এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : দেশে অতি ধনী বাড়ার তথ্য প্রকাশের পর এবার খবর এলো ধনী বৃদ্ধির হারে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। গত বুধবার বৈশ্বিক সংস্থা ওয়েলথ এক্স প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। অতি ধনী ও ধনী বৃদ্ধির এ তথ্য সামনে আয় বৈষম্য আরো বাড়ার লক্ষণ বলে মনে করছেন অর্থনীতি সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, দেশে উচ্চবিত্ত বাড়ার হার বেশি হলে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের চাপে পড়ার শঙ্কা থাকে।
অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আয় বৈষম্য প্রচণ্ডভাবে বাড়ছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল একটা ক্ষুদ্র ধনাঢ্য গোষ্ঠীর কাছে গিয়ে জমছে। ওয়েলথ এক্সের প্রতিবেদনে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। তারা বলেন, উন্নয়নশীল দেশের প্রথম ধাপে উত্তরণ, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, আয় বৈষম্য, ঋণ খেলাপি, দুর্নীতি ও অনিয়মের সামগ্রিক প্রভাবেই দেশে ‘ধনীর’ সংখ্যা বেড়েছে।
তাদের মতে, দেশে ধনীর উত্থান হঠাৎ কোনো বিষয় নয়। তবে, প্রবৃদ্ধির হারে বিশ্বের শীর্ষে থাকা ধনীর তালিকা বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য অস্বস্তিকর। যারা বিপুল এই সম্পদ অর্জন করেছেন, তার উৎস ও প্রক্রিয়া খতিয়ে দেখা উচিত। তাদের মতে, এটা পরিষ্কার যে বাংলাদেশের সম্পদ গুটিকয়েক মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। কিছু সংখ্যক ব্যক্তি বা গ্রুপ সম্পদের মালিক হচ্ছেন। এক্ষেত্রে ব্যাংক খাত থেকে টাকা নিয়ে ফেরত না দিয়ে অনেকে ধনী হচ্ছেন।
ওয়েলথ এক্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধনী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। সংস্থাটি বলছে, আগামী পাঁচ বছর বাংলাদেশে ধনী মানুষের সংখ্যা ১১ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বাড়বে। ১০ লাখ থেকে ৩ কোটি ডলারের সম্পদের মালিককে (সাড়ে ৮ কোটি থেকে ২৫০ কোটি টাকা) এ তালিকায় রেখেছে ওয়েলথ এক্স। প্রতিষ্ঠানটি তাদের উচ্চ সম্পদশালী বা হাই নেট ওর্থ (এইচএনডব্লিউ) বলে অভিহিত করেছে। গত বুধবার ‘গ্লোবাল এইচএনডব্লিউ অ্যানালাইসিস: দ্য হাই নেট ওর্থ হ্যান্ডবুক’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল সময়ে দেশের সমন্বিত বার্ষিক জাতীয় প্রবৃদ্ধি বাড়বে শতকরা ১১.৪ ভাগ। ধনী মানুষের সংখ্যার দিক থেকে আর মাত্র চারটি দেশ তাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কে পৌঁছাবে। এর শীর্ষে রয়েছে নাইজেরিয়া। সেখানে এই হার শতকরা ১৬.৩ ভাগ। তার পরেই রয়েছে মিশর। সেখানে এই হার শতকরা ১২.৫ ভাগ। এর পরে বাংলাদেশ। এখানে এই হার শতকরা ১১.৪ ভাগ। এর পরে রয়েছে ভিয়েতনাম (১০.১ ভাগ), পোল্যান্ড (১০ ভাগ) চীন (৯.৮ ভাগ), কেনিয়া (৯.৮ ভাগ), ভারত (৯.৭ ভাগ), ফিলিপাইন (৯.৪ ভাগ) ও ইউক্রেন (৯.২ ভাগ)। ওই রিপোর্টে বলা হয়, এর অর্থ হলো, আগামী পাঁচ বছরে উচ্চমাত্রার নেট সম্পদের (এইচএনডব্লিউ) মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এইচএনডব্লিউ হিসেবে ওইসব ব্যক্তিকে ওয়েলথ এক্স সংজ্ঞায়িত করেছে, যাদের নেট সম্পদের পরিমাণ ১০ লাখ থেকে ৩ কোটি ডলার। আর যাদের ৩ কোটি ডলারের বেশি অর্থ রয়েছে তাদেরকে আল্ট্রা-হাই নেট ওয়ার্থ বা ইউএইচএনডব্লিউ হিসেবে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত বছর সেপ্টেম্বরে একই রকম রিপোর্ট প্রকাশ করে ওয়েলথ এক্স। তাতে বাংলাদেশকে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি, যেখানে অধিক হারে ধনী এমন দেশের মধ্যে শীর্ষে রাখা হয়। বলা হয়, ২০১২ থেকে ২০১৭ সময়ে এখানে ইউএইচএনডব্লিউ জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধির হার শতকরা ১৭.৩ ভাগ। ওদিকে ২০১৮ সালে বিশ্বে এইচএনডব্লিউ জনসংখ্যা শতকরা ১.৯ ভাগ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ২৪ লাখ। তাদের সমন্বিত সম্পদ শতকরা ১.৮ ভাগ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৬১.৩ ট্রিলিয়ন।
ধনী বৃদ্ধির বিষয়টিকে ‘স্বাভাবিক’ উল্লেখ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা এবি আজিজুল ইসলাম বলেন, এটা তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়বেই। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আয়ের যে বৈষম্য সেটাও অনেক বেড়েছে। তবে, আমাদের দেশে ধনী বাড়ার প্রবৃদ্ধি হার বেশি। তিনি বলেন, আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে যারা এই অর্থটা অর্জন করেছে, সেটা কী বৈধ না অবৈধ পথে- তা খতিয়ে দেখা দরকার। আবার এই সম্পদগুলো দেশে আছে, না দেশের বাইরে গেছে সেটাও দেখা দরকার। তিনি বলেন, এজন্য আমাদের করণীয় হবে কর্মসংস্থান, দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে মনযোগ দেয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশে ধনিক শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা গেছে, হঠাৎ করেই একটি শ্রেণির জীবনধারা পাল্টে গেছে। কিন্তু এসব ব্যক্তি যে ব্যাপক উদ্ভাবনী কিছু করেছে তা কিন্তু নয়। এটা হয়েছে মূলত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কারণে। যেসব ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে, ব্যাংকের সুবিধা নিয়েছে, ক্ষমতার কাছাকাছি থেকেছে, তাদেরই এই পরিবর্তন হয়েছে। বিপরীতে অন্যদের মধ্যে যারা অনেক দক্ষ আছে তারা কিন্তু এসব সুযোগ সুবিধা পায়নি। এতে উন্নয়নের যে নেতিবাচক দিক সেটা প্রকাশ পেয়েছে। আমরা প্রবৃদ্ধি দেখছি, সুষম বণ্টন দেখছি না। সমতা ভিত্তিক উন্নয়ন দেখছি না। তার জন্য শিক্ষা-স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান সবদিকে আমাদের নজর দিতে হবে। আমাদের আর্থিক নীতি, বাজেট, রাজস্ব ব্যবস্থা ও কর কাঠামো সুষম উন্নয়নের জন্য সহায়ক নয়। এগুলোর সংস্কার হওয়া উচিত বলে মনে করেন সালেহ উদ্দিন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা বিভিন্ন সময়ে বলে আসছি আমাদের দেশে এক অর্থে সম্পদের বৈষম্য বাড়ছেই। বিবিএস’র ২০১০ এবং ২০১৬ সালের যে খানা জরিপ, সেখান থেকেও যেটা দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের আয় ও সম্পদ বৈষম্য বাড়ছে। আর সেটারই একটা প্রতিফলন ঘটেছে এই রিপোর্টে। ধনী বাড়ার কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেকেই বিভিন্ন সম্পদ আয় করছেন যেগুলো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। সেগুলোর কারণেও আয় বৈষম্য বাড়ছে। ঋণ নিয়ে অনেকে ঋণ খেলাপি হচ্ছে। ঋণের টাকা ব্যাংকে ফেরত দেয়া হচ্ছে না। সেটার কারণেও কারো কারো হাতে অনেক সম্পদ জমা হচ্ছে। এসব কারণে আমাদের দেশে ধনীর সংখ্যা বাড়ছে। অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু মানুষের ধন-সম্পদ সৃষ্টি হবে, সেটা তো অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু ধনী বাড়ার ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির হারে বিশ্বের শীর্ষে আছি সেটা কিন্তু স্বস্তিদায়ক কোনো ঘটনা নয়। এটা হচ্ছে দুর্নীতি, ঋণ খেলাপি, আয়কর না দেয়ার কারণে। আর এসব কারণেই একটা শ্রেণির কাছে অর্থের পাহাড় গড়ে উঠছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, দেশে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও সুবিধাভোগী হচ্ছে শীর্ষ ৫ শতাংশ মানুষ। তার মতে, দেশে বড় লোকই বড় লোক হচ্ছে। দরিদ্রের হাতে অর্থ থাকছে না। এমনকি নিম্ন মধ্যবিত্তরা মধ্যবিত্ত হতে পারছে না। নিচের স্তরের মানুষের কোনো উন্নতি হচ্ছে না। তিনি বলেন, এদের একটা বড় অংশ ব্যাংকের টাকা চুরি করে ধনী হচ্ছে। নিয়ম ও অনিয়মের মধ্য দিয়ে এরা ধনী হচ্ছে। বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা চুরি করেও ধনী হচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, সাধারণত যখনই সামষ্টিক অর্থনীতিতে ন্যায়-নীতি, নিয়ম-কানুন এবং বিচারের ঠিক থাকে না, যখন প্রতিকার ঠিক মতো না হয়, তখনই এগুলো হয়। আর তখনই একটি শ্রেণি অতি ধনী হয়ে উঠে।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খানের মতে, কেউ যদি কর দেয়, দিয়ে যদি ধনী হয়, এটাতে কোনো সমস্যা দেখছি না। নিশ্চয়ই এটা তার অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রমের ফসল। ধনী হওয়াতে দোষ নেই। তবে, যে লোকগুলো ধনী হচ্ছে, তাদের যেভাবে কর দেয়ার কথা সেভাবে দিচ্ছে কী না, সে সৎপথে ব্যবসা করছে কী না, শ্রমিকের মজুরি ঠিক মতো দিচ্ছে কী না তা খতিয়ে দেখা উচিত।