এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান অব্যাহতভাবে দুর্বল হচ্ছে। সরকারি হিসাবেই গত ১০ বছরে ডলারের তুলনায় টাকার মান কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ। পাশাপাশি বাজারে সরবরাহ সংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাজারে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবুও বাজার স্থিতিশীল না হয়ে বাড়ছে ডলারের দাম। কমছে টাকার মান। এতে লেনদেনের ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কমে গেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও।
মুদ্রা বিনিময় হারের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেড়ে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। আমদানি বাড়ায় বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। সেই চাহিদার জোগান দিয়ে বাজার স্থিতিশীল রাখতেই ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে অর্থাৎ জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ১৬৬ কোটি ডলার ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্যদিকে রেমিট্যান্স আয়েও আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। বিদেশি ঋণের সুদহারও এখন বাড়তির দিকে। এসব ঋণ এখন পরিশোধ করায় চাপ পড়ছে ডলারের ওপর।
ব্যাংকাররা বলেন, প্রতিনিয়ত বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। চাহিদা অনুযায়ী ডলারও দিতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে দাম বেড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া আগের বছরে ব্যাপকহারে আমদানি হওয়ায় এখন ডলার সংকট হচ্ছে। শিগগিরই অবস্থার উন্নতি হবে। তবে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম বেড়েছে। কয়েকদিনের ব্যবধানে প্রতি ডলারে ৫ পয়সা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৮৪ টাকা ১৫ পয়সায়। গত মাসের শেষদিকেও প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৪ টাকা ১০ পয়সা। গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের দাম ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সা মূল্য বেঁধে দেয়। এরপর থেকে পর্যায়ক্রমে ডলারের দাম বাড়ছে। তবে এক রকম ঘোষণা দিয়ে আরেক দামে ডলার বিক্রির অভিযোগ রয়েছে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে। এর আগে মিথ্যা ঘোষণা দেয়ার দায়ে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী বেশিরভাগ ব্যাংককে সতর্ক করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
ডলার বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। আর ডলার বিক্রি করায় কমে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বর্তমানে রিজার্ভ কমে প্রায় ৩ হাজার ১০০ কোটি (৩১ বিলিয়ন) ডলার হয়ে গেছে। যেখানে গত বছর একই সময়ে ৩ হাজার ২২৭ কোটি (৩২ বিলিয়ন) ডলার ছিল।
গত বছরের ২১শে মে থেকে ডলার ৮৩ টাকা ৭০ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল। পরে ২৮ জুন থেকে ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক ডলারের মূল্য ছিল ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সা। এভাবে পর্যায়ক্রমে বাড়তে বাড়তে এখন ৮৪ টাকা ১৫ পয়সা হয়ে গেছে। এক ব্যাংক অন্য ব্যাংকের কাছে যে দামে ডলার বেচাকেনা করে, তা আন্তঃব্যাংক দাম হিসেবে বিবেচিত। টাকা-ডলার বিনিময় হার গত বছরের একই সময়ে ছিল ৮২ টাকা ৯৬ পয়সা। সে হিসাবে এক বছরে ডলারের দাম ১ টাকা ১৯ পয়সা বেড়েছে। আর ২০১৬ সালের অক্টোবরের প্রথমে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৭৮ টাকা ৪০ পয়সা। সে হিসাবে সে সময়ের তুলনায় ৫ টাকা ৭৫ পয়সা বেড়েছে। আন্তঃব্যাংক লেনদেনের বাইরে কার্ব মার্কেটে (খোলা বাজারে) ডলারের দাম আরো বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতি ডলারের বিনিময়ে পাওয়া যেত ৬৯ টাকা। আর এ বছরের ফেব্রুয়ারি জুড়ে প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ৮৪ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৮৪ টাকা ১৫ পয়সা দরে। এই হার এক বছর আগের তুলনায় ১ টাকা ২২ পয়সা বেশি। অথচ দুই বছর আগেও ২০১৭ সালের শুরুর দিকে প্রতি ডলারের মূল্যমান ছিল ৭৯ টাকা ৭৫ পয়সা। তবে ব্যাংকের বাইরে প্রতি ডলার ৮৬ টাকারও বেশি দরে বিক্রি হয়েছে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শুধু ডলারের তুলনায় নয়, আন্তর্জাতিক অন্য মুদ্রার তুলনায়ও কমছে টাকার মান। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্যের মুদ্রা পাউন্ড স্টার্লিং, প্রধান ইউরোপীয় দেশগুলোর সমন্বিত মুদ্রা ইউরো এবং চীনের মুদ্রা ইউয়ান। তবে ভারতীয় মুদ্রা রুপির তুলনায় টাকার মূল্যমান মোটামুটি স্থিতিশীল আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, রেমিট্যান্স আয়ে প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত হচ্ছে না। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৭৪৯ কোটি ৬৭ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বাংলাদেশি প্রবাসীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে বিপুল আমদানির কারণেই রিজার্ভ এখন কিছুটা কম, ডলারের দামেও অস্থিরতা। তবে এ অবস্থা থাকবে না।