অ্যান্ড্রু হিগিনস : ডেনমার্কের নাগরিক ডেনিস ও ক্রিস্টেনসেনকে শুধু ডেহোভা’স উইটনেস মতাদর্শে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে আটক করা হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে ‘উগ্রবাদ’ উসকানোর অভিযোগ আনা হয়েছিল। তাঁর বিচার করা হবে বলে তাঁকে ১৯ মাস ধরে রাশিয়ার জেলে আটকে রাখা হয়েছিল। গত বছরের শেষের দিকে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির ক্রিস্টেনসেনের প্রতি দয়াপরবশ হলেন এবং তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করলেন। গত ডিসেম্বরে ক্রেমলিনে পুতিন ঘোষণা করলেন, শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে কাউকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো ‘সম্পূর্ণ নির্বুদ্ধিতার কাজ’ এবং এটি বন্ধ করতে হবে। তাঁর এ ঘোষণার পর জেহোভা উইটনেস সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রচার কমে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দেখা গেল পুতিনের ঘোষণার পর এই সম্প্রদায়ের লোকদের ধরপাকড় করা আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। এরপর ক্রিস্টেনসেনকে ছাড়া তো হয়ইনি, বিচারে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে তাঁকে ছয় বছরের জেল দেওয়া হয়েছে। গত মাসে সাইবেরিয়ায় জেহোভাস উইটনেস মতবাদে বিশ্বাসীদের গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করার খবরও পাওয়া গেছে।
এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে টানা ১৮ বছর চূড়ান্ত কর্তৃত্ববাদী শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা পুতিন যা বলেন এবং যা বাস্তবে ঘটে তার মধ্যে কতটুকু ফারাক আছে? সমালোচকেরা এবং অনুগতরা এত দিন পুতিনকে বিশ্বের কাছে স্বয়ম্ভূ নেতা হিসেবে যেভাবে তুলে ধরে এসেছেন, পুতিন কি আসলেই ততটা ক্ষমতাবান? তাঁর একক নির্দেশেই কি ক্রেমলিন চলে, নাকি তাঁকে প্রভাবিত করার মতো অনেকেই সেখানে আছেন?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচকদের একটি বিরাট অংশ মনে করে, পুতিনের সহায়তা নিয়েই আজ তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। তবে পুতিনের নিজের দেশের বহু লোক এখন বিশ্বাস করেন, তাঁকে যতটা ক্ষমতাশালী বলে শোনা যায়, আসলে তাঁর হাতে ততটা ক্ষমতা নেই। পুতিনের প্রতিষ্ঠা করা কাউন্সিল ফর সিভিল সোসাইটি অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের সদস্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী একাতেরিনা শুলমান বলেছেন, পুতিনের ক্ষমতা নিয়ে তাঁর সমর্থক ও বিরোধিতাকারীরা বাড়াবাড়ি রকমের অতিরঞ্জন করেছেন। রাশিয়ার মতো বিশাল সাম্রাজ্য তাঁর একক অঙ্গুলিনির্দেশে চলে না। চলে দেশের নির্ধারিত আইন মেনেই। এ কারণে অনেক সময় পুতিন যা বলেন, হয়তো তার উল্টোটা ঘটতে দেখা যায়।
রাশিয়ায় কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তিসম্পন্ন বিরাট একটি মহল আছে। বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা, রাশিয়ান অর্থোডক্স গির্জা, বহু প্রভাবশালী ধনকুবের, প্রভাবশালী কর্মকর্তা আছেন। তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বহু বিষয় রয়েছে, যার বিষয়ে পুতিনকে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করেই পরিস্থিতি সামাল দিতে হয় তাঁকে। বেশির ভাগ পশ্চিমা পুতিনকে যখন টেলিভিশনে দেখেন, তখন তাঁরা তাঁকে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিপতি মনে মনে স্বীকার করে নেন। এর পেছনে কিছু বিষয় কাজ করে থাকে।
১৯৯৯ সালে পুতিন ক্ষমতায় এসে সরকারের সমস্ত অকার্যকর ব্যবস্থাকে ভেঙে দেন। তাঁর পূর্বসূরি বরিস ইয়েলৎসিন মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান করতেন। তাঁর গা ছাড়া ভাবের কারণে প্রশাসন সাংঘাতিকভাবে ঝিমিয়ে পড়েছিল। পুতিন এসেই সেখানে বড় ধরনের ঝাঁকুনি দেন। সরকারি কাজে গতি ফিরে আসে। তবে সব কাজই যে তিনি সফলভাবে শেষ করতে পেরেছেন, তা নয়। তাঁর উদ্যোগে আমুর নদীর ওপর দিয়ে রাশিয়া ও চীনের সংযোগ সেতু তৈরির চেষ্টা হয়েছিল। মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবুর্গের মধ্যে হাইওয়ে বানানোর জন্য পুতিন বিশেষ উদ্যোগও নিয়েছিলেন। সেগুলোর অনেক বড় বড় প্রকল্প স্থির হয়ে আছে। পুতিন সেগুলো এগিয়ে নিতে পারছেন না।
রাশিয়ার সর্ব পূর্বাঞ্চলে পুতিন একটি নতুন রকেট উৎক্ষেপণকেন্দ্র বানাচ্ছেন। যে সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা তা হয়নি, সেখানে দুর্নীতির কারণে কাজের গতি কমে গেছে। প্রকল্পটিতে কাজ করা শ্রমিকেরা মজুরি না পেয়ে ধর্মঘট শুরু করেছেন। মস্কোর প্রসিকিউটর জেনারেলের অফিস থেকে বলা হচ্ছে, এই প্রকল্প থেকে অন্তত ১৫ কোটি ডলার চুরি করা হয়েছে। এক হাজারের বেশি লোক এই প্রকল্পের বারবার আইন লঙ্ঘন করেছেন। তার মানে সেখানকার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা পুতিনের কাছে জবাবদিহি করতে ভয় পাচ্ছেন না। পুতিন তাঁদের দুর্নীতির কথা জানেন কিন্তু সবাইকে চটাতে চান না বলেই সব দিক ‘ম্যানেজ’ করেই তাঁকে চলতে হয়।
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
অ্যান্ড্রু হিগিনস নিউইয়র্ক টাইমস–এর মস্কো সংবাদদাতা