এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : লিপস্টিক দিয়ে সাজিয়ে দেয়ার প্রলোভন। এক বাটি খিচুড়ি বা এক প্যাকেট বিস্কুটের লোভ দেখিয়ে অবুঝ শিশুকে ডেকে নেয়া। তারপর ধর্ষণ চেষ্টা বা ধর্ষণ, হত্যা। নিষ্ঠুর, বর্বর এমন ঘটনাই ঘটছে আমাদের চারপাশে। মানুষ নামের কিছু নরপশুর বিকৃত লালসার শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিশু। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনা ঘটছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু ঘটনার শিকার। কেন এমন নির্মম নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটছে? সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন- মানুষের বিকৃত রুচিবোধ, সামাজিক মূল্যবোধে অবক্ষয় ও সামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট এমন সব অপরাধের পেছনে ভূমিকা রাখছে। তারা বলছেন, এসব ঘটনা রোধে নৈতিক মূল্যবোধ জাগাতে হবে।
সংঘবদ্ধ সামাজিক প্রতিরোধ আর কঠোর আইন প্রয়োগ এ ধরনের বর্বরতা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের অনেক ঘটনার পর অপরাধীদের গ্রেপ্তার করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। তাদের অনেকে স্বীকারোক্তিও দিয়েছে। রাজধানীর ডেমরা এলাকায় ধর্ষণ চেষ্টার পর এক সঙ্গে দুই শিশু হত্যার ঘটনায় নাড়া দিয়েছে অনেককে।
গত ৭ই জানুয়ারি ঘরের সামনে খেলা করছিল দুই শিশু দোলা ও নুসরাত। তাদের লিপস্টিক দিয়ে সাজিয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ফ্ল্যাটে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করে আজিজুল ও মোস্তফা নামের দুই দুর্র্র্বৃত্ত। ভয়ে ওই শিশুরা চিৎকার শুরু করলে ক্যাসেট প্লেয়ারের সাউন্ড বাড়িয়ে দিয়ে চলে ধর্ষণ চেষ্টা। ব্যর্থ হয়ে শ্বাসরোধ করে দুই অবুঝ শিশুকে হত্যা করে পালিয়ে যায় পাষণ্ডরা। চাঞ্চল্যকর এই ধর্ষণের ঘটনার পর দুই শিশুর অভিভাবকরা অভিযোগ করলে আসামিদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের স্বীকারোক্তিতেই বেরিয়ে আসে ঘটনার নির্মমতা। দুই পরিবারের এ দুই শিশু সবেমাত্র স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিল। এই বয়সে তাদের এমন বর্বর নিষ্ঠুর মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ তাদের পরিবার ও স্বজন। ঘাতকদের জবানিতে ঘটনার বর্ণনা শুতে হতবাক এলাকার মানুষও।
এ ঘটনার দুদিন আগে ৫ই জানুয়ারি গেণ্ডারিয়ায় দুই বছর বয়সী এক শিশুকে খিচুড়ি খাওয়ানোর প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ ওঠে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। নিম্ন আয়ের পরিবারের ওই শিশুর মা সকালে মেয়েকে রেখে কাজে গিয়েছিলেন। খেলার জন্য শিশুটি ঘর থেকে বাইরে গিয়েছিল। ওই ফাঁকে পাশের বাসার অভিযুক্ত ব্যক্তি শিশুটিকে খিচুড়ি দেয়ার লোভ দেখিয়ে বাসায় ডেকে নেয়। তাকে ধর্ষণ চেষ্টার সময় শিশুটি কান্নাকাটি করলে তাকে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করে পাষণ্ড ওই ব্যক্তি। এ ঘটনায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে নিজের মেয়েই আদালতে সাক্ষী দিয়েছে।
অন্যদিকে ৮ই জানুয়ারি সাতক্ষীরার গাবতলায় দ্বিতীয় শ্রেণির এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করে বাড়ির সেপটিক ট্যাংকে ফেলে দেয়ার ঘটনা ঘটে। ঘটনার একদিন পর লাশ উদ্ধার করা হয় ওই শিশুটির। এ ছাড়া সমসাময়িক সময়ে ২রা জানুয়ারি বগুড়ার আমতলা রেল কলোনিতে ৬ বছরের শিশুকে ধর্ষণ চেষ্টা, ১২ই জানুয়ারি মাগুরায় তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব অভিযোগে অভিযুক্তদের এরই মধ্যে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ। দেশজুড়ে এই শিশু ধর্ষণের পাশাপাশি ঘটছে নারী ধর্ষণের ঘটনাও। চলতি বছরের শুরু থেকে এই ২২ দিনে দেশব্যাপী এমন নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনায় ব্যাপক উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। গণমাধ্যমে আসা তথ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত নারী ও শিশু ধর্ষণ এবং ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ২৯টি। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা ১৯টি। ভোটের দিন রাতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে এক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।
গত ২০শে জানুয়ারি, সাভারে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে এক তরুণীকে ধর্ষণের পর মারধর করে তাড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ ওঠে। পরে ওই তরুণী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এ ঘটনায় হৃদয় নামের এক যুবকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে ভুক্তভোগীর পরিবার। সাভারেই গত ১৭ই জানুয়ারি দিনাজপুর থেকে চাকরির জন্য আসা এক কিশোরীকে ধর্ষণ করেছে মোশারফ হোসেন নামের এক যুবক। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ওই কিশোরীকে আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়েছে। ধর্ষক মোশারফকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এদিকে, গত সোমবার দুপুরে নরসিংদীর সদর উপজেলায় দ্বিতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ ঘটনায় মেয়েটির পরিবার বাদী হয়ে অভিযুক্ত উত্তম দাসের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। গত শনিবার চট্টগ্রামের আনোয়ারায় বাড়ির উঠানে খেলার সময় এক শিশুকে বিস্কুট কিনে দেয়ার কথা বলে একটি পুকুরপাড়ে নিয়ে ধর্ষণ করে তার দূর সম্পর্কের এক চাচা। এ ঘটনায় রোববার রাতেই মামলা করেন শিশুটির মা।
৩০শে ডিসেম্বর রাতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গণধর্ষণের শিকার হন চার সন্তানের জননী। ধানের শীষে ভোট দেয়ার কারণে তিনি এ ঘটনার শিকার বলে অভিযোগ নির্যাতিতা ও তার পরিবারের। এ ঘটনার পর কবিরহাট ও সাভারেও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীদের পরিবার অভিযোগ করলে পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তার করেছে।
গত বছরও নারী ও শিশু ধর্ষণের চিত্র ছিল উদ্বেগজনক। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১১৭৬টি। এর মধ্যে ৭৩২ জন নারী ও ৪৪৪ জন শিশু। আসকের ওই প্রতিবেদন বলছে, ৭৩২ জন নারীর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৬৩ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন। এদিকে, আসকেরই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৭ সালে মোট ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৮১৮টি। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী সময়ে ৪৭ নারীকে হত্যা করা হয়েছে এবং আত্মহত্যা করেছে ১১ জন।
তবে, এই ধর্ষণের পরিস্থিতি ২০১৬ সালে ছিল আরো ভয়াবহ। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে ওই বছর ১০৫০ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের এই মহামারী আকার ধারণ করা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, সমসমায়িক ঘটনাগুলো নজরে এসেছে। ধর্ষণ মহামারী আকার ধারণ করেছে। এটা খুবই উদ্বেগজন। কেন এই ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিন কারণে হতে পারে। প্রথমত মানুষের আচরণগত অসুস্থতা, দ্বিতীয়ত রাজনৈতিক প্রভাব দেখানো এবং তৃতীয়ত সংস্কৃতির বিশ্বায়নের কারণে এ ঘটনাগুলো ঘটছে। ১০ বছর আগে যখন ধর্ষণ হতো তখন শুধু আচরণগত অসুস্থতার কারণেই হতো। তবে, এখন সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনার দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে, অনেক ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে। অন্যদিকে, সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের ফলে যুব সমাজ অন্য দেশের সংস্কৃতি দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে চাহিদা মেটানোর জন্য ধর্ষণের ঘটনায় জড়িয়ে যায়। তিনি বলেন, সরকার সবসময় আইনের উপর চলতে চায়।
কিন্তু আইন এ ধরনের সমস্যা সমাধানের একটি প্রক্রিয়া। তবে, বড় সমাধানের পথ হলো মানুষকে কেন্দ্র করে সমষ্টিগত উদ্যোগ নেয়া। আরেকটি বিষয় হলো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তি থাকে তাহলে তাকে দলে স্থান না দিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেয়া। নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ বিষয়ক যেকোনো ঘটনা নজরে আসা মাত্রই দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে জানিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এ আইজি সোহেল রানা বলেন, নারী নির্যাতনসহ যেকোনো অপরাধ দমনে পুলিশ তৎপর। এ ধরনের কোনো অভিযোগ পেলে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করি। আসামি গ্রেপ্তারে নির্যাতিতাকে নিরাপত্তা ও মামলার তদন্তে আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকি।