এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : এ অপপ্রচার পুরনো। বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড পোশাক খাত বহুবারই এর শিকার হয়েছে। এটা অসত্য নয় যে, অনেক পোশাক কারখানাতেই কর্মপরিবেশের ঘাটতি আছে। কোথাও কোথাও শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি থেকেও বঞ্চিত। কিন্তু বহুবারই দেখা গেছে, যেসব পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত, শ্রমিকরাও ন্যায্য মজুরি পান সেসব কারখানাও অপপ্রচারের শিকার হয়েছে। ষড়যন্ত্রের বিষয়বস্তু করা হয়েছে পুরো পোশাক খাতকেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইন্টারস্টফ অ্যাপারেলস এমনই অপপ্রচারের শিকার। দাতব্য প্রতিষ্ঠান কমিক রিলিফ লৈঙ্গিক সম-অধিকারের প্রচারণায় ব্যবহারের জন্য আই ওয়ানা বি স্পাইসগার্ল লেখা সম্বলিত টি-শার্টগুলো তৈরি করিয়েছে।
গার্ডিয়ানের রিপোর্টে পোশাক কারখানাটির বিরুদ্ধে কম মজুরি দেয়া, শ্রমিকদের হেনস্তা করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ করা হয়েছে। বাংলাদেশের পোশাকখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইন্টারস্টফ দেশের উন্নত পোশাক কারখানাগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রকাশিত রিপোর্টে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে কারখানাটির সুনামহানির চেষ্টা করা হয়েছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতের ভাবমূর্তি নষ্ট করারও ষড়যন্ত্র থাকতে পারে এর পেছনে। বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, রিপোর্টে যে তথ্য দেয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভুল। এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে এর প্রতিবাদ জানাবো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ইন্টারস্টফ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪৩ লাখ পাউন্ডের পণ্য রপ্তানি করেছে এবং এ খাত থেকে ট্যাক্স কর্তনের আগে লাভ করেছে ২০ লাখ পাউন্ড। যা শতকরা ৪৬.৫১ ভাগ। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, ইন্টারস্টফ রপ্তানি করেছে ৪৬৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকার (৪ কোটি ২৬ লাখ পাউন্ড) পণ্য। এতে আয় হয়েছে ২১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা (১৯ লাখ ৬০ হাজার পাউন্ড), যা শতকরা ৪.৬২ ভাগ।
ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, সরকার বেতন বৃদ্ধি করে সর্বনিম্ন নির্ধারণ করেছে ৮০০০ টাকা। এ ছাড়া গত ৫ বছরের মধ্যে এটাই প্রথম বেতন বৃদ্ধি। অথচ বেতন বৃদ্ধির আওতায় গত ৫ বছরে মূল বেতনের বার্ষিক শতকরা ৫ ভাগ বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে ইন্টারস্টফের কর্মীদের দেয়া বেতনের প্রকৃত সত্য প্রকাশিত হয়নি। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বেতন দেয়া হয়েছে গ্রেড-২ এর সর্বনিম্ন বেতন ১৫৪১৬ টাকা। ইন্টারস্টফের এক্ষেত্রে গড় বেতন ১৫৪১৬ টাকা। এমন বেতন পাওয়া শ্রমিকের শতকরা হার ০.১৪ ভাগ। গ্রেড-৩ এর সর্বনিম্ন বেতন ৯৮৪৫ টাকা। ইন্টারস্টফ এ গ্রেডে গড় বেতন দিয়েছে ১০১৮৮ টাকা। এমন শ্রমিকের হার শতকরা ৯.৬২ ভাগ।
গ্রেড-৪ এর সর্বনিম্ন বেতন ৯৩৪৭ টাকা। ইন্টারস্টফ এ গ্রেডে গড় যে বেতন দিয়েছে তা হলো ৯৬৯২ টাকা। এমন শ্রমিকের শতকরা হার হলো ৩০.৭৮ ভাগ। গ্রেড-৫ এর শ্রমিকদের সর্বনিম্ন বেতন ৮৮৭৫ টাকা। ইন্টারস্টফ এ গ্রেডের শ্রমিকদের বেতন দিয়েছে ৯৭১২ টাকা। এমন শ্রমিকের শতকরা হার ৪১.০৬ ভাগ। গ্রেড-৬ এর সর্বনিম্ন বেমন ৮৪২০ টাকা। ইন্টারস্টফ এই গ্রেডের বেতন দিয়েছে ৮৯৮৩ টাকা। এমন শ্রমিকের শতকরা হার ৩.২৬ ভাগ। গ্রেড-৭ এর সর্বনিম্ন বেতন ৮০০০ টাকা। এই গ্রেডে ইন্টারস্টফ বেতন দিয়েছে ৮০৩০ টাকা। এমন শ্রমিকের শতকরা হার ১৫.১৪ ভাগ। এ ছাড়া শ্রমিকরা পান দুটি উৎসব ও উপস্থিতি বোনাস, প্রভিডেন্ট ফান্ড সুবিধা, উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রণোদনা, অর্জিত ছুটির ক্ষেত্রে আর্থিক সুবিধা, সার্ভিসখাতের সুবিধা ইত্যাদি।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ম্যানেজাররা কর্মীদের সঙ্গে আপত্তিকর ভাষা ব্যবহার করেন। কিন্তু, ইন্টারস্টফের রয়েছে হয়রানি ও নির্যাতনের ক্ষেত্রে শূন্য সহনশীলতার নীতি। শ্রমিকদের অভিযোগ জানানোর জন্য যে চ্যানেলগুলো আছে তার মধ্যে রয়েছে খোলা দরজা নীতি (ওপেন ডোর পলিসি), অভিযোগ/পরামর্শ বক্স, হটলাইন নাম্বার। আছে কাস্টমার টোল ফ্রি হেল্পলাইন ও সুরক্ষাবিষয়ক লাইন। পূর্ণাঙ্গ গোপনীয়তার সঙ্গে এবং খুব অগ্রাধিকার দিয়ে সব অভিযোগের বিষয়ে নজর দেয়া হয়। নিরপেক্ষ অডিটররা অডিট করেছেন ইন্টারস্টফ। তারা শ্রমিকদের গোপনীয়তার সঙ্গে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। শ্রমিকদের সচেতন করতে এবং তাদের কথা বলার বিষয়ে রয়েছে ৩০ সদস্যের অংশগ্রহণকারী কমিটি। এতে রয়েছেন শ্রমিকদের নির্বাচিত ২৪ জন প্রতিনিধি। ইটিআই, ইউকে’র নির্দেশনা ও তদারকিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে সাম্প্রতিক নির্বাচন।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, শ্রমিকদেরকে জোরপূর্বক ওভারটাইম কাজ করতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু নিয়মিত কর্মঘণ্টার পরে সব শ্রমিকই কাজ থেকে চলে যাওয়ার ক্ষেত্রে মুক্ত। শ্রমিকদের হ্যান্ডবুক, ছাপানো পোস্টারে এমনটাই পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা আছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা কাজ করার কারণে শ্রমিক ও তাদের পরিবারের পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পরীক্ষা বা শিক্ষা সংক্রান্ত কারণে শ্রমিকদের ছুটি দেয়া হয়। এজন্য ইন্টারস্টফ তাদেরকে বেতন দিয়ে থাকে। এ ছাড়া শ্রমিকদের ছেলেমেয়ের শিক্ষাকে আর্থিক পুরস্কার ও সনদ দেয়ার মাধ্যমে উৎসাহিত করা হয়।
ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, অন্তঃসত্ত্বা শ্রমিকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হয়। তাদের দিয়ে অতিরক্তি সময় কাজ করতে বাধ্য করানো হয়। কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা শ্রমিকদের জন্য কল্যাণকর উদ্যোগ নিয়েছে ইন্টারস্টফ এবং তাদের আইনের যেসব বাধ্যবাধকতা আছে তার ঊর্ধ্বে রাখা হয়েছে। যখন কারখানার মেডিকেল সেন্টারে (যেখানে পুরুষ ও মহিলা ডাক্তাররা আছেন) নিজেকে অন্তঃসত্ত্বা হিসেবে নিবন্ধিত করান তখন তার কাজের ভার পর্যালোচনা করা হয় এবং চিকিৎসকদের নির্দেশনা অনুযায়ী তা কমিয়ে দেয়া হয়।
এ বিষয়টি ঘনিষ্ঠভাবে নজরদারি বা মনিটরিং করে সমাজকল্যাণ বিষয়ক কর্মকর্তারা। এ ছাড়া ওইসব শ্রমিক মাসিক মেডিকেল চেকআপ ভাতা পান। প্রশিক্ষিত চিকিৎসকরা তাদের হাইজিন ও সচেতনতা বিষয়ে পরামর্শ দেন। বিনা পয়সায় তাদের প্রথম আলট্রা-সনোগ্রাম করা হয়। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জেনারেল ওষুধপত্র দেয়া হয়। স্বাস্থ্যবীমার অধীনে হাসপাতালের খরচ দেয়া হয়। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, অসম্ভব টার্গেট পূরণ করতে বলা হয় শ্রমিকদের। কিন্তু ২০১৮ সালে ইন্টারস্টফের শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশি শ্রমিক এ টার্গেট পূরণ করেছেন এবং তারা বিভিন্ন সময়ে পারফরমেন্সের জন্য প্রণোদনা পেয়েছেন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে শতকরা ৮৬ ভাগ সুইং অপারেটর পারফরমেন্সের জন্য প্রণোদনা পেয়েছেন।