এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে মামলা-হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়াতে ১০টি বিভাগীয় কমিটি গঠন করেছে বিএনপি। কমিটিগুলো দলের সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক-সহ সম্পাদকদের নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে হামলা-মামলা, হতাহত, ক্ষয়ক্ষতি ও বন্দি নেতাদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করবেন। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের জন্য কি কি করছেন বা উদ্যোগ নিয়েছেন তা জানবেন। যেসব আসনের প্রার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছেন তাদের তদারক করা হবে। যেখানে প্রার্থীরা কোনো উদ্যোগ নেননি সেখানে কেন্দ্রীয়ভাবে সহায়তা দেয়া হবে। বিশেষ করে যারা কারাগারে আছেন তাদের মুক্তিতে বিলম্বের কারণ চিহ্নিত ও আইনি সহায়তা দেবেন।
আহতদের চিকিৎসা সহায়তা ও নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়াবেন। এজন্য আগামী সপ্তাহ থেকে কমিটির সদস্যরা সংশ্লিষ্ট জেলাগুলো সফর করবেন।
এসব সফরে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করতে ঘরোয়া আলোচনা সভা ও উঠোন বৈঠকের মতো কর্মসূচিও নেয়া হবে। সেখানে সাংগঠনিক দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা হবে। ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িতেও যাবেন। নির্বাচনে ফলবিপর্যয় ও হাজার হাজার নেতাকর্মীর কারাবন্দিত্বের কারণে ব্যাকফুটে থাকা দলটি রাজনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে এ উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। এইসব কমিটি গঠনে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছে- ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পূর্বাপর সরকারি বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী কর্তৃৃক হামলা, মামলা, গ্রেপ্তার ও আহতসহ ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মী ও সমর্থকদের দলীয় প্রার্থীরা কীভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করছেন তা সমন্বয়পূর্বক কেন্দ্রকে সঠিকভাবে অবহিত করার জন্য বিভাগওয়ারি টিম কাজ করবে।’
দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের একজনকে আহ্বায়ক করে গঠিত ৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিগুলোতে স্ব-স্ব বিভাগের সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকরা সংযুক্ত হবেন। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান ঢাকা বিভাগ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু রংপুর বিভাগ, মোহাম্মদ শাহজাহান খুলনা বিভাগ, আহমদ আজম খান ফরিদপুর বিভাগ, মীর মোহাম্মদ নাসির বরিশাল বিভাগ, শওকত মাহমুদ চট্টগ্রাম বিভাগ, বরকতউল্লাহ বুলু রাজশাহী বিভাগ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার সিলেট বিভাগ, কবির মুরাদ কুমিল্লা বিভাগ ও যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পেয়েছেন। নেতারা জানান, যেসব আসনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০দলীয় জোটের প্রার্থী ছিল সেসব আসনে দায়িত্বপূর্ণ নেতাদের সমন্বয় করে ওইসব প্রার্থীদের কাজ করার জন্য বলা হয়েছে। ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটি ও ২০দলীয় জোটের বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
খুলনা বিভাগীয় কমিটির আহ্বায়ক বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, সারা দেশে ক্ষতিগ্রস্ত তৃণমূল নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সেখানে আমাকে খুলনা বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আমার সঙ্গে রয়েছেন- প্রফেসর ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম, অধ্যক্ষ সোহরাবউদ্দিন, অপর্ণা রায় দাস ও আমিরুল ইসলাম শিমুল। সেই সঙ্গে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকরাও থাকবেন। শাহজাহান বলেন, সারা দেশে নির্যাতনের একই চিত্র। আমাদের হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে আটক রয়েছেন। এসব নেতাকর্মীর জামিনে মুক্তির জন্য আইনি সহায়তা কতটুকু দেয়া হচ্ছে, তাদের মুক্তিলাভের প্রধান অন্তরায়গুলো কী ধরনের তা চিহ্নিত করার জন্য আমরা কাজ করবো।
আমরা খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জু, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত ও জয়ন্ত কুণ্ডুর সঙ্গে আলোচনা করেছি। এখন তারা আলোচনা করে আমরা কোথায় কোথায় যাবো তার একটি প্রোগ্রাম ঠিক করবেন। সে অনুযায়ী আগামী সপ্তাহ থেকেই আমাদের আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড শুরু করবো। সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে আমাদের দলীয় এমপি প্রার্থী যারা ছিলেন তাদের সঙ্গেও বসবো। ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িতে যাবো, তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবো। ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিটির আহ্বায়ক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, আমরা ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছি। সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতিটি জেলার নেতাকর্মীদের মামলা-হামলাসহ হতাহতের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি।
সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা সংশ্লিষ্ট ৫ জেলায় তিনদিনের একটি সফরে যাবো। ওইসব জায়গায় আমাদের দলীয় এমপি প্রার্থীরা কি কি পদক্ষেপ নিয়েছে তা ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের কাছেই জানবো। আলাল বলেন, আমরা নেতাকর্মীদের আইনি সহায়তার পাশাপাশি যারা কারাগারে বা হাসপাতালে আছেন, যারা আহত-নিহত হয়েছেন সার্বিকভাবে তাদের পাশে দাঁড়াবো। তবে এ দায়িত্ব পাওয়ার আগেই আমি সপ্তাহখানেক ধরে আইনজীবী হিসেবে দেশের নানা এলাকার নেতাকর্মীদের আইনি সহায়তা দিচ্ছি। এ কমিটির সদস্যরা হলেন- নিলোফার চৌধুরী, রুমিন ফারহানা, আবদুল বারি ড্যানি ও অমলেন্দু দাস অপু। এ ছাড়া সমন্বয়ক হিসেবে সংযুক্ত হয়েছেন ময়মনসিংহ বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স। অন্যদিকে ঢাকা বিভাগীয় কমিটির সদস্যদের মধ্যে একজন রয়েছেন যিনি নিজেই দীর্ঘদিন কারাভোগের পর সদ্য জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তিনি বলেন, দলের একজন কর্মী কারাগারে থাকা পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। যেসব নেতাকর্মীর আইনি সহায়তা এলাকার নেতৃত্ব যথেষ্ট বলে মনে হবে না তাদের কেন্দ্রীয়ভাবে সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
বিএনপি ও অঙ্গ দলের নেতাকর্মীরা জানান, দলের নেতাকর্মীদের মামলা পরিচালনায় কিছু কিছু জেলা ও নির্বাচনী আসনের নেতারা সচেষ্ট। উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নেয়ার প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে নিম্ন আদালতের মামলা পরিচালনায়ও তারা সহযোগিতা করছেন। গত সোম ও মঙ্গলবার নিজ নির্বাচনী আসনের ৩৫৭ জন নেতাকর্মীকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন ও অ্যাডভোকেট কামরুল আলম কামালের সহায়তায় ৯টি মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন করিয়েছেন যশোর-৪ আসনে বিএনপি দলীয় প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার টিএস আইয়ুব। তিনি জানান, বাঘারপাড়া ও অভয়নগর থানায় নির্বাচনে আগে-পরে দায়ের হওয়া এসব মামলায় প্রায় ১২০০ জন নেতাকর্মী অভিযুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে ৩০০ জনের মতো কারাগারে ছিল। তাদের ১৫০ জনের বেশি জামিন পেয়েছে। জেলা আদালত জামিন না দেয়ায় হাইকোর্ট থেকে এসব জামিন নিতে হয়েছে। একইভাবে ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান, মৌলভীবাজার জেলা সভাপতি এম নাসের রহমান, চাঁদপুর জেলা বিএনপির সভাপতি শেখ ফরিদ আহমেদ মানিকসহ অনেকেই নিজ জেলার ও আসনের অন্তত ৫শ’ থেকে এক হাজার নেতাকর্মীকে উচ্চ আদালতে জামিনে সহায়তা করেছেন।
বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ৮ই নভেম্বর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর ৮ই জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৪ হাজার ৪শ’ ৭০টি মামলা হয়েছে। এতে এজাহারনামীয় আসামির সংখ্যা ১৬ হাজার ৮৩০ জন্য এবং অজ্ঞাত আসামির সংখ্যা ৯৫ হাজার ৭৩৩ জন। এসব মামলায় ১৫ হাজার ৮৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অন্যদিকে ২০১৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর থেকে ৭ই নভেম্বর পর্যন্ত দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪ হাজার ৪৫৩টি। এসব মামলায় এজাহারনামীয় আসামি ১ লাখ ১১ হাজার ৭৫ জন, অজ্ঞাত আসামি ৩ লাখ ২৭ হাজার ৭৫৭ জন। এ সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তারের সংখ্যা ১১ হাজার ৫৮ জন। এ ছাড়া ২০০৭ থেকে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নানা সময়ে নানা আন্দোলন বা ইস্যুকে কেন্দ্র করে দায়েরকৃত হাজার হাজার মামলা তো রয়েছেই। দলের দপ্তর থেকে বলা হয়েছে- ২০০৯ সাল থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত মোট মামলার সংখ্যা ৯০ হাজার ৩৪০টি। আসামির সংখ্যা ২৫ লাখ ৭০ হাজার ৫৪৭ জন। এদিকে নির্বাচনকালীন ও পরে হামলার ঘটনা রয়েছে ৪ হাজার ১১৬টি। এসব হামলায় আহত হয়েছেন ১৭ হাজার ১৩ জন এবং নিহত হয়েছেন ১৭ জন নেতাকর্মী। ২০০৯ সাল থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত মোট হত্যার শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৫১২ জন। গুরুতর আহত ও জখম হয়েছেন ১০ হাজার ১২৬ জন।