সাজ্জাদুল হাসান : এ খাতটিকে কেউ বলেন অপ্রাতিষ্ঠানিক, কেউ বা আবার আখ্যা দেন অসংগঠিত হিসেবে, অনেকের মতে এটি অনানুষ্ঠানিক খাত। ব্যাকরণ মতে, যে একুশটি খাঁটি বাংলা উপসর্গ রয়েছে “অ” তার মধ্যে অন্যতম। কোনও কোনও শব্দের পূর্বে এই ‘অ’ উপসর্গ যুক্ত হলে তা নেতিবাচক অর্থ প্রকাশ করে, যেমন: অসৌজন্য, অধৈর্য্য ইত্যাদি। অপ্রাতিষ্ঠানিক বা অসংগঠিত এই শব্দ গুলো অনেকটাই সেরকম – শ্রীহীন, বড্ড মলিন। অথচ বাংলাদেশের অর্থনীতির বিস্ময়কর অগ্রযাত্রায় এই খাতটি যে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে তা এক কথায় অসাধারণ। রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প, কিংবা সেবা খাত, কখনো বা ওষুধ শিল্পের অবদান নিয়ে যতটা হৈচৈ হয় তার সিঁকি ভাগও স্বীকৃতি মেলেনা দুর্ভাগা এই খাতের।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৮৯ শতাংশ শ্রমশক্তি নিয়োজিত আছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। মাত্র ১১ ভাগ মানুষ কাজ করেন তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক খাতে। টেকসই অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম উদ্দেশ্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। আর এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি নীরবে করে যাচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘শ্রমশক্তি জরিপ’ অনুযায়ী ২০১০ সালে অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের হার ছিল ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ ২০০০ সালে এ হার ছিল প্রায় ৭৫ শতাংশ। আনুষ্ঠানিক খাতে ২০০০ সালে যেখানে প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ কাজ করতেন, ২০১৮ সালে তা কমে গিয়ে দাঁড়ায় মাত্র ১১ শতাংশে! কর্মসংস্থান ছাড়াও মোট দেশজ উৎপাদনেও (জিডিপি) এই খাতের অবদান নিতান্ত কম নয় – প্রায় ৪০ শতাংশ।
বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুসারে, “অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত অর্থ: এইরূপ বেসরকারী খাত যেখানে কর্মরত শ্রমিকের কাজের বা চাকুরীর শর্ত, ইত্যাদি বিদ্যমান শ্রম আইন ও তদাধীন প্রণীত বিধি-বিধানের আওতায় নির্ধারিত কিংবা নিয়ন্ত্রিত নহে এবং যেখানে কর্মরত শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত।”
এই খাতটিকে মূলত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়:
১. এক ব্যক্তি পরিচালিত ব্যবসা যেখানে কোনো শ্রমিক বা কর্মচারী নেই; থাকলেও তারা অবৈতনিক। সাধারণতঃ পরিবারের কোনো সদস্য বিনা বেতনে শ্রম দিয়ে থাকেন।
২. ক্ষুদ্র ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মালিক এবং ঐসকল প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক বা কর্মচারী বৃন্দ।
৩. চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক, গৃহকর্মী ইত্যাদি।
আমাদের দেশে কৃষি, মৎস্য চাষ ও প্রক্রিয়াকরণ, নির্মাণ কাজ, হকার, চাতাল, সেলাই কাজ, ওয়েল্ডিং, তাঁত, বিড়ি কারখানা, প্রিন্টিং, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান, ইটভাটা, গৃহস্থালি কর্ম, ক্ষুদ্র কারখানা প্রভৃতি খাতকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত হিসেবে গণ্য করা হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপের তথ্য মতে, দেশে মোট শ্রমশক্তির সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি ৩৫ লক্ষ। এর মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত আছে প্রায় ৫ কোটি ৬৫ লক্ষ। দুঃখজনক হলেও এটাই নিষ্ঠুর সত্য, এই বিশাল শ্রমিক গোষ্ঠীর নেই কোনও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি! বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরা ন্যূনতম অধিকার থেকে বঞ্চিত।
দেশে কর্মরত শ্রমশক্তির প্রায় ৩৯ শতাংশ নিয়োজিত আছে কৃষি খাতে। বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতি এবং সর্বোপরি এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা বিধানে কৃষি খাত যে অনন্যসাধারণ অবদান রেখে চলেছে তা নজিরবিহীন। অথচ এখানে কর্মরত শ্রমশক্তির ৯৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক!
কৃষির পরেই কর্মসংস্থানের দৃষ্টিকোণ থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হচ্ছে সেবা খাত। অনধিক ২ কোটি ৩৭ লাখ শ্রমিক কর্মরত আছে এই খাতে। তারপরের স্থান শিল্প খাতের যেখানে কাজ করে প্রায় ১ কোটি ২৪ লাখ শ্রমিক। ‘শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭’ এর তথ্য অনুযায়ী সেবা খাতে কর্মরত শ্রমশক্তির প্রায় ৭২ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক অন্যদিকে শিল্প খাতে এই সংখ্যা আরও উদ্বেগজনক প্রায় ৯০ শতাংশ।
এ কথা অনস্বীকার্য যে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে মুখ্য অবদান রেখে চলেছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। বিগত দশ বছরে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারি খাতের অবদান মাত্র ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। পক্ষান্তরে ৯৫ শতাংশের বেশি কর্মসংস্থান হয়েছে বেসরকারি খাতে যার মধ্যে প্রায় ৮১ শতাংশ অবদান অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাম্প্রতিক এক উপস্থাপনায় বলা হয়েছে, দেশে প্রতিবছর গড়ে ১৩ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে। আগামী পাঁচ বছর অর্থাৎ ২০২৩ সাল অবধি বছরপ্রতি অনধিক ২১ লাখ তরুণ-তরুণী শ্রম বাজারে প্রবেশ করবে। অর্থাৎ প্রতিবছর প্রায় আট লাখ বেকার তরুণ-তরুণী যুক্ত হবে শ্রমবাজারে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে আগামী দিনের অর্থনীতির অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা এ খাতে কর্মরত বিপুল সংখ্যক মানুষ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। যেহেতু তারা শ্রম আইনের আওতা বহিৰ্ভূত, সে কারণে অনেক ক্ষেত্রে তারা বঞ্চিত হয় নূন্যতম অধিকার থেকেও। এ সমস্যা গুলোর মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে:
১) কর্মঘণ্টা: অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনও নিয়ম নীতির বালাই নেই। কাজ করতে হয় আট ঘণ্টা থেকে অনেক বেশি। তার বিনিময়ে বাড়তি কোনও মজুরি দেওয়া হয় না। শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) গবেষণায় ভয়াবহ এক চিত্র ফুটে উঠেছে: দেশের হোটেল ও রেস্তোরাঁর কর্মরত ৪২ শতাংশের বেশি শ্রমিক দৈনিক ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা কাজ করেন। ১১ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন ৪০ শতাংশ শ্রমিক। বাকিদের ১১ থেকে ১২ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে ২৬ শতাংশ শ্রমিক নিয়মিত কর্মবিরতি ছাড়াই কাজ করেন। অন্যান্য সেক্টরেও অবস্থা মোটামুটি একই রকমের।
২) নিয়োগ পত্র: বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিয়োগ পত্র দেয়া হয় না। যে কারণে অনেক সময় লক্ষ্য করা যায়, ক্ষতিপূরণ প্রদান না করে বা বিনা নোটিশে বরখাস্ত করা হয় নিরীহ শ্রমিকদের।
৩) ন্যূনতম মজুরি: মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে যেহেতু কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শ্রমিকরা বঞ্চিত হন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে অবস্থা দারুণ নাজুক। চা বাগান ও চা প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, চালকল, রাবার শিল্প সহ বেশ কয়েকটি সেক্টরে কর্মরত শ্রমিকদের প্রাপ্ত মজুরি ভয়াবহ রকমের কম।
৪) অনিরাপদ কর্ম পরিবেশ: বেশ ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে হয় এ খাতে কর্মরত অধিকাংশ শ্রমিককে।
৫) সুরক্ষা সুবিধা: স্বাস্থ্য বীমা, অবসর পরবর্তী ভাতা যেমন প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচুইটি বা পেনশন এর মতো সুরক্ষা সুবিধা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই থাকে অনুপস্থিত।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রতি সরকারের অনতিবিলম্বে সুদৃষ্টি দিতে হবে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসতে হবে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই খাতকে। সর্বাগ্রে প্রয়োজন একটি আইনি কাঠামো যার মধ্যে দিয়ে স্বীকৃতি মিলবে এই খাতের এবং একই সঙ্গে এই খাতে কর্মরত বিপুল সংখ্যক শ্রমশক্তির ন্যূনতম অধিকার নিশ্চিত করতে যা পালন করবে রক্ষাকবচের ভূমিকা।
কার্যকরী প্রশিক্ষণ, সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, বিভিন্ন ধরণের আর্থিক এবং সামাজিক প্রণোদনা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত আসুক প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায়, অসংগঠিত শ্রমশক্তি অর্জন করুক সংঘটিত হওয়ার অধিকার, অনানুষ্ঠানিক তকমা ঝেড়ে ফেলে তারা শামিল হোক আনুষ্ঠানিক খাতের কাতারে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাক তার অভিষ্ঠ লক্ষ্যে। সূত্র : বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম