আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বিনিয়োগে ভারতকে দ্রুত পেছনে ঠেলছে চীন। চলতি অর্থবছরের প্রথমভাগে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং মেগা প্রকল্পগুলোতে বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে প্রায় ৬শ’ মিলিয়ন ডলার (৬০ কোটি ডলার) গ্রহণ করেছে। এর মাধ্যমে তার আগের স্ট্রেটেজিক উন্নয়ন অংশীদাররা চীনের কাছে পিছিয়ে পড়ছে। ভারত একই সময়ে বিনিয়োগ করেছে চীনা বিনিয়োগের মাত্র এক দশমাংশ- ৬৫ মিলিয়ন (সাড়ে ৬ কোটি) ডলার।
নিউ দিল্লি ও লন্ডনভিত্তিক ওয়েবসাইট দি থার্ড পোল ডট নেট-এ ১৩ই মে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সমর্থন দেয়ার সময় থেকে বাংলা-ভারত একটি ঐতিহাসিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। কিন্তু সামপ্রতিক বছরগুলোতে ওই বন্ধন আলগা হতে শুরু করেছে। কারণ বাংলাদেশ ক্রমশ চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
বৃটেনের উন্নয়ন সংস্থা ডিএফআইডি-র অর্থায়নে এবং চায়না ডায়লগের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত দি থার্ড পোল ডট নেট রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা এবং এশিয়াজুড়ে চীনের দিগন্ত প্রসারিত করার আগ্রহের মধ্যে একটা মেলবন্ধন ঘটেছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে চীন তাই এখন বদ্বীপীয় দেশটির প্রধান বিনিয়োগকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
এর ফলে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চীন থেকে সরাসির বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ৫০৬ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা মোট বৈদেশিক পুঁজি প্রবাহের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। বর্তমানে প্রায় ৪০০টি চীনা কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা করছে। এর মধ্যে প্রায় দু’শ’ বড় কোম্পানি এবং দু’শ’ ছোট ও মাঝারি কোম্পানি রয়েছে।
রিপোর্টে বলা হয়, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক ভারতকে হতাশ করেছে। এর মধ্যে বড় ঘটনাটি ঘটে যখন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ গত বছরে বেদনাদায়কভাবে ভারতকে পাশ কাটিয়ে শেনঝেনের একটি কনসোর্টিয়াম এবং সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে ২৫ ভাগ শেয়ার বিক্রি করে। ভারতের জাতীয় স্টক এক্সচেঞ্জ চীনা স্টক এক্সচেঞ্জের থেকে ৫৬ শতাংশ কমে বিড করেছিল।
ডার্টি পাওয়ার: ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীনের অধিকাংশ বিনিয়োগ, যার পরিমাণ ৪০৭ মিলিয়ন ডলার, সেটা বিশেষ করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলিতে ঢুকেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ১৩শ’ মেগাওয়াট চীনা তহবিলযুক্ত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং অন্যটি বিখ্যাত হিলসা (বাংলাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত মাছ) অভয়ারণ্যের কাছে পটুয়াখালীতে (পায়রা) অবস্থিত। কক্সবাজারে ১৩০০ মেগাওয়াট কয়লা প্রকল্পের জন্য চীনের সঙ্গে সমপ্রতি আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ তার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ সরবরাহ বর্তমানের ২ ভাগ থেকে ৫০ ভাগের বেশিতে উন্নীত করার টার্গেট নিয়েছে। এর আওতায় ২৩ হাজার মেগাওয়াট নতুন কয়লাচালিত প্রকল্প পাইপলাইনে রয়েছে।
চীনা ও অন্যান্য বিদেশি সমর্থিত কয়লাচালিত প্লান্ট জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। স্থানীয়রা বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। কারণ তারা ভয় করছেন যে, তাদের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং তারা তাদের জমি হারাবেন।
বিশেষজ্ঞদের অনেকেই প্রশ্ন করছেন, দেশের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে বাংলাদেশ কেন কয়লার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। কারণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো গুরুতর দূষণ সংকটের ভয়ে কয়লার মতো নোংরা জ্বালানি থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সৌর, বায়ুু, এবং গ্রিড দক্ষতার জন্য মূল্য শিগগিরই কয়লার নিচে নেমে যাওয়ার পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে।
২৩টি দেশে কয়লা নির্ভর ১০২ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে বর্তমান প্রকল্পগুলো রয়েছে, তার মধ্যে চীনা আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং কোম্পানিগুলি এক চতুর্থাংশ প্রকল্পে অর্থায়ন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বা প্রস্তাব করেছে।
ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল এনালাইসিস (আইইইএফএ)-এর সামপ্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশই হলো সেই দেশ, যেখানে প্রায় ১৪ গিগাওয়াট শক্তি উৎপাদনে মোট ৭ বিলিয়ন ডলারের চীনা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। যাই হোক, প্রস্তাবিত ওই প্রকল্পগুলো অধিকাংশই দীর্ঘ বিলম্বিত এবং এখনও প্রাক নির্মাণ অবস্থায় রয়েছে।
প্রধান অবকাঠামো: এটি শুধু শক্তি খাতে নয় যে, চীন একটি প্রধান খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে। চায়না ডেইলির মতে, চীন বাংলাদেশে ১০ বিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে চীনের অর্থনৈতিক ও শিল্পাঞ্চল, অষ্টম চীন-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ সেতু এবং একটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী কেন্দ্র রয়েছে।
রিপোর্ট বলেছে, বাণিজ্যেও একই প্রবণতা লক্ষণীয়। ঢাকা চেম্বার অর কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি ওসামা তাসির বলেন, চীন এখন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। বাংলাদেশ সবজি, হিমায়িত এবং জীবন্ত মাছ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, টেক্সটাইল ফাইবার, কাগজের সুতা এবং বোনা কাপড়, পোশাক এবং পোশাক সামগ্রী রপ্তানি করছে।
২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ছিল ১২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২১ সালের মধ্যে তা ১৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায়?: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব ইনাম খান বলেন, চীন বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বাণিজ্যিক অংশীদার এবং দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, ক্রমবর্ধমান দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও পরিকাঠামোতে চীনা বিনিয়োগের সুবিধাগুলো বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক ও যোগাযোগের প্রকল্পগুলোতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তবে, অবকাঠামোতে চীনা বিনিয়োগের সাফল্য মূলত প্রকল্পগুলোর আর্থিক কার্যকারিতা এবং রপ্তানি আয়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কের উপর নির্ভর করে। পুঁজিবাজারে এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে (এসইজেড) বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা আনতে সক্ষম হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক উড্রো উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ শক্তিশালী, জিডিপি বৃদ্ধির হার এই বছর প্রায় ৮% হতে পারে, তবে দেশটি প্রচুর পরিমাণে ঋণগ্রস্ত হওয়ার ফলে দীর্ঘমেয়াদি ঋণশোধের ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
‘আরেকটি সমস্যা হলো, চীনের বিনিয়োগের অনেক প্রকল্পই টেকসই বিষয়ে সামান্যই মন দেয়। বেইজিং যখন রিনিউঅ্যাবল এনার্জি সংক্রান্ত প্রকল্পে বিনিয়োগে অগ্রাধিকার দেয়, তখন তার বড় টিকিট বিনিয়োগ প্রকল্পগুলো জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর হিসেবেই দেখা যায়। যেমন পাকিস্তানে তার একটি প্রধান কয়লা উৎপাদন প্রকল্প রয়েছে। অনুরূপভাবে, বেইজিংয়ের বেশিরভাগ অবকাঠামোগত বিনিয়োগ প্রকল্পে হেভি ডিউটি শিল্প নির্মাণ ও উৎপাদন জড়িত, যাতে প্রচুর পরিমাণে পানি খরচের দরকার পড়ে এবং এতে এমিশন-বেলচিং প্রযুক্তিও ব্যবহৃত হয়।’ -মি. কুগেলম্যান বলেন।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির জন্য আরো জ্বালানি সরবরাহের তাৎক্ষণিক প্রয়োজন বিবেচনা করা হচ্ছে, [ঢাকা] প্রকল্পগুলি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, সেখানে পরিবেশগত উদ্বেগ উপেক্ষা করাকেই শ্রেয় মনে করা হচ্ছে।
বেল্ট এবং রোড নির্মাণ: ২০১৩ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ ঘোষণার পর থেকে নতুন বাংলাদেশ-চীন অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।
একুশ শতকের মেরিটাইম সিল্ক রোড এবং সিল্ক রোড অর্থনৈতিক বেল্ট-উভয়েরই বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। বদ্বীপবেষ্টিত জাতি ভারত মহাসাগর ও ইউনানসহ চীনের ভূমিবেষ্টিত প্রদেশগুলোর মধ্যে সামুদ্রিক ও স্থলপথে সংযোগের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে একটি।
এই সম্পর্কটি ২০১৬ সালের অক্টোবরে শি জিনপিংয়ের দুই দিনের ল্যান্ডমার্ক সফরকালে গতিশীলতা অর্জন করেছিল। যা চীন ও বাংলাদেশ সম্পর্কের একটি ‘নতুন দিগন্ত’ হিসাবে শুরু হয়েছিল। ওই সফর ব্যাপকভাবে ‘ঐতিহাসিক রাষ্ট্রীয় সফর’ হিসাবে লেবেলযুক্ত ছিল। এই সফরকালে উভয় দেশ ভূমি ও মেরিটাইম কানেকটিভিটি, অবকাঠামো উন্নয়ন, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, পরিবহন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সহ বিভিন্ন সেক্টরে তাদের সহযোগিতা আরো বাড়াতে সম্মত হয়।
চায়না গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্ট ট্র্যাকারের মতে, ওই সফর থেকে এ পর্যন্ত উভয় দেশ ৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি চুক্তি সই করেছে। এর আওতায় মোট বিনিয়োগ ২৬.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এর মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণে ৩.৩ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি গত বছর সম্পন্ন হয়েছিল। এটি উত্তর ও দক্ষিণ বাংলাদেশকে সড়ক ও রেলপথে সংযুক্ত করবে। দেশটিতে নির্মিত চ্যালেঞ্জিং প্রকৌশল প্রকল্পগুলির মধ্যে এটিই সবাইকে ছাড়িয়ে যাবে।
অন্য প্রধান প্রকল্পগুলোর মধ্যে ডিজিটাল কানেকটিভিটি উন্নত করতে ১ বিলিয়ন ডলার এবং পাওয়ার গ্রিড শক্তিশালী করতে ১.৩২ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ছাড়িয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অংশেও চীনা বিনিয়োগ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
চায়না গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্ট ট্র্যাকারের মতে, চীনা কোম্পানিগুলো দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের বিভিন্ন সেক্টরে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে চীন পাকিস্তানে ২.৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, শ্রীলংকায় ২.৫৫ বিলিয়ন ডলার, নেপালে ১.৩৪ বিলিয়ন ডলার, এবং মিয়ানমারে ২.১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে।