মেহেদি হাসান : পৃথিবীর ভূস্বর্গ কাশ্মির। সৌন্দর্যের এক আধার। কিন্তু এই ভূখণ্ড আজ বিপন্ন। মানুষসৃষ্ট রাজনীতি আর নিষ্ঠুরতায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কাশ্মীরিরা। বুলেট ও বোমায় এ জনপদের অধিবাসীদের জীবন ক্ষতবিক্ষত। সর্বশেষ যে ঘটনাটি ফের কাশ্মিরকে নাড়া দিয়েছে, তা ১৪ ফেব্রুয়ারি। ভারত অধিকৃত কাশ্মিরের পুলওয়ামায় আদিল আহমেদ দার নামে এক যুবকের গাড়িতে ৩৫০ কেজি আরডিএক্স ভর্তি করে দুই হাজার ৫০০ ভারতীয় আধা সামরিক বাহিনী বহনকারী গাড়িবহরে যখন আঘাত হানে, তখনই ঘটে ভারতের স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সেনা প্রাণহানির ঘটনা; যাতে ৪৯ ভারতীয় সেনা মারা যায়। জয়েশ-ই-মুহাম্মদ এ হামলার দায় স্বীকার করেছে।
এ আত্মঘাতী হামলার পর ভারতজুড়ে শুরু হয়েছে জঙ্গিবিরোধী তৎপরতা। চলছে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের এক নোংরা খেলা। বিশ্বের ছোট-বড় বেশির ভাগ দেশ সমস্বরে ভারতের পাসে থেকে এ সন্ত্রাসবাদের মোকাবেলা চায়। বর্তমান পৃথিবীর এ মুহূর্তের বড় সমস্যা সন্ত্রাস এবং তা থেকে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ। তাই এটি প্রতিহত করতে হবে। এ দাবিতে সোচ্চার জাতিসঙ্ঘের প্রায় প্রতিটি সদস্য দেশ।
এবারের ঘটনাকে নাটকীয় মোড় দিতে প্রথম থেকেই চেষ্টা করছে দেশ দু’টি। ভারত নাটকের প্রথম দৃশ্যে ২৬ ফেব্রুয়ারি ভোর ৩টায় পাকিস্তানে বিমান হামলা চালায়। ভারতীয় গণমাধ্যমের দাবি ছিল, ওই হামলায় প্রায় ৩০০ জঙ্গি নিহত হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক খবরে জানা যায়, ভারতীয় হামলায় কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। উপরন্তু পাকিস্তানের হাতে আটক হন ভারতীয় যুদ্ধবিমানের এক পাইলট। সাত দশক ধরে চলা কাশ্মিরিদের স্বাধিকার আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদ তকমা দেয়ার নাটকের এবারের পর্বটি বেশ উত্তেজনাকর। যৌথ পরিচালক ভারত ও পাকিস্তান। দর্শক জাতিসঙ্ঘসহ দুনিয়ার তাবৎ ছোট-বড় মানবাধিকার সংগঠন। নাট্যমঞ্চ কাশ্মির আর এর নিরীহ অধিবাসী।
ঐতিহাসিকভাবে কাশ্মির সমস্যার বীজ বপন করে এক সময়ের সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বমোড়ল অনেক ভূখণ্ডের স্বাধীনতা হরণকারী দখলদার ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান আর ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতার আগেই কাশ্মির নিয়ে বিতর্কের সূচনা। ‘ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট’ নামে ব্রিটিশ ভারতবিভক্তির যে পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিল, তাতে বলা হয়- কাশ্মির ইচ্ছে অনুযায়ী ভারত অথবা পাকিস্তান, যেকোনো অংশে যোগ দিতে পারবে। কাশ্মিরের তৎকালীন হিন্দু মহারাজা হরি সিং চান ভারতে যোগ দিতে। অন্য দিকে পশ্চিম জম্মু ও গিলগিট-বালটিস্তানের মুসলিমদের ইচ্ছা পাকিস্তানের সাথে একীভূত হতে। ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে হরি সিং ভারতে যোগ দেয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। একই সাথে পান ভারতের সামরিক সহায়তা। পরিণামে ১৯৪৭ সালেই শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, যা চলে প্রায় দুই বছর। নিরাপত্তা পরিষদে ১৯৪৮ সালে কাশ্মির প্রসঙ্গ উত্থাপন করে ভারত। জাতিসঙ্ঘের ৪৭ নম্বর প্রস্তাবে কাশ্মিরে গণভোট, পাকিস্তানের সেনা প্রত্যাহার এবং ভারতের সামরিক উপস্থিতি ন্যূনতম পর্যায়ে কমিয়ে আনতে আহ্বান জানানো হয়। কাশ্মিরে যুদ্ধবিরতি বলবৎ হয় ১৯৪৮ সালে। পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করে। তখন থেকেই কাশ্মির কার্যত পাকিস্তান ও ভারত নিয়ন্ত্রিত দুই অংশে ভাগ হয়ে যায়।
স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু এক চিঠি ও ভাষণে বহুবার বলেছেন, কাশ্মিরের মালিক কাশ্মিরি জনগণ। তারাই সিদ্ধান্ত নেবে, কাদের সাথে তারা থাকবে। ১৯৫৫ সালের ৩১ মার্চে লোকসভায় দেয়া এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘কাশ্মির কোনো বিনিময়ের বস্তু নয়, যা ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে; বরং কাশ্মিরের প্রাণ রয়েছে। রয়েছে পৃথক সত্তা। কাশ্মিরি জনগণের সদিচ্ছা ও মতামত ছাড়া কিছুই করা যাবে না।’
ঐতিহাসিক বাস্তবতা হলো, নেহরুর রাজনৈতিক অবস্থান পরবর্তীকালে কার্যকর হতে দেখা যায়নি ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতিতে। কাশ্মিরিদের গণভোটের আশ্বাস দেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি, বরং দিনকে দিন কাশ্মির পরিবেষ্টিত হয়েছে লাখ লাখ সেনা সদস্যে। হয়ে উঠেছে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধক্ষেত্র। তাতে প্রাণ হারিয়েছে লাখো মানুষ, যা এখনো অব্যাহত। অন্য দিকে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কাশ্মিরের আকসাই-চীন অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয় বেইজিং। এর পরের বছর পাকিস্তান-কাশ্মিরের ট্রান্স-কারাকোরাম অঞ্চলটি চীনের হাতে ছেড়ে দেয়। সেই থেকে কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তান, ভারত ও চীন- এ তিন দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে আছে।
দ্বিতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয় ১৯৬৫ সালে। উভয় দেশ তাসখন্দ চুক্তি করে যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষর করে। ১৯৭২-এর সিমলা চুক্তির মধ্য দিয়ে বর্তমানের ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ বা নিয়ন্ত্রণরেখা চূড়ান্ত রূপ পায়। ১৯৮৪ সালে ভারত সিয়াচেন হিমবাহ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়, যা নিয়ন্ত্রণরেখা দিয়ে চিহ্নিত নয়। তা ছাড়া, ১৯৯৯ সালে ভারতীয় বাহিনী আরেকটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু তিক্ত লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে। স্বাধীনতার দাবিতে সাধারণ কাশ্মিরিরা সোচ্চার হন আশি দশকের শেষ দিক থেকে। প্রেরণা জুগিয়েছে ভারতীয় দখলদার বাহিনীর প্রতিনিয়ত অত্যাচার। তার বিরুদ্ধে কাশ্মিরিদের বাধ্য করেছে মারি নয় মরি অবস্থা গ্রহণে। কাশ্মিরে স্বাধিকারের দাবি জোরদার হয় ১৯৮৭ সালে বিতর্কিত স্থানীয় নির্বাচনের পর জেকেএলএফ নামে সংগঠনের উত্থানের মধ্য দিয়ে। ভারতের অভিযোগ, সীমান্তের ওপার থেকে পাকিস্তান যোদ্ধাদের পাঠাচ্ছে, তবে ইসলামাবাদ তা অস্বীকার করে। ১৯৮৯ সালের পর থেকে কাশ্মিরে সহিংস আন্দোলন নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ১৯৯০-পরবর্তী ভারতীয় বাহিনীর নিষ্ঠুরতা দিন দিন বাড়তে থাকে। তা এখনো অব্যাহত। ভারত ও পাকিস্তানের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রেই কাশ্মিরের রয়েছে চরম অসন্তোষ। এই অসন্তোষ প্রশমনে কোনো দেশই উল্লেখযোগ্য কিছু করেনি।
ভারত সরকারের ভাষ্য মতে, কাশ্মিরে প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার ভারতীয় সেনা মোতায়েন হয়েছে। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা প্রায় আট লাখ। অথচ কাশ্মিরে মোট লোকসংখ্যা মাত্র এক কোটি ২০ লাখ। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, আট লাখ সেনা সদস্য মোতায়েন কী জন্য? স্বাধীনতাকামীদের হেনস্তা করতে ভারতীয় বাহিনী ২০১০ সাল থেকে ব্যবহার করছে নিষিদ্ধ পেলেট গান। ফলে অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্ববরণ করছে অসংখ্য নিরীহ কাশ্মিরি।
কাশ্মিরি গণমাধ্যমে প্রকাশিত কাশ্মির সরকারের এক তথ্যানুসারে, ২০১৭ সালে ৮ শতাধিক কাশ্মিরি চোখে আঘাত পেয়েছিলেন। ২০১৮ সালে ভারতীয় বাহিনীর হামলায় অন্তত ৪১৩ জন নিহত হন। ২০১৭ সালে ১২ শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুর চোখে ছররার গুলি লাগে। যাদের মধ্যে শতাধিক কাশ্মিরির এক বা উভয় চোখ অন্ধ হয়ে যায়। কথায় কথায় কারফিউ, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি আর নিরাপত্তা অভিযানের নামে নাগরিক হয়রানি চলছেই। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশে আছে নিষেধাজ্ঞার খড়গ। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এমন নিদারুণ যন্ত্রণার অবসান চায় কাশ্মিরিরা। আর এ কঠোর দমনপীড়নের তোপে দিনে দিনে দ্রোহী হয়ে উঠছেন কাশ্মিরের বাসিন্দারা। কাশ্মিরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির বরাতে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানায়, ২০১৬ সালে তরুণদের উগ্রপন্থায় যুক্ত হওয়ার হার ৪৪ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৭ সালে ১২৬ তরুণ জঙ্গিগোষ্ঠীতে যোগ দেয়।
মানবাধিকার কর্মীদের দাবি, ১৯৪৭ সালের পর থেকে অন্তত পাঁচ লাখ কাশ্মিরি নিহত হয়েছেন; বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ১০ লাখের মতো। ভারতের সরকারি তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছিল, ১৯৯০ সাল থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ১১ বছরে ৪৩ হাজার ৪৬০ কাশ্মিরি নিহত হয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক। এবারের আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী আদিল আহমেদ দারের মায়ের বরাতে জানা যায়, তাকে ভারতীয় সেনারা ২০১৬ সালে উড়ি হত্যাকাণ্ড নিয়ে নির্যাতন করেছিল। সেই অত্যাচারের কিছু দিন পরই সে বাড়িছাড়া হয়। এক বছর পর সে যখন ফিরে আসে তখন ফের এক দুঃসহ যন্ত্রণাময় বার্তা নিয়ে এলো।
কাশ্মির সঙ্কট নিরসনে ভারত কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু তা কখনোই আলোর মুখ দেখেনি। যেমনটি লিখেছেন ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অমূল্য গাঙ্গুলী। কাশ্মির সঙ্কট নিরসনে ভারত সরকার ২০১০ সালে টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদক ড. দিলীপ পাজোঙ্কারের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির সুপারিশগুলো ছিল- ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতিকে দৃষ্টিসীমার বাইরে রাখা, মানবাধিকার হরণের অভিযোগগুলোর তদন্ত করা, আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্টের (এএফএসপিএ) আওতায় নিরাপত্তা বাহিনীকে দেয়া ক্ষমতার সীমা পুনর্মূল্যায়ন করা এবং ‘ডিস্টার্বড এরিয়াস অ্যাক্ট’ বাতিল করা।
কাশ্মিরিদের মন জয়ের উদ্যোগ হিসেবে নেয়া এসব সুপারিশের বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জম্মু ও কাশ্মিরে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের সমন্বিত তদন্তে ভারত সরকারের উচিত এইচআরডব্লিউর সাথে কাজ করা। কিন্তু তা আজো শুরু হয়নি। সেই ১৯৪৮-এ যে গণভোট হওয়ার কথা ছিল, তা আজো হয়নি। বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে জাতিসঙ্ঘের অপারগতা, নীরবতা ও পক্ষপাতিত্বতা। কাশ্মিরিদের এ মানবাধিকার রক্ষার্থে কি বিশ্বের কেউ কোনো ভূমিকা রাখবে না? এ প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। এর উত্তর দিতে হবে দুনিয়ার বড় বড় মানবাধিকার সংগঠনকে।
সাধারণ কাশ্মিরিরা, যারা কাশ্মির উপত্যকা, জম্মু, শ্রীনগর, লাদাখ ও আজাদ কাশ্মিরে বাস করেন, তাদের কথা তো কেউ কখনো বলছে না। তারা আসলে কী চায়, এ প্রশ্ন কেউ করছে না। যে স্বাধিকার আন্দোলনের জন্য তারা হামলার শিকার হচ্ছে এবং প্রতিবাদে চোরাগোপ্তা হামলা করছে, এই স্বাধিকারকে অস্বীকার করার অধিকার তো কোনো জাতির থাকতে পারে না। যে ভারত বা পাকিস্তান আজ কাশ্মির ইস্যু নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করছে, সেই ভারত-পাকিস্তানকে ১৯০ বছর ব্রিটিশ শাসনের পরাধীনতার ঘানি টানতে হয়েছিল। স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের মূল্য তাদের সবচেয়ে ভালো বোঝার কথা। তাহলে কী করে এ দু’টি জাতি আরেকটি জাতিগোষ্ঠীর স্বাধিকারকে এভাবে পদদলিত করছে? বন্ধ হোক কাশ্মিরিদের রক্ত নিয়ে হোলি খেলা।
লেখক : শিক্ষক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
mehedihasan@ku.ac.bd