এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : চেহারায় আভিজাতের ছাপ। কথা বলেন কম, তবে ইংরেজি-বাংলার মিশ্রণে। পরনে ব্লেজার, দামি শার্ট, টাই। শরীরে পারফিউমের ঘ্রাণ। মিটিং করেন থ্রি স্টার, ফাইভ স্টার হোটেলে। এমনকি এসব হোটেল ছাড়া খাবার খান না তিনি। চাও পান করেন না নিম্নমানের কোনো রেস্টুরেন্টে। তিনি ওমর মবিন নামে পরিচিত।
মবিনের নানা পরিচয়। কখনো বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা, কখনো কাস্টম কমিশনার, কখনো ব্যবসায়ী। অনেকেই জানেন বিভিন্ন দেশে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা রয়েছে তার। মবিনের সঙ্গে সার্বক্ষণিক থাকেন কয়েক জন। ‘স্যার, স্যার’ বলে সম্বোধনে ব্যস্ত থাকেন তারা। এরমধ্যে কয়েকজন কখনও তার অধীনস্থ কর্মকর্তা, কখনও পার্সোনাল সেক্রেটারি। যখন কোথাও বের হন ব্যবহার করেন দামি নিশান প্রাডো গাড়ি। তার পেছনে ছুটে বেশ কয়েক গাড়ি।
এই ওমর মবিনের প্রকৃত নাম খন্দকার মো. ফারুক। অর্থ-বিত্ত বলতে তেমন কিছুই ছিলো না। নিম্ন মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের সন্তান ফারুক। কিন্তু ভাগ্য বদলে গেছে রাতারাতি। কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন তিনি। বাড়িতে বিলাসবহুল পাঁচতলা ঘর তৈরির কাজ করেছেন। ইতিমধ্যে তৃতীয় তলার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মালিক হয়েছেন বিপুল জায়গা, জমি ও একাধিক দামি গাড়ির। বিয়ে করেছেন দু’টি। প্রথম স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে আর দ্বিতীয় স্ত্রী থাকেন ঢাকার দক্ষিণখানে। দুই স্ত্রীর নামে রয়েছে বিপুল অর্থ, সম্পত্তি। বেশ কয়েকটি ব্যাংকে একাউন্ট রয়েছে তাদের। শপিং করতে যান দেশের বাইরে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ছাড়া কথা নেই। এমনকি সিনেমা দেখার জন্য আকাশপথে যান কলকাতা। গ্রামের বাড়ি জামালপুরের ইসলামপুরের লোকজন হিসাব মেলাতে পারেন না, এই অর্থ-সম্পদের উৎস কী। যেন আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ পেয়েছেন ফারুক।
শুরুটা ২০০৮ সালের পর থেকেই। রাজনীতিতে সক্রিয় ফারুক ছিলেন জামালপুর-২ আসনের এমপি ফরিদুল হক খান দুলালের আস্থাভাজন। তার পার্সোনাল সেক্রেটারি হিসেবে কাজ শুরু করেন ফারুক। এমপি’র পিএস হিসেবে প্রভাবশালীদের সঙ্গে গড়ে ওঠে সম্পর্ক। মানিক মিয়া এভিনিউ এলাকা থেকে সচিবালয় সর্বত্র ছিলো তার দৌড়ঝাঁপ। পার্সেন্টেজের বিনিময়ে কাজ উদ্ধার করে দিতেন। এমপি দুলালের অজান্তেই দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হতে যাচ্ছিলেন ফারুক। কিন্তু বেশিদিন তা গোপন থাকেনি। খবর পৌঁছে যায় এমপি ফরিদুল হক খান দুলালের কানে। তারপরই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় ফারুকের বিরুদ্ধে। চাকরিচ্যুত করা হয় তাকে। তা আজ থেকে ছয় বছর আগের কথা।
এ বিষয়ে ফরিদুল হক খান দুলাল এমপি বলেন, ফারুক আমার এখানে পিএস হিসেবে কর্মরত ছিলো। সে ছাত্রলীগ, যুবলীগ করতো। তাকে ভালো ছেলে হিসেবেই জানতাম। তাই নিয়োগ করেছিলাম। যখনই বুঝতে পারলাম লোকজনের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিচ্ছে। ধান্দা করছে। আমি তাকে চাকরিচ্যুত করেছি। তারপর ফারুক কোথায় কি প্রতারণা করেছে তা জানা নেই বলে জানান ফরিদুল হক দুলাল।
সূত্রে জানা গেছে, চাকরি চলে যাওয়ার পর আর এলাকায় যাননি ফারুক। থাকতেন ঢাকায়। মাঝে-মধ্যে জামালপুরে যেতেন বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ে। রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার মিশন শুরু করেন ফারুক। গড়ে তোলেন প্রতারক চক্র। এই চক্রটি কৌশলে ফাঁদে পেলে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। চক্রের প্রতারণার শিকারদের একজন রাজধানীর তুরাগ এলাকার এসডিসি ওভারসিজ ট্রেনিং অ্যান্ড টেস্টিং সেন্টারের মালিক মৃণাল সাহা। চক্রটি তার কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ২৪ লাখ টাকা। এ বিষয়ে মৃণাল সাহা জানান, ঘটনার কিছুদিন আগে থেকে এক ব্যক্তি প্রায়ই তার অফিসে যেতো। মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোর বিষয়ে কথা বলতো। এরমধ্যেই মৃণালকে জানায়, এয়ারপোর্টে জব্দকৃত স্বর্ণ নিলামে বিক্রি হবে। কম দামে তা কেনা যাবে। তার সঙ্গে কাস্টমের একজন কমিশনারের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। মৃণাল আগ্রহী হলে ৫ই জানুয়ারি উত্তরার একটি থ্রিস্টার হোটেলে বৈঠক হয় কাস্টম কমিশনার ওমর মবিন পরিচয়দানকারী ফারুকের সঙ্গে। ফারুকের পরনে তখন সাদা শার্ট, টাই। যেন কাস্টমসের পোশাক। সঙ্গী দু’জন তাকে স্যার, স্যার বলে সম্বোধন করছিলো। শুরুতেই নিজের একটি ‘সরকারি’ ভিজিটিং কার্ড দেন। এ সময় মৃণালকে জব্দকৃত স্বর্ণের বিভিন্ন কাগজপত্র দেখান ফারুক। এক কেজি স্বর্ণের জন্য ২৪ লাখ টাকা দাবি করেন ফারুক। কথামতো পরদিন বিমানবন্দর সংলগ্ন জিনজিয়ান রেস্টুরেন্টে টাকা নিয়ে হাজির হন মৃণাল সাহা। ইংরেজিতে কাস্টম লেখা গাড়িতে চড়ে ওই রেস্টুরেন্টে যান ফারুক। তার পেছনে আরও একটি গাড়ি। ভেতরে বসা ছিলেন দু’জন।
মৃণাল বলেন, কাস্টমসের পণ্য সম্পর্কে জানতে প্রশ্ন করছিলাম। তখন পিএ পরিচয় দানকারী একজন আমাকে চুপি চুপি বলে স্যারের সঙ্গে কম কথা বলেন। ওই সময়ে নগদ ২৪ লাখ টাকা ফারুকের হাতে দেন। মৃণালকে বসিয়ে রেখে যান ফারুক ও চক্রের সদস্যরা। মৃণাল অপেক্ষা করেন। কিন্তু স্বর্ণ নিয়ে আর ফেরা হয় না ফারুকের। ফোন দিলে রিসিভ হয় না। আধাঘণ্টা পরে ফোনটাও বন্ধ পাওয়া যায়। এ রকম বিভিন্ন অভিযোগ পেয়ে তদন্ত শুরু করে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)। তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গত ৯ই জানুযারি রাতে বেইলী রোডের নবাবী ভোজ রেস্টুরেন্টের সামনে থেকে ফারুকসহ এই প্রতারক চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। সিআইডি’র বিশেষ পুলিশ সুপার (সিরিয়াস অ্যান্ড হোমিসাইডাল স্কোয়াড) সৈয়দা জান্নাত আরা’র দিক নির্দেশনায় উপ-পুলিশ পরিদর্শক নিউটন কুমার দত্ত এই অভিযান পরিচালনা করেন।
এ সময় তাদের কাছ থেকে ভুয়া পরিচয়ের ১৮টি ভিজিটিং কার্ড, চারটি ব্যাংকের চেকের পাতা, ৪০ কোটি টাকার ব্ল্যাঙ্ক চেক, সাতটি মোবাইল ফোন ও বিভিন্ন অপারেটরের ১৩টি সিম কার্ড জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে, জামালপুর জেলার ইসলামপুরের কিংজাল্লা গ্রামের খন্দকার মো. ফারুক (৫২) ও তার সহযোগী চট্টগ্রামের ভোজপুরের আন্ধারমানিক গ্রামের নূর ইসলাম ওরফে ইলিয়াস (৩৮) এবং নওগাঁ সদরের সান্তাহার গ্রামের সাইফুল ইসলাম (৩১)। এ বিষয়ে রমনা থানায় একটি মামলা করা হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি’র উপ-পুলিশ পরিদর্শক নিউটন কুমার দত্ত বিপিএম বলেন, চক্রের সদস্যদের কাস্টমস হাউজ সংশ্লিষ্ট সিঅ্যান্ডএফ’র বিভিন্ন কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারা অত্যন্ত কৌশলে প্রতারণা করছিলো। এই চক্রে আরও অনেকে জড়িত থাকতে পারে। এজন্য রিমান্ডে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সাতদিনের রিমান্ড আবেদন করলে গত ১৪ই জানুয়ারি তাদের একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয় বলে জানান তিনি।