরের ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। আহসান মিয়ার ছেলে রাকিব ওই মোবাইল নম্বরে ফোন দিলে কয়েক মিনিটের মধ্যে সেখানে এসে হাজির হন পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রতিনিধি জিয়াদ। তিনি এসে পরীক্ষা করাতে কত টাকা লাগবে বলে দেন। এর কিছুক্ষণ পর এসে তিনি আহসান মিয়ার রক্ত টেনে নিয়ে যান।
রাকিব বলেন, একটি স্লিপে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার নাম লিখে দিয়ে আমাকে একটি মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়। ফোন করলে একজন এসে পপুলারের প্রতিনিধি হিসাবে পরিচয় দেন। সার্জারি ওয়ার্ডের রোগীর স্বজন জাহাঙ্গীর বলেন, ১৫ দিন ধরে আমার ভাইকে নিয়ে এখানে আছি। আসার পর থেকে চিকিৎসকরা অনেক পরীক্ষা দিয়েছেন। সব টেস্টই বাইরে থেকে করাতে হয়েছে। হাসপাতালের ল্যাবে নানা অজুহাত দেখানো হয়। সময়মত রিপোর্ট ডেলিভারি দেয়া হয় না। আবার অনেক সময় কিছু কিছু টেস্টের জন্য মেশিন নষ্ট আছে বলা হয়। মিনহাজ নামে আরেক রোগীর স্বজন বলেন, আমরা কম টাকায় ঢামেকেই পরীক্ষা করাতে চাই। কিন্তু চিকিৎসকরা দ্রুত রিপোর্ট দিতে বলেন। এখানে পরীক্ষার রিপোর্ট দ্রুত দেয়া হয় না। আবার বাইরে থেকে করাতে গেলে দ্রুত রিপোর্ট দেয়া হলেও প্রতিটি পরীক্ষায় সরকারি হাসপাতালের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা গুনতে হয়।
পপুলার ডায়াগনস্টিকের প্রতিনিধি জিয়াদ বলেন, তিনি পপুলারের ধানমন্ডি শাখায় কাজ করেন। তিনি ছাড়াও তাদের দুটি শাখার অন্তত ৩০ জন প্রতিনিধি ঢামেকে কাজ করে। ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ন হসপিটালের প্রতিনিধি মশিউর রহমান বলেন, তাদের অন্তত ১৫/১৬ জন এখানে রাত দিন কাজ করে। ল্যাব সায়েন্সের আরেক দালাল হারুন অর রশিদ জানায়, তাদের একটি ওয়ার্ডে একজন করে তাদের ২০/২২ জন কাজ করে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক দালাল জানায়, ওয়ার্ড মাস্টার, ওয়ার্ডবয় , সর্দার, আনসাররা কাজ ভাগিয়ে নিতে অনেক ঝামেলা করে। তাদেরকে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে কাজ নিতে হয়। এ ছাড়া চিকিৎসকদেরও দিতে হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. আব্দুল আজিজ খান বলেন, সরকারি মূল্যে ঢামেকের প্যাথলজিতে প্রায় সব ধরনের পরীক্ষা হয়। এখানে সব ধরনের পরীক্ষা অনেক ভালো হয়। সেহেতু বাইরে থেকে করানোর কোনো প্রয়োজন হয় না। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একে এম নাসির উদ্দিন বলেন, ঢামেকের প্যাথলজিতে এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি পরীক্ষা করা হয়। বাইরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন হয় না। শুনেছি বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রতিনিধিরা রোগীর পরীক্ষা তাদের প্রতিষ্ঠানে করছে। এ ধরনের দালালদের ঠেকানোর জন্য আমরা চেষ্টা করছি। তবে আগের থেকে এখন অনেক কমেছে। তিনি বলেন, যারা এখানে কাজ করছে তারা বহুদিন ধরে এই কাজ করছে। এদেরকে সরাতে সময় লাগবে। দালালদের নজরদারিতে হাসাপাতালে আনসার সদস্য বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া আমরা অনেক দালালকে ধরে পুলিশে দিয়েছি। এজন্য রোগীর স্বজনদের সচেতন থাকতে হবে।