এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে রক্তক্ষয়ী আক্রমণ চালানোর আগে ঘাতক ব্রেন্টন টেরেন্ট নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্দা আরডেনকে নিজের মেনিফেস্টো (কর্মসূচির ঘোষণাপত্র) পাঠিয়েছিলেন। এতে সে শুক্রবারের হামলার কারণ ব্যাখ্যা করে। হামলার দশ মিনিট বা তার কম সময় আগে ই-মেইলের মাধ্যমে ওই বার্তা পাঠানো হয় বলে নিশ্চিত করেছে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডের খবরে বলা হয়েছে, একই ম্যানিফেস্টো পাঠানো হয়েছে নিউজিল্যান্ডের কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের কাছে। প্রধানমন্ত্রীর একজন মুখপাত্র বলেন, যেসব গ্রাহকের কাছে ওই মেইল পাঠানো হয়েছে, তার বেশিরভাগই দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম। তালিকায় রাজনীতিবিদদের মধ্যে রয়েছেন পার্লামেন্টের স্পিকার ট্রেভর মালার্ড ও ন্যাশনাল পার্টির নেতা সাইমন ব্রিজ। মুখপাত্র বলেন, ‘মেইলে সে এই কাজের কারণ উল্লেখ করেছে। কিন্তু কী করতে যাচ্ছে তা বলেনি। তাই এটা রুখে দেয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।’ যে অ্যাকাউন্টে মেইলটি পাঠানো হয়েছে, সেটি প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত না।
তার দপ্তরের কর্মকর্তারা এটি ব্যবহার করেন। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা মেইলে পাঠানো ওই ম্যানিফেস্টো দেখতে পান। তিনি সেটা সংসদীয় নিরাপত্তা বিভাগের কাছে পাঠিয়ে দেন। সেখান থেকে পাঠানো হয় পুলিশের কাছে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওই কর্মকর্তা টেরেন্টের পাঠানো ম্যানিফেস্টো ততটা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেননি। অন্য যাদের কাছে ম্যানিফেস্টো পাঠানো হয়েছে, তারাও এটিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেননি। ফলে ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে টেরেন্টের নির্মম হামলায় প্রাণ হারান ৪৯ মুসল্লি।
প্রসঙ্গত, শুক্রবার ক্রাইস্টচার্চের মসজিদ আল নূর ও লিনউড মসজিদে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিত হামলা চালায় ব্রেনটন টেরেন্ট। শান্ত পায়ে অস্ত্র হাতে নিয়ে মসজিদে ঢুকে সে। এরপর সামনে যাকেই পায় তাকেই গুলি করে । ভেতরে প্রবেশ করে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। গুলি শেষ হয়ে গেলে বারবার ম্যাগাজিন রিলোড করছিল সে। একপর্যায়ে মসজিদের মধ্যে থাকা আহতদের আবারো গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। মসজিদের ভেতরে রক্তের বন্যা বাধিয়ে শান্তভাবে বেরিয়ে আসে হামলাকারী।
তার নৃশংসতার কবল থেকে কয়েক মিনিটের জন্য রক্ষা পেয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়রা। শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করতে তারা ওই সময় গিয়েছিলেন মসজিদে। ভিতরে রক্তে তখন সয়লাব। একজন নারী বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের ভেতরে প্রবেশ করতে বারণ করেন। তার নিষেধেই তড়িঘড়ি করে ওই স্থান ত্যাগ করে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।
ব্রেন্টন টেরেন্ট তার শুক্রবারের রক্তক্ষয়ী হামলার কারণ ম্যানিফেস্টোতে বিস্তারিত তুলে ধরেছে। এতে বলেছে, আরেক সন্ত্রাসী অ্যান্ডার্স ব্রেইভিকের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিউজিল্যান্ডে হামলা চালিয়েছে সে। একই সঙ্গে সে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যিপ এরদোগান এবং লন্ডনের মেয়র সাদেক খানের মৃত্যু কামনা করেছে টেরেস্ট। ওই ম্যানিফেস্টোর নাম দিয়েছে সে ‘দ্য গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’।
মসজিদে হামলাকারীকে আদালতে তোলা হয়েছে: নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে গুলি করে কমপক্ষে ৪৯ জনকে হত্যার প্রধান অভিযুক্ত ব্রেনটন টেরান্টকে আদালতে হাজির করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে একটি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ। শনিবার আদালতে হাজির করার সময় তার পরনে ছিল কয়েদিদের জন্য নির্ধারিত সাদা শার্ট। হাতে ছিল হ্যান্ডকাফ। এ খবর দিয়ে অনলাইন বিবিসি বলেছে, তার বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ আনা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ব্রেনটন টেরান্ট বাদেও আরো দু’জন সন্দেহভাজন হামলাকারী রয়েছে পুলিশি হেফাজতে। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিনদা আরডেন শুক্রবারের ওই হামলাকে উগ্র-সন্ত্রাসী হামলা বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর বলা হয়েছে প্রধান সন্দেহভাজন এই হামলাকারী যে অস্ত্র ব্যবহার করে হামলা চালিয়েছে তা ছিল বৈধ, অর্থাৎ লাইসেন্সকৃত অস্ত্র। আরডেন আরো বলেছেন, যাদেরকে আটক করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আগে থেকে কোনো অপরাধের রেকর্ড নেই।
শুক্রবারের হামলার শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে প্রথম দাউদ নবী নামে একজনের নাম প্রকাশ করেছে তার পরিবার। ৭১ বছর বয়সী নবী ১৯৮০ সালে আফগানিস্তান থেকে নিউজিল্যান্ডে যান। হতাহত অন্যদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। শুক্রবার ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে জুমার নামাজরত শত শত মুসল্লির ওপর ওই হামলা চালায় সশস্ত্র বন্দুকধারী। এতে কয়েকজন জড়িত বলে বলা হয়। হামলায় আহত হয়েছেন ৪৮ জন। তার মধ্যে দুই বছর বয়সী এবং ১৩ বছর বয়সী দুটি শিশুও রয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া এরই মধ্যে জানিয়েছে, হতাহতদের মধ্যে এসব দেশের নাগরিকও রয়েছেন। ক্রাইস্টচার্চে ব্যাপক নিরাপত্তা বিরাজ করছে এবং দেশজুড়ে সকল মসজিদ বন্ধ রয়েছে।
হামলাকারী সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিনদা আরডেন বলেছেন, মসজিদে হামলার এ ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ব্যক্তির পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র এবং একটি লাইসেন্স ছিল। শনিবার তিনি আরো জানিয়েছেন, দেশটির অস্ত্র আইন বদলানো হবে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, হামলাকারীর বন্দুকের লাইসেন্স ছিল এবং সেটি ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে নেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আরডেন বলেছেন, প্রধান সন্দেহভাজন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করেছে এবং নিউজিল্যান্ডে বিক্ষিপ্ত সময় অতিবাহিত করেছে। তার ভাষায়- তাকে আমি দীর্ঘকালীন বাসিন্দা বলবো না। হামলাকারীর বন্দুক লাইসেন্স ছিল। আমাকে জানানো হয়েছে সেটি ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে নেয়া হয়েছে। নিউজিল্যান্ডে গোয়েন্দা সংস্থা উগ্র চরমপন্থিদের বিষয়ে তদন্ত করছে। কিন্তু হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি চরমপন্থার জন্য গোয়েন্দা সমপ্রদায়ের কিংবা পুলিশ কারও নজরেই আসেনি। ওই ব্যক্তি ২০১৭ সালে ইউরোপ ভ্রমণের পর থেকে এই হামলার পরিকল্পনা করছিল এবং সেখানকার ঘটনার প্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল।