এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : রাতের শহর। ফাঁকা সড়ক। লাইটপোস্ট থেকে যেন ছিটকে পড়ছে আলো। দু’পাশের মার্কেটগুলো বন্ধ। হাতেগোনা কয়েকটি চা-সিগারেট ও খাবারের দোকান খোলা থাকলেও ভিড় নেই। মাঝে মধ্যে দেখা মেলে নিরাপত্তাকর্মী, পুলিশ আর জরুরি প্রয়োজনে বাসার বাইরে বের হওয়া পথচারীদের। কোথাও কোথাও নির্জন। এরমধ্যেই নির্জনতা ভেঙে কেঁপে উঠে রাতের সড়ক।
বাজে বিকট হর্ণ। দুরন্ত গতিতে ছুটে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও পিকআপ। এই গতি অনেকটা ভয়ঙ্করও। পণ্য নিয়ে অল্প সময়ে গন্তব্যে পৌঁছার প্রতিযোগিতায় নামেন চালকরা। রাতের সড়কে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে ট্রাকের বেপরোয়া গতির কারণে। প্রতিদিনই রাজধানীর কোথাও না কোথাও ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রাণ হারাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। রাত ১০টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত ঢাকা শহরের সড়কে থাকে ট্রাকের আধিপত্য। এই আট ঘণ্টায় রাজধানীতে দুর্ঘটনায় ৫০ শতাংশের বেশি হতাহত হন। ঢাকা মেডিকেল সূত্রে জানা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় ঢাকায় প্রতি মাসে গড়ে ৩০ জন নিহত হন। রাতে দায়িত্বপালনকারী ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরাও থাকেন বেপরোয়া ট্রাক আতঙ্কে। রাতের শহরের আতঙ্কের নাম ট্রাক।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় নিবন্ধিত ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও পিকআপ রয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৮২৫টি। এরমধ্যে ট্রাক ৬৭৯৮৩, পিকআপ ৮১৪০৪ ও কাভার্ডভ্যান ২৪৪৩৮টি। নিবন্ধন ছাড়া রয়েছে তার চেয়ে দ্বিগুণ। এ ছাড়াও প্রতিরাতে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় অন্তত অর্ধলক্ষাধিক ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও পিকআপ যাতায়াত করে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত তিন হাজার কেজি ওজনের বেশি গাড়িগুলো রাত ১০টার আগে শহরে ঢোকার নিয়ম নেই। তারপরও রাত ৮টার পরেই এই গাড়িগুলো ডিএমপি এলাকায় ঢুকতে শুরু করে। তখনই যানজটের সৃষ্টি হয় ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে। আব্দুল্লাহপুর, গাবতলী, কাঁচপুর, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, মাওয়া সড়কে বাঁধে তীব্র যানজট। ওই সময়েও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে এসব এলাকায়। গত ৫ই জানুয়ারি রাত ৯টার দিকে শ্যামপুর থানার সামনে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন এক তরুণী। আফরোজা আক্তার নামে ওই তরুণী বিকাশের এজেন্ট থেকে টাকা উত্তোলন করতে বাসার বাইরে বের হয়েছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ট্রাকের চাপায় প্রাণ হারান এই তরুণী।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে এসব গাড়ির গতি। রাত ১০টার পর অধিক সংখ্যক ভারী গাড়ি ঢুকে শহরে। রাতের সড়কে কাউকে পরোয়া করেন না ট্রাকচালকরা। পরদিন ভোর পর্যন্ত সড়ক থাকে ট্রাকসহ ভারী গাড়ির দখলে। ডিএমপির তেজগাঁও জোনে দায়িত্বপালনকারী সার্জেন্ট দুর্জয় জানান, রাতে সড়ক ফাঁকা পেয়ে ট্রাকগুলো বেপরোয়া গতিতে চলে। গভীর রাতে ট্রাকচালকরা নিয়ম-নীতির পরোয়া করেন না। ট্রাক চলাচলে পুলিশের বেঁধে দেয়া গতিসীমা ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার। কিন্তু বাস্তবে ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে দেখা যায়। বেপরোয়া গতিতেই রাজধানীর বিভিন্ন মোড় পার হয় ট্রাকগুলো। এ সময় ঝুঁকির মধ্যে থাকে ছোট যানবাহনগুলো। রাতে ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা থাকে অল্প। ঢাকার সড়কের বিশেষ মোড়গুলোতে ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করেন। তখন অনেক ঝুঁকি নিয়ে ট্রাফিক পুলিশকে দায়িত্ব পালন করতে হয় বলে জানান সার্জেন্ট দুর্জয়।
রাজধানীর মিরপুরের টেকনিক্যাল মোড়ে দায়িত্ব পালনকালে ট্রাকের ধাক্কায় আবদুল মজিদ নামের এক ট্রাফিক কনস্টেবল নিহত হন। ভোরে সিগন্যাল অমান্য করে একটি ট্রাক মজিদকে ধাক্কা দিলে তিনি নিহত হন। ঘটনাটি ঘটেছিলো গত বছর মার্চে। এভাবেই সাধারণ মানুষ থেকে ট্রাফিক পুলিশ কেউই নিরাপদ না এই গতি দানবের কাছে। গত ৮ই জানুয়ারি রাতে গুরুতর আহত হয়েছেন টিভি অভিনেত্রী অহনা। পুরান ঢাকায় একটি অনুষ্ঠান শেষে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ড্রাইভ করে উত্তরার বাসায় ফিরছিলেন তিনি। রাত তখন প্রায় ৩টা। উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে লেক ড্রাউভ রোডে পাথর বোঝাই একটি ট্রাক অহনার গাড়িকে চাপা দেয়। তখন ট্রাককে থামাতে চেষ্টা করলে গুরুতর আহত হন অহনা।
এ ছাড়াও ট্রাক শ্রমিকরাও শিকার হচ্ছেন দুর্ঘটনার। গত ২৬শে ডিসেম্বর ভোরে রাজধানীর শনির আখড়ায় ট্রাকের চাপায় নিহত হন দুজন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ট্রাক থেকে ইট নামানোর সময় পেছন থেকে দ্রুতগতির আরেকটি ট্রাক ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই ইটের মালিক হারুন এবং ট্রাকচালকের সহকারী বাশার নিহত হন।
ঢাকা-যশোর রুটের ট্রাকচালক রহিম উদ্দিন জানান, রাস্তায় তীব্র জ্যাম থাকে। বিশেষ করে আরিচা ঘাটে প্রতিরাতেই জ্যামে পড়তে হয়। এরমধ্যেই দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছতে হয় রহিম উদ্দিনকে। তাই বাধ্য হয়েই গতি বাড়াতে হয় বলে জানান তিনি। এ ছাড়াও পথে পথে ট্রাক থামিয়ে চাঁদাবাজি করা হয়। এসব কারণেও দ্রুতগতিতে চালান রহিম। তবে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো উচিত না স্বীকার করে এই চালক বলেন, ট্রাক লোড থাকে। গতি বাড়লে হঠাৎ থামানো প্রায় কঠিন। এসময় ট্রাক উল্টে যেতে পারে। যে কারণে ট্রাকের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে।
ডিএমপি’র ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মীর রেজাউল আলম বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে। তবে শুধু আইন প্রয়োগে হয়তো সম্ভব না। এজন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। সচেতনতা সৃষ্টি করতে ট্রাফিক পুলিশ কার্যক্রম চালাচ্ছে। এজন্য সমাজের সবাইকে সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন তিনি। সূত্র : মানবজমিন।