ড. মাহবুব উল্লাহ্ : দীর্ঘদিন ধরে একনায়কত্ববাদী স্বৈরশাসনের নিগড়ে থাকা আলজেরিয়া ফুঁসে উঠেছে। রাজপথে একের পর এক হাজার হাজার আলজেরিয়ান বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন।
আলজেরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদেল আজিজ বুতেফ্লিকা আসছে এপ্রিলে আবারও প্রেসিডেন্টের পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন। এরই প্রতিক্রিয়ায় আলজেরিয়ায় গণবিক্ষোভ শুরু হয়েছে। মজার ব্যাপার হল, প্রেসিডেন্ট বুতেফ্লিকা বেশ ক’বছর ধরে জনসমক্ষে আসছেন না এবং জাতির উদ্দেশেও কিছু বলছেন না।
কারণ কয়েক বছর আগে তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলেন, এমনকি তার কথা বলার ক্ষমতাও চলে গেছে বলে মনে করা হয়। তার পক্ষ থেকে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছেন তারই এক মুখপাত্র।
জনরোষ লক্ষ করে বুতেফ্লিকার পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, আগামী মাসের নির্বাচনে পঞ্চমবারের জন্য প্রেসিডেন্ট হলেও তিনি পূর্ণ মেয়াদে এ পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন না।
ঘোষণাটি এসেছে ৮২ বছর বয়সী এই প্রেসিডেন্টের নির্বাচনী প্রচারাভিযানের ম্যানেজারের পক্ষ থেকে। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন থেকে এ ঘোষণা দেয়া হয় গত রোববার ৩ মার্চ। এ ঘোষণায় অসুস্থ নেতার পক্ষ থেকে প্রতিজ্ঞা করা হয়, একটি সর্বজনীন জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে কীভাবে পরবর্তী নির্বাচনটি করা যায় তা নির্ধারণ করা হবে, যে নির্বাচনে বুতেফ্লিকা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না।
বুতেফ্লিকা বিশ বছর ক্ষমতাসীন থাকার পর ব্যাপক গণবিক্ষোভের মুখে ঘোষণাটি দেয়া হয়। বুতেফ্লিকা আরও অঙ্গীকার করেছেন তেল উৎপাদনকারী দেশটির সম্পদ বণ্টনে আরও উন্নতি তিনি আনবেন এবং আলজেরিয়াবাসীর জন্য উন্নততর অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করবেন। এসব প্রতিজ্ঞা হালে পানি পায়নি।
হতাশায় ক্ষুব্ধ দেশবাসীকে বিক্ষোভ থেকে নিরস্ত করতে পারেনি। রোববারের অপরাহ্নে শত শত তরুণ আলজিয়ার্সের অডিন স্কয়ারে সমবেত হয়ে বুতেফ্লিকার প্রার্থিতা ঘোষণার নিন্দা জানায়। আলজিয়ার্সের বাইরে ওয়ান, কনস্টেনটাইন ও বুইরাসহ অনেক শহরে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ।
এসব বিক্ষোভ দেখে বোঝা যায় আলজেরিয়ার জনগণ নির্বোধ নয়। জনগণ বিশ্বাস করতে চায় না যে, অদূর ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট বুতেফ্লিকা ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াবেন। তার এ চাতুরি মানে টিকে থাকার জন্য কালক্ষেপণ করা। অবশ্য বুতেফ্লিকার পক্ষ থেকে যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে তাতেই বোঝা যায় শাসক মহল বুঝতে পারছে তাদের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়।
আলজেরিয়ায় এ যাত্রা বিক্ষোভের সূচনা হয় ২২ ফেব্রুয়ারি। একটি সংবাদ সংস্থায় বর্তমান প্রেসিডেন্টের আরও এক মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সংবাদ প্রচারিত হওয়ার দু’সপ্তাহ পর বিক্ষাভ শুরু হয়। ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট বুতেফ্লিকা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
গত সপ্তাহে তিনি ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য সুইজারল্যান্ডে গেছেন বলে জানা যায়। তবে তিনি এখন কোথায় আছেন তা জানা যাচ্ছে না। বুতেফ্লিকা ইচ্ছা করলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে পারতেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে গণজাগরণের মধ্য দিয়েই তাকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হবে। বুতেফ্লিকার ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার কৌশলকে কেউ কেউ তিউনিসিয়ার জাইন আল আবেদীন বিন আলীর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
তিনিও দীর্ঘকাল তিউনিসিয়ার শাসন ক্ষমতায় ছিলেন এবং ২০১১ সালে এক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয় তাকে। এ অভ্যুত্থানের মূলে ছিল জনগণের দারিদ্র্য ও বেকারত্ব। একটি ভ্যানগাড়িতে ফল বিক্রি করতে গিয়ে তিউনিসিয়ার পার্লামেন্টের সামনে ফল বিক্রেতাকে পুলিশি জুলুমের শিকার হতে হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ফল বিক্রেতা তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়, ফলে তার মৃত্যু ঘটে। ফল বিক্রেতার অপরাধ ছিল ভ্যানগাড়িতে ফল বিক্রির লাইসেন্স ছিল না তার। যেসব দেশে গণদারিদ্র্য ও বেকারত্ব থাকে সেসব দেশে মানুষ জীবন-জীবিকার জন্য এ ধরনের কাজ বেছে নেয়। এদের অনেকেরই লাইসেন্স-পারমিট থাকে না। কর প্রদানের দলিলও থাকে না। অর্থনীতিবিদরা এভাবে জীবনযাপনকে অর্থনীতির অনানুষ্ঠানিক খাত বা ইনফরমাল সেক্টর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
এটা একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনগ্রসরতারই বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। রাজধানী ঢাকায় ফুটপাত দখল করে যত রকমের ছোটখাটো ব্যবসা হয় সেগুলোও ইনফরমাল সেক্টরের অংশ। এ ছাড়াও রয়েছে ফেরিওয়ালা, ভ্যানগাড়িওয়ালা, রিকশাওয়ালাসহ নানা কিসিমের মানুষ। একটি দেশের শিল্প খাতে যখন বিনিয়োগ স্থবিরতা দেখা দেয় তখন এ ধরনের ইনফরমাল সেক্টর স্ফীত হতে থাকে। নাগরিকদের পক্ষ থেকে এ খাতে নিয়োজিতদের জঞ্জাল মনে করা হয়। তারা মনে করে ফুটপাতগুলো হবে ছিমছাম এবং পথচারীদের চলার জন্য উন্মুক্ত।
কিন্তু অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল রোগ দারিদ্র্যকে দূর না করে এবং অধিকতর বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করে এ জঞ্জাল থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কথা ইনফরমাল সেক্টরে নিয়োজিতরা দুর্নীতিবাজদের সহায়তায় টিকে থাকে। এ দুর্নীতিবাজ চক্রের মধ্যে রয়েছে মাস্তান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিবর্গ এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা। ইনফরমাল সেক্টরের নানা ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে এ সেক্টরটি জনকল্যাণও সাধন করছে। এদের কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত কম দামে মধ্যবিত্ত ও নিু-মধ্যবিত্তরা প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে পারে।
যানজটে অচল শহরে পাড়া-মহল্লায় ভ্যানগাড়িওয়ালার কাছ থেকে শাকসবজি ও ফলমূল কিনে যাতায়াত ব্যয় সাশ্রয় করা সম্ভব হচ্ছে। এক কথায় সাধারণ মানুষ তাদের দৈনন্দিন ব্যয় হ্রাস করে জীবনচক্রকে নবায়ন করতে পারছে। ইনফরমাল সেক্টর কোনো সমস্যা নয়, এমন কথা কেউ বলবে না। তবে একটি দেশ শিল্পায়িত, সমৃদ্ধ এবং লেনদেনের আনুষ্ঠানিকতাকে উন্নত করেই এ সমস্যার হাত থেকে রেহাই পেতে পারে এবং এ সেক্টরে নিয়োজিতরা বিকল্প কর্মসংস্থানেরও পথ খুঁজে পেতে পারে।
আলজেরিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। আলজেরিয়ার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, বুতেফ্লিকা যদি আবারও নির্বাচন করেন তাহলে তারা সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। তাদের কথা হল আলজেরিয়ার জনগণ তাদের দাবির পক্ষে সুস্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন সাড়া আশা করছে। কিন্তু তাদের শোনানো হচ্ছে অপ্রতিপালিত পুরনো প্রতিশ্রুতি। অবশ্য বুতেফ্লিকা সমর্থক রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বুতেফ্লিকার প্রতিশ্রুতিটি হবে একটি ন্যায্য চুক্তি। কারণ এর ফলে বিরোধী দলগুলো এবং সিভিল সোসাইটির সংগঠনগুলো একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক ট্রানজিশনের জন্য সময় ও সুযোগ পাবে। অথচ সাধারণ মানুষ বলছে, বুতেফ্লিকা আসলে রাজনৈতিক ট্রানজিশন চাচ্ছেন না। যা কিছু তার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তার পুরোটাই ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়।
আলজেরিয়ার প্রাচীন ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ। দুর্ভাগ্যক্রমে ১৮৩০ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত আলজেরিয়া ছিল ফরাসি উপনিবেশ। ১৮৭৫ সাল নাগাদ ফরাসি উপনিবেশবাদীরা পুরো আলজেরিয়া দখল করে নেয়। উপনিবেশিকরণের এ যুদ্ধে ১৮৩০ সাল থেকে সোয়া ৮ লাখ আলজেরিয়াবাসী নিহত হয়। অপরদিকে ১৮৩১ থেকে ১৮৫১-এর মধ্যে ৩,৩৩৬ জন ফরাসি সৈন্য যুদ্ধের মাঠে প্রাণ হারান এবং আরও প্রায় ১ লাখ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ফরাসি উপনিবেশবাদীরা চেয়েছিল আলজেরিয়া হবে ফ্রান্সেরই একটি প্রদেশের মতো। বহু ফরাসি ও ইউরোপীয় আলজেরিয়ায় আবাসন প্রতিষ্ঠা করে।
এদের বলা হতো কোলন। ১৮২৫ থেকে ১৮৪৭-এর মধ্যে ৫০ হাজার ফরাসি নাগরিক আলজেরিয়ায় বসতি স্থাপন করে। এ বসতি স্থাপনকারীদের আলজেরিয়ার গোষ্ঠীবদ্ধ নাগরিকদের জমি বাজেয়াপ্ত করে ফরাসি বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ওরান ও আলজিয়ার্সের মতো শহরগুলোয় জনসংখ্যার প্রধান অংশই ছিল ফরাসি। উপনিবেশিকরণের এ প্রক্রিয়া সম্ভবত ফরাসিদের ক্ষেত্রেই একমাত্র দৃষ্টান্ত। ধীরে ধীরে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষ ধূমায়িত হতে থাকে এবং তা বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার দাবিতে পর্যন্ত পরিণত হয়।
১৯৪৫ সালে ফরাসি সেনাদের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত অভ্যুত্থান ঘটে এবং এ অভ্যুত্থানকে রক্ত সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে দমন করা হয়। ১৯৫৪ সালে আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করা হয় জাতীয় মুক্তফ্রন্টের নেতৃত্বে। এ ফ্রন্ট ফরাসি উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের আকার ধারণ করে। লাখ লাখ আলজেরিয়ান নিহত ও আহত হয়। ইতিহাসবিদ আলিসটেয়ার হর্নে এবং রেমন্ড অ্যারোনের মতে আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহতদের সংখ্যা জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট এবং ফরাসি সরকারের হিসাবের চেয়েও বেশি ছিল। তবে স্বাধীনতা-পরবর্তী আলজেরিয়ান সরকার প্রদত্ত দশ লাখ নিহতের সংখ্যার তুলনায় কম ছিল। হর্নের হিসাব অনুযায়ী ৮ বছরের যুদ্ধে ৭ লাখ লোক প্রাণ হারায়। ২০ লাখেরও অধিক আলজেরীয় বাস্তুচ্যুত হয়। সম্ভবত স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে এ রকম পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
১৯৬২ সালে আলজেরিয়া পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করে। ১৯৬২-এর অভিযান চুক্তি অনুযায়ী সে বছরের জুলাই মাসে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের গণভোটে আলজেরিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়। আলজেরিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন মুক্তিফ্রন্ট নেতা আহমেদ বেন বেল্লা। হুয়ারি বুমেদিনের নেতৃত্বে এক অভ্যুত্থানে বেন বেল্লা ক্ষমতাচ্যুত হন। বুমেদিন ছিলেন বেন বেল্লারই সহযোদ্ধা এবং তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী। বেন বেল্লার নেতৃত্বে আলজেরিয়া উত্তরোত্তর সমাজতান্ত্রিক এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে এগিয়ে যায়। বুমেদিন এ ধারা অব্যাহত রাখেন। আলজেরিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রধানত তেল রফতানির ওপর নির্ভরশীল। ১৯৮০-তে বিশ্বে তেল সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় তেলের দাম পড়ে যায়। আলজেরিয়া কঠিন অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার মধ্যে পড়ে যায়। বুমেদিনের উত্তরাধিকারী প্রেসিডেন্ট শাদলি বেনজাদিদ কিছু উদারনৈতিক অর্থনৈতিক সংস্কার প্রবর্তন করেন। তিনি আলজেরিয়ার আরবীয়করণের নীতি গ্রহণ করেন এবং প্রতিবেশী অন্যান্য দেশ থেকে আরবি শিক্ষার জন্য শিক্ষক নিয়ে আসেন।
ফলে প্রচলিত ইসলামী চিন্তার প্রসার ঘটে এবং কট্টর ইসলামী মতবাদ দানা বাঁধে। মুসলিম গোষ্ঠীগুলো একত্রিত হয়ে Islamic Salvation Front নামে একটি শক্তিশালী দলের আবির্ভাব ঘটায়। ১৯৯১-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে Islamic Salvation Front সরকার গঠন করলে কর্তৃপক্ষ ১১ জানুয়ারি ১৯৯২ হস্তক্ষেপ করে এবং নির্বাচন বাতিল করে দেয়। বেনজাদিদ পদত্যাগ করেন এবং একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কাউন্সিল গঠন করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা প্রয়োগের পথ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। Islamic Salvation Front-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ফলে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। এ গৃহযুদ্ধে ১ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। ফলে আলজেরিয়া আন্তর্জাতিক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯৯ সালে একটি পক্ষপাতমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে আবদেল আজিজ বুতেফ্লিকা প্রেসিডেন্ট ঘোষিত হন। অধিকাংশ বিরোধী দল এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এ নির্বাচনকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে দাবি করেন।
ক্ষমতায় আসার পর বুতেফ্লিকা আলজেরিয়ায় স্থিতিশীলতা আনয়নের জন্য বেসামরিক সহমতের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ উদ্যোগ গণভোটের মাধ্যমে স্বীকৃত হয়। এর ফলে বহু রাজনৈতিক বন্দি ক্ষমা পায় এবং হাজার হাজার সশস্ত্র ব্যক্তি নির্যাতন থেকে রেহাই পায়। তাদের প্রতি আংশিক ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়। সেই থেকে আলজেরিয়ায় বুতেফ্লিকার শাসন অব্যাহত আছে। ২০০৮ সালে সংবিধান সংশোধন করে একজন প্রেসিডেন্ট দুই মেয়াদেরও অধিককাল ক্ষমতায় থাকতে পারবেন বলে সংশোধনী গৃহীত হয়। এর ফলে বুতেফ্লিকা তার ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে পেরেছেন।
২০১০ সালের ডিসেম্বরে আলজেরিয়ায় গণবিক্ষোভ দেখা দেয়। একই সময় আরব বিশ্ব ও উত্তর আফ্রিকাতেও গণবিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১৯ বছরের জরুরি শাসনের অবসান ঘটে। বুতেফ্লিকা অধিকতর সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও বিরোধী গ্রুপগুলো তা মেনে নেয়নি এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গ্রুপগুলোর মতে সংবাদপত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন অব্যাহত থেকেছে। দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আলজেরিয়া স্বাধীনতা অর্জন করলেও সত্যিকার অর্থে কখনই কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে মুক্ত ছিল না। সামরিক বাহিনী ও এলিটদের একটি যৌথ গোষ্ঠী দেশের শাসন ক্ষমতার যন্ত্রগুলো বরাবরই নিয়ন্ত্রণ করেছে। ফলে কর্তৃত্ববাদী শাসন দীর্ঘস্থায়ী হতে পেরেছে। সম্প্রতি সূচিত গণবিক্ষোভ আলজেরিয়াকে কোন পথে নিয়ে যাবে তা বলার সময় হয়নি। তবে মিসরে তাহরির স্কয়ারে যে আরব বসন্তের সূচনা হল তার পরিণতিতে হোসনি মোবারক ক্ষমতা হারালেন। মাঝখানে কিছু সময়ের জন্য একটি নির্বাচিত সরকার মিসরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট মুরসির নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে সেনাপ্রধান আবুল ফাত্তাহ আল সিসি মিসরের সর্বময় ক্ষমতা দখল করে নিয়েছেন। অত্যাচার-নির্যাতনও চলছে নজিরবিহীনভাবে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে- মুসলিম দেশগুলোয় গণতন্ত্র কেন দৃঢ়মূল হতে পারে না? বাংলাদেশও কেন এর ব্যতিক্রম হতে পারছে না? এর জন্য প্রয়োজন গভীর অনুসন্ধান ও গবেষণা।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ