আনু মুহাম্মদ : ১৯৯১ সালে নির্বাচিত সরকারের শাসনামল শুরু হওয়ার পর থেকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি বড় ধরনের পশ্চাদপসরণ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শাসনামলে সরকারি ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য নিশ্চিত করার জন্যই ছাত্র সংসদ নির্বাচন করা হয়নি। হলে হলে সরকারি ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নির্মাণ কাজে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত থেকেছে সরকারি ছাত্র সংগঠন। এই পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে সর্বশেষ এই সরকারের আমলে। বিভিন্ন হলে সিট বণ্টন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজে চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অপরাধ মাত্রাতিরিক্ত আকার নেওয়ার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
এই পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিনের দাবি মানার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ডাকসু নির্বাচন দেওয়া হয়। প্রথম থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের ভূমিকায় এটা স্পষ্ট হয়ে থাকে যে, সরকারি ছাত্র সংগঠন জবরদস্তিমূলকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসী আধিপত্য যারা বজায় রেখেছে, তাদেরকেই বৈধ কর্তৃত্ব দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কাজ করছে। হলে হলে গণরুমে প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীদের থাকতে বাধ্য করে তাদের অসহায়ত্বের সুযোগে ব্যবহার করা হচ্ছে রিজার্ভ আর্মি হিসেবে। ৩০ ডিসেম্বরের কলঙ্কিত নির্বাচনে আমলা, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন এবং সরকারি দল ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনকে একটি প্রহসনে পরিণত করেছে। এর বিরূপ প্রভাব কতটা বিস্তৃত হয়ে পড়েছে, এর প্রমাণ আমাদের সামনে আছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে- এই আশঙ্কা অনেকেই করতে চাননি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকরাও যে পুলিশ, আমলা ও সরকারি দলের ভূমিকায় নামলেন- এটা শিক্ষক হিসেবে লজ্জার বিষয়।
শিক্ষার্থীরা যাতে ভোট দিতে না পারে, সে জন্য কৃত্রিম লাইন করা, আগের রাতে বাক্সে ব্যালট ভরা, হলে হলে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি, হুমকি ও নজরদারি রাখা- এসব কিছুর মধ্য দিয়ে ডাকসু নির্বাচনকে যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে, তা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার শেষ সম্ভাবনার ওপর আঘাত বলে মনে করি। যেসব শিক্ষার্থী প্রতিরোধ করতে পারছেন ততটুকুই আশা এবং ভরসা জেগে রয়েছে। আমরা দেখলাম, মেয়েদের হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধ অনেক শক্তিশালী। কারণ মেয়েদের হলে সরকারি ছাত্র সংগঠন একই মাত্রায় ভয়ের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। ছেলেদের হলে আশ্রয়হীন শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে অস্ত্র প্রদর্শনসহ সহিংসতার মাধ্যমে একটা চরম ভয়ের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে অনেক আগে থেকেই। গণমাধ্যমেও এসব খবর এসেছে।
এর ওপর ভর করেই হলে ভোটকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের আপত্তির মুখেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হলের ভেতরে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে এই নির্বাচন প্রক্রিয়াকেই সুষ্ঠু ও সব শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তারপর শিক্ষার্থীদের ভোট দেওয়া বাধাগ্রস্ত করতে কৃত্রিম লাইন করে রাখা হয়েছে, এটা আগেই বলেছি। অনলাইন-গণমাধ্যমেও এর চিত্র দেখা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে যেসব শিক্ষক যুক্ত তাদের বিরুদ্ধেও ব্যালট বাক্সে আগে থেকেই ব্যালট পেপার ভরা, ভয়ের পরিস্থিতি বজায় রাখা, সরকারি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যোগসাজশ করে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়াকে অস্বচ্ছ করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। এই অভিযোগ শিক্ষকদের জন্য মর্যাদাহানিকর।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে প্রতিবাদ-প্রতিরোধকারীদের বিশ্ববিদ্যালয়কে মাস্তান ও মেরুদণ্ডহীনদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আরও ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষাঙ্গন মাস্তানির জায়গা নয়। শিক্ষাঙ্গন যদি কলুষিত হতে থাকে, তাহলে এর বিরূপ ছায়া গোটা সমাজকেই আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। প্রতিবাদী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। অনৈতিকতার বিরুদ্ধে আরও উচ্চকণ্ঠ হতেই হবে।
অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়