বদরুদ্দীন উমর : মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান এজেন্ট রেজা শাহ পাহলভিকে ১৯৭৯ সালে ইসলামপন্থীরা উৎখাত করার পর থেকেই ইরানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুতার সম্পর্ক।
আমেরিকানরা মনে করেছিল, শাহকে উৎখাতের পর ইরানে ইসলামপন্থীদের শাসন প্রতিষ্ঠা হলেও সেখানে অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে তারা সহজেই আবার নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে শাহকে ইরানে ফিরিয়ে আনবে, যেভাবে প্রথমবার শাহ উৎখাত হওয়ার পর ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে পরাজিত করে তারা শাহকে ১৯৫৩ সালে আবার ক্ষমতায় বসিয়েছিল।
এ উদ্দেশ্যে তারা ১৯৮০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পরম অনুগত মিত্র ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে দিয়ে ইরান আক্রমণ করিয়েছিল এবং ইরাককে এ জন্য অর্থ ও অস্ত্রের প্রভূত জোগান দিয়েছিল।
কিন্তু ইরানের জনগণের দেশপ্রেমের এমনই শক্তি ছিল যে, তারা ঐক্যবদ্ধভাবে সেই মার্কিন আক্রমণ রোধ করেছিল। মহা অমানবিক সেই যুদ্ধ আট বছর স্থায়ী হওয়ার পর কোনো পক্ষের জয় ছাড়াই শেষ হয়েছিল। অবশ্য ইরানকে দখল করার ক্ষেত্রে মার্কিন ব্যর্থতা ছিল ইরানের এক মহা বিজয়।
ইতিমধ্যে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় দুটি ঘটনা ঘটে। প্রথমত, তেহরানে ইরানি ছাত্ররা মার্কিন দূতাবাস দখল করে দূতাবাসের লোকজনকে আটক করে জিম্মি অবস্থায় রাখে। তা সত্ত্বেও অবস্থা এমন ছিল যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইরানের ওপর সামরিক আক্রমণ চালিয়ে দূতাবাস কর্মীদের উদ্ধার করতে পারেনি।
ছাত্ররা দু’বছরের বেশি সময় দূতাবাস দখলে রেখেছিল। পরে আলোচনার মাধ্যমে এ সংকটের অবসান হয় এবং মার্কিন কর্মচারীদের ছেড়ে দেয়া হয়। তারা দেশে ফেরত যায়। ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আগেই কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং দূতাবাস উঠিয়ে দেয়।
দ্বিতীয় ঘটনা খুব চমকপ্রদ। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কত ধূর্ত এবং কত বিপজ্জনক চক্রান্তকারী। সে সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট রেগান ইরাক-ইরান যুদ্ধ চলাকালেই ইরানের কাছে গোপনে অস্ত্র বিক্রি করে এবং সেই অস্ত্র বিক্রির টাকা গোপনে চালান দেয় নিকারাগুয়ার বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মার্কিন সহায়তাপ্রাপ্ত কন্ট্রাদের কাছে।
এতে তাদের কোনো অসুবিধা হয়নি!! কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এই কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র বিক্রির জন্য কতদূর নিচে নামতে পারে সেটা দুনিয়ার কাছে প্রকাশ্য হয়।
ইরাক-ইরান যুদ্ধে বাস্তবত ইরাকের পরাজয় ও পর্যুদস্ত হওয়ার ঘটনার পর মার্কিনের সঙ্গে সাদ্দাম হোসেনের সম্পর্কের অবনতি হয়। তেলের ওপর দখলদারিত্ব নিয়ে তাদের মধ্যে শত্রুতার সৃষ্টি হয়।
এবার তারা কুয়েতের সঙ্গে সাদ্দামের দ্বন্দ্ব তৈরি করে। সাদ্দাম হোসেন কুয়েত আক্রমণ করেন এবং স্বল্পকাল পরেই সে যুদ্ধ শেষ হয়। সে যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কুয়েতের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাদেরকে সাহায্য করে এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুড়ো বুশের সামরিক বাহিনীও ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। সেবার পরিস্থিতি বেশিদূর না গড়ালেও এর পর ইরাক ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে।
পরে জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলে মিথ্যা অজুহাতে ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করে এবং সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেখানে সরাসরি নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। সেই যুদ্ধে তৎকালীন পেন্টাগনের কর্তাব্যক্তি এবং বর্তমানে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিরাপত্তা উপদেষ্টা যুদ্ধবাজ জন বোল্টনের প্রকাশ্য উসকানি ও চক্রান্ত ছিল।
কোনো অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ দেশই যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের ওপর নিজেদের দেশের স্বার্থে নির্ভরশীল থাকতে পারে না, এর প্রমাণই ছিল এসব ঘটনার মধ্যে।
যা হোক, ইরানের বিষয়ে ফিরে এসে বলা যায় যে, ১৯৭৯ সালে তাদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে শত্রুতার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, তা একদিনের জন্যও শিথিল হয়নি। সব সময়েই মার্কিনের শত্রুতা নানা পথ ধরে অগ্রসর হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সর্বপ্রধান সহযোগী হল ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ইসরাইল। ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন-ইসরাইলি যৌথ চক্রান্ত এখনও পর্যন্ত একইভাবে জারি আছে।
ইরান শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য তাদের এক কর্মসূচি অনুযায়ী পারমাণবিক শক্তি গড়ে তোলায় নিযুক্ত আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো প্রমাণ ছাড়াই প্রথম থেকে বলে আসছে যে, ইরানিরা শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের নামে পারমাণবিক বোমা তৈরির কর্মসূচি কার্যকর করছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থা তাদের নিয়মিত পরিদর্শনের কোনো সময়েই এর কোনো প্রমাণ পায়নি।
কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এসবের কোনো মূল্য নেই। তাদের নীতি হল জোর যার মুল্লুক তার। ঠিক এ কাজটিই তারা করেছিল ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের সময় সাদ্দাম হোসেন গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করছেন এই মিথ্যা অভিযোগ এনে।
সে অভিযোগের যে কোনো ভিত্তিই ছিল না এটা প্রমাণিত হয়েছিল যুদ্ধ শেষে। আন্তর্জাতিক পরিদর্শকরা সেখানে এ ধরনের কোনো অস্ত্রের চিহ্ন দেখেননি। এ ধরনের কিছুই সেখানে ছিল না।
ইরান শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যেতে পারবে, এই মর্মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ইরানের এক চুক্তি স্বাক্ষর হয় ২০১৫ সালে। আন্তর্জাতিক পারমাণবিক এনার্জি এজেন্সি নিয়মিত পরিদর্শন করে সব সময়ই রিপোর্ট দেয় যে ইরান চুক্তির সব শর্ত সর্বতোভাবে মেনে চলছে।
এর পর হঠাৎ করে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অন্য পাঁচটি দেশকে অবাক করে দিয়ে এবং তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৫ সালের চুক্তি থেকে নিজেদের বের হয়ে আসার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন এবং ইরানের বিরুদ্ধে নতুন করে বড় আকারে আক্রমণের ঘোষণা দেন। এর ফলে ইরান বিপদের মধ্যে পড়ে।
তাদের তেল রফতানির ওপর অবরোধের কারণে তাদের দেশে অর্থনৈতিক সংকট বৃদ্ধি পেয়ে জনগণের জীবন বিপর্যস্ত হওয়ার অবস্থা দাঁড়িয়েছে এখন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে বের হয়ে আসার পর স্বাক্ষরকারী অন্য পাঁচটি দেশই বলে তারা চুক্তির মধ্যেই থাকবে। তারা আরও বলে যে, মার্কিন অবরোধ অনুযায়ী তারা ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধ করবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইউরোপীয় দেশগুলোর যেভাবে ইরানের পক্ষে এগিয়ে আসা দরকার ছিল, সে ব্যাপারে তাদের শৈথিল্য যথেষ্ট।
এই পরিস্থিতিতে ৮ মে তারিখে ইরান ঘোষণা করে যে, চুক্তির কোনো কোনো অংশ না মেনে তারা তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি এগিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া তারা বলেছে, চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো যদি অবরোধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ইরানকে সাহায্য না করে, তাহলে তারা চুক্তির শর্তাবলীর বিষয়ে আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এ পরিস্থিতিতে ক্ষিপ্ত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে। এই অনুযায়ী তারা সামরিকভাবে ইরানকে ঘেরাও করার সিদ্ধান্তও কার্যকর করার ব্যবস্থা করছে।
কিন্তু ইরান ২০০৩ সালের ইরাক নয়। ইরানের জনগণ এখনও নানা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে শক্তভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী। তাছাড়া শুধু এখন নয়, ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময়েও ইরান অবকাঠামো, প্রযুক্তি, শিল্পায়ন, অস্ত্র তৈরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে নিজেদের খুব শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। এভাবে তারা মধ্যপ্রাচ্যে এখন এক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
সামরিক শক্তির দিক দিয়ে আমেরিকার কাছে ইরান কিছুই নয়। কিন্তু শুধু সামরিক শক্তির জোরে যা ইচ্ছা তাই করা যায় না, যদি একটা দেশের জনগণ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকে। ইসরাইল ইরানের এক মহাশত্রু। মার্কিনসহ অন্য সাম্রাজ্যবাদীরা ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরির ঘোর বিরোধী। কিন্তু ইসরাইল গোপনে অনেক পারমাণবিক বোমা তৈরি করে তার উপর বসে আছে।
সেখানে আন্তর্জাতিক পরিদর্শনের কথা কেউ বলে না। তাছাড়া যতই তারা বড় বড় কথা বলুক, ২০০৬ সালে ইরান সমর্থিত লেবাননের হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে তারা নাস্তানাবুদ হয়েছে এবং পরাজিত হয়ে পালিয়ে এসেছে। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, মুখে বড় বড় হুমকি দিলেও একটি দেশের ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী জনগণের বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ নয়। তাদেরকে পরাভূত করা ও পরাভূত অবস্থায় রাখা কঠিন কাজ।
যুদ্ধক্ষিপ্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন বিভিন্ন দেশে নিজের তেল স্বার্থে হস্তক্ষেপ করছে এবং যুদ্ধের হুমকিও দিচ্ছে। তারা ভেনিজুয়েলায় যুদ্ধ করার বিকল্প সামনে রেখেছে বলে ঘোষণা করেছে। তারা ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে এবং ইরানকে ঘেরাও করছে প্রতিবেশী দেশগুলোতে বোমারু বিমান নিয়ে এসে, যুদ্ধজাহাজ এনে।
তাদের কথা হচ্ছে, ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আক্রমণের পাঁয়তারা করছে। এর বিরুদ্ধেই তাদের যুদ্ধ প্রস্তুতি! এর থেকে মিথ্যা আর কিছুই হতে পারে না।
কারণ ইরানের মতো একটি দেশ নিজের থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সামরিক আক্রমণ করতে পারে এটা পাগলের চিন্তা। কারও পক্ষে বিশ্বাসযোগ্য নয়। এটা তারা বলছে উসকানি দেয়ার উদ্দেশ্যে এবং নিজেদের যুদ্ধ প্রস্তুতির যৌক্তিকতা হিসেবে।
কিন্তু ইরানের এটা জানা আছে যে, যেভাবে ইরাক আক্রমণ করা হয়েছিল সেভাবে ইরান আক্রমণ করার কোনো ক্ষমতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেই। কাজেই তারাও হুমকি দিয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘেরাও এবং যুদ্ধ প্রস্তুতির মুখে তারা হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দিতে পারে। এই পথে মধ্যপ্রাচ্যের তেল প্রায় সবটাই বাইরে যায়।
মোট কথা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন আসলেই ইরানের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ চক্রান্ত করছে। ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মতো কিছু না করলেও ইরানের অভ্যন্তরে বোমা বর্ষণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়ার নয়।
কিন্তু সে কাজ করলে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই নয়, সারা দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী দেশগুলোই এক টালমাটাল পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো সাম্রাজ্যবাদী এবং তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টদের মতো যুদ্ধবাজ ব্যক্তি যেখানে নীতিনির্ধারক, সেখানে এই পদক্ষেপের সম্ভাবনা বাতিলযোগ্য নয়।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল