অ্যালেক্সি খেলবনিকভ : রাশিয়ার সোচি শহরে সিরিয়া নিয়ে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইরান ও তুরস্ক আরও একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করল। কিন্তু এবারের বৈঠকও কোনো সাফল্য বা বিস্ময় সৃষ্টি করেনি, কেবল সিরিয়ায় বিদ্যমান সমস্যা, চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকির বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এই শীর্ষ বৈঠকের আগে তিনটি বড় ঘটনা ঘটেছে, যা আলোচ্যসূচিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।
প্রথমটি ছিল ইদলিব অঞ্চলে নতুন একটি অ-সামরিকীকৃত এলাকা বা বাফার জোন ঘোষণার ব্যাপারে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর। গত সেপ্টেম্বরে এই চুক্তি হয়, কিন্তু তা সিরিয়ার এই প্রদেশের পরিস্থিতির কোনো উন্নয়ন ঘটায়নি। বরং আল–কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) যোদ্ধারা মধ্যপন্থী বিরোধী দলগুলোর ওপর দমনপীড়ন শুরু করে। এর ফলে ওই চুক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মস্কো ও আঙ্কারার মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দেয়।
দ্বিতীয় বড় ঘটনাটি হচ্ছে সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণা। গত ডিসেম্বর মাসে দেওয়া এ ঘোষণা সিরিয়া যুদ্ধের জটিলতায় আরেকটি স্তর যোগ করে এবং কুর্দি যোদ্ধা ও ফোরাত নদীর পূর্ব অংশের ভাগ্যের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে রাশিয়া, তুরস্ক ও ইরানকে ব্যাপক অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়।
তৃতীয় ঘটনাটি ছিল একটি সাংবিধানিক কমিটি গঠনের বিষয়ে তিনটি দেশের ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারা। এটাকেই এখন সিরিয়ার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রধান বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইদলিবের পরিস্থিতি সম্পর্কে সোচি শীর্ষ সম্মেলনে স্পষ্ট কোনো কিছু বলা হয়নি। সিরিয়ার সব অঞ্চলকে দামেস্কের নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনার জন্য রাশিয়া তার চাপ অব্যাহত রেখেছে, যার ফলে তুরস্কের পক্ষে আলোচনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
Eprothom Aloসাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইদলিবে সিরিয়ার বিরোধী গোষ্ঠীগুলো যেমন তুরস্কভিত্তিক ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট ক্রমেই দুর্বল হয়েছে। এর ফলে প্রদেশটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা হায়াত আল তাহরির আল–শামের (এইচটিএস) পক্ষে সহজ হয়েছে। অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো যেমন আহরার আল-শাম, সুকুর আল-শাম, নুরেদ্দিন আল-জিঙ্কিও এইচটিএসের হাতে পরাজিত হয়েছে। তাদের অনেকে তুরস্কনিয়ন্ত্রিত আলেপ্পো প্রদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। এর ফলে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে স্বাক্ষরিত ইদলিব চুক্তিটি খুব একটা পাত্তা পায়নি। যদিও মস্কো জোর দিয়ে বলেছে যে তারা চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কিন্তু একই সঙ্গে বলছে যে এই চুক্তির বাস্তবায়ন করা যাবে না। কারণ, সন্ত্রাসী হুমকি একটি বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছেছে।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে রুশ সরকারের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ ইদলিব নিয়ে রাশিয়া-তুরস্কের আলোচনার নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইদলিবে যখন একটি সামরিক অভিযানের প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন এটা স্পষ্ট হয়নি যে কে এই অভিযান চালাবে—তুরস্ক নাকি অন্য কোনো দেশ? চুক্তিটির বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই সিরিয়ার আলেপ্পোতে রাশিয়া পরিচালিত খেমেইমিম বিমানঘাঁটিতে কোনো ধরনের হামলা চালানো উচিত হবে না। এখন মনে হচ্ছে, ইদলিবে সামরিক অভিযান এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র এবং এর ফলে প্রদেশটি সিরিয়া সরকারের নিয়ন্ত্রণে ফিরে আসবে। অন্যদিকে সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার পর তুরস্ক ফোরাত নদীর পূর্বাঞ্চলে কুর্দি অধিকৃত এলাকা এবং তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্ত অঞ্চলে তাদের মনোযোগ নিবদ্ধ করেছে। এর পাশাপাশি আঙ্কারা তার প্রধান লক্ষ্য পূরণের চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে, আর সেটা হচ্ছে তুরস্কে বসবাসরত সিরীয় শরণার্থীদের তাদের দেশে তুরস্কনিয়ন্ত্রিত নিরাপদ এলাকায় পুনরায় বসবাসের ব্যবস্থা করা। এটা এখনো অস্পষ্ট রয়ে গেছে যে তুরস্ক ফোরাত নদীর পূর্বাংশে ঠিক কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। মার্কিন সেনারা এখনো সেখানে অবস্থান করছে এবং ইঙ্গিত দিয়েছে যে নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে তারা কুর্দিদের ছেড়ে যাবে না। এটা স্পষ্ট যে জড়িত সব পক্ষকে কুর্দি-অধিকৃত এলাকার ব্যাপারে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে হবে। জড়িত সব পক্ষের জন্য এটা সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ।
যদিও আঙ্কারা, মস্কো ও তেহরান সিরিয়া থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছে, কিন্তু তারা এখনো এ ব্যাপারে সন্দিহান যে কীভাবে এটা ঘটবে। এই অনিশ্চয়তা সিরিয়ার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে যেমন ফোরাত নদীর পূর্বাঞ্চলের ভাগ্য থেকে শুরু করে দেশটির ওপর ইরানের প্রভাব ইত্যাদি বিষয়ের ওপর প্রভাব ফেলছে। তবে এটা ঠিক যে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হলে সিরিয়া এখন যেসব সমস্যা মোকাবিলা করছে, তার ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়বে। ভবিষ্যতে সিরিয়ায় তেহরানের ভূমিকা কী হবে, তা–ও অনেকটা নির্ভর করছে সিরিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের ওপর। সূত্র : প্রথম আলো
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
অ্যালেক্সি খ্লেবনিকভ রাশিয়ান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিলের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ