এ কে এম শাহনাওয়াজ : সম্প্রতি রাজধানীতে নেতাকর্মীদের জমায়েতে বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারবিরোধী নানা বক্তব্যের মাঝখানে বলেছেন, ‘সরকার সুপরিকল্পিতভাবে দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করছে।’ কথাটি শুনে বেশ ধন্দে পড়লাম।
দেশ যদি কোনো প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক সংকটে পড়ে, তবে এর দায় তো অনেকটা ক্ষমতাসীন সরকারেরর ওপরই বর্তায়। তাই সরকার-পরিচালকদের দৃষ্টি থাকে এসব দুর্বলতা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা। অথচ বিএনপি মহাসচিবের কথা শুনলে মনে হবে, বর্তমান সরকার শখ করে নিজেদেরই অদক্ষ আর হেয়প্রতিপন্ন করতে চাইছে।
না হলে যেখানে সরকারের ভাষ্য হতে পারে ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি করে, সরকারের উন্নয়নের কাজে বাধা দিয়ে বিরোধী দল দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছে’; সেখানে খোদ সরকারই কি না ‘সুপরিকল্পিতভাবে দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করছে!’ অর্থাৎ সরকার বসে বসে পরিকল্পনা করে নিজের পায়ে কুড়াল মারছে।
আর অমন কাজে সরকারের কী লাভ হতে পারে! আমার মনে হয়, মির্জা ফখরুল সাহেব বলতে চেয়েছেন সরকার যেভাবে দেশ চালাচ্ছে- গণতন্ত্র বিপন্ন করছে, তাতে দেশটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হবে। কিন্তু বর্তমান সময়ে বিএনপি যে ছন্নছাড়া অবস্থায় পতিত হয়েছে, তাতে হতাশ নেতাদের মাথা যে ঠিকভাবে কাজ করছে না; তারই প্রকাশ যেন এ ধারার অসঙ্গতিপূর্ণ বক্তব্য।
গণতন্ত্র-গণতন্ত্র আহাজারি সব পক্ষের বক্তব্যেই থাকে। কিন্তু আমাদের রাজনীতিকরা গণতন্ত্রের জন্য কতটা জীবনপাত করেছেন, তা ইতিহাসের অনুসন্ধানের বিষয়। বাঙালির গণতন্ত্রের ঐতিহ্য অনেক পুরনো।
এ কারণে গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাজনীতি বাঙালির এত আরাধ্য। তবে দুর্ভাগ্য এই যে, রাজনৈতিক ব্যর্থতা এবং বিরূপ শাসন কাঠামো বাঙালির ঘাড়ে বারবার চাপিয়ে দেয়ার কারণে নানা আন্দোলন-সংগ্রাম করার পরও অধরা থেকে যাচ্ছে গণতন্ত্র। সেই আট শতকের শুরুতে মাৎস্যন্যায়ের যুগ-অবসান ঘটাতে বাংলার অভিজাতরা সিংহাসনের জন্য শত বৎসরের রক্তাক্ত সংঘাতের ইতিহাসকে পেছনে ফেলে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু করেছিলেন।
যোগ্য শাসকের খোঁজে আয়োজন করেছিলেন নির্বাচনের। এই গণতান্ত্রিক পথেই নির্বাচিত হন গোপাল। জনগণের নির্বাচিত গোপাল একশ’ বছরের অরাজক অবস্থার অবসানই ঘটাননি- স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনেছিলেন দেশে এবং প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি সফল রাজবংশের শাসন। পাল বংশ নামে প্রাচীন বাংলার বাঙালির গড়া সবচেয়ে সফল রাজবংশের শাসন ছিল এটি। এই অসাধ্য সম্ভব হয়েছিল গণতান্ত্রিক চেতনার কারণেই।
এমন ঐতিহ্যস্নাত বলেই গণতন্ত্র বাঙালির রাজনৈতিক ভাবনার গভীরে প্রোথিত আছে। যে কারণে পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে বাঙালি প্রতিবাদী আন্দোলন করেছে।
আইয়ুব খান কপট মৌলিক গণতন্ত্র দিয়ে ভোলাতে পারেননি বাঙালিকে। গণতন্ত্রের পথে মুক্ত স্বদেশ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হল কিন্তু গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা পাঁচ দশকেও পূর্ণ হল না। হল না রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতায়; যে কারণে গণতন্ত্রের জন্য রাজনীতি না হয়ে রাজনীতির স্বার্থে স্লোগানের গণতন্ত্র চাপিয়ে দেয়া হল মানুষের কাঁধে।
বড় দুই দলের আচরণে এর কোনো অন্যথা দেখা যায় না। দেশে নামেমাত্র একটি সংসদীয় গণতন্ত্র রয়েছে। একমাত্র জাতীয় নির্বাচন স্বচ্ছ বা ধোঁয়াচ্ছন্নভাবে অনুষ্ঠিত হওয়া ছাড়া আর কোনো গণতান্ত্রিক আচরণ আমাদের রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের মধ্য থেকে দেখতে পায় না মানুষ। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বেশি আসন পাওয়া দল বা জোট, মহাজোট গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার গঠন করে।
কম আসন পেলেও জনগণের ভোটের শক্তিতেই বিরোধী দল বা প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসে অন্যপক্ষ। সংসদীয় গণতন্ত্রের দায়েই দু’পক্ষকে সংসদ সজীব রেখে দেশ ও জনগণের জন্য কথা বলতে, ভূমিকা রাখতে হয় সংসদে।
সংসদ সদস্যরা জনগণের দুঃখ-দুদর্শা নিয়ে কথা বলবেন; দেশের সার্বিক উন্নয়ন, সমস্যা, সংকট নিয়ে কথা বলবেন। সরকারের ভুলত্রুটির সমালোচনা করে ভুল শুধরে দেবে বিরোধী দল। এভাবে জনকল্যাণমুখী আইন প্রণয়ন ও পাস করবেন সবাই মিলে। জনগণের নির্বাচিত নেতা বলেই এই দায়িত্ব পালনে সব পক্ষ দায়বদ্ধ।
এসব করতে জনপ্রতিনিধিরা তাদের মূল্যবান সময় ব্যয় করবেন বলে মানবিক কারণে রাষ্ট্র বা সরকার এ গরিব দেশে যথাসাধ্য একটি সম্মানজনক বেতনভাতা ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেছে সংসদ সদস্যদের জন্য; যার সংস্থান করা হয় জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে। সাধারণ মানুষের সরাসরি অনুমোদনের ব্যবস্থা না থাকলেও মানুষ মেনে নিয়েছে।
লাভজনক চাকরির মতো হলেও এসবের বিনিময়ে সংসদে তাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যই কথা বলা হবে। পরোক্ষভাবে হলেও সংসদ সদস্যরা সংসদ প্রাণবন্ত রেখে জনগণের অর্থ ভোগ করার বিনিময়ে তারা জনগণকে অনেক গুণ ফিরিয়ে দেবেন।
কিন্তু জনগণের রায়ে সংসদে আসা কোনো পক্ষই সে কথা রাখেননি। নির্বাচনে জয়লাভ করার পরই জনগণকে টা-টা বাই-বাই দিয়েছেন। নিজ নিজ দলীয় স্বার্থে আটকে গেছেন। জনগণের বুকে পা রেখে দলীয় সিদ্ধান্তে আটকে গেছেন। সংসদকে বানিয়ে ফেলেছেন নিজেদের গৃহস্থালি বাড়ি। প্রতাপশালী মোড়ল বাড়ি হচ্ছে সরকারি দলের আর দুর্বল প্রতিবেশী হচ্ছেন বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীরা।
তারা সবাই জনগণ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্বের কথা ভুলে যান। এদেশের সাধারণ মানুষ, যাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই, সুবিধাবাদী আমলা বা ব্যবসায়ী নন, কানে তুলো আর চোখে ঠুলি পরা কোনো রাজনৈতিক দলের অন্ধ সমর্থকও নন; তাদের পরিচয় তারা দেশকে শর্তহীনভাবে ভালোবাসেন। অসুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশের ভেতর বাস করে বিষণ্ণ-বিধ্বস্ত; তবু তারা আশাবাদী।
অন্ধকার হাতড়ে চলেও নতুন ভোর দেখবেন বিশ্বাসে প্রতিদিনই আত্মপ্রত্যয়ী হতে চান। তারা একবুক আশা আর আনন্দ নিয়ে এক সময় দিনবদলের মিছিলে মানসিকভাবে নিজেদের যুক্ত করেছিলেন।
আশা যে একেবারে অপূর্ণ রয়ে গেছে, তেমন নয়। দেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের সুফল কিছুটা হলেও তারা পাচ্ছেন; কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতা কি পাচ্ছেন? গণতন্ত্রের যাত্রাপথে কি আলো দেখতে পাচ্ছেন?
দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অসাধুতা ও সরকারি অন্যায়ে বিপন্ন ও মরচে ধরা দিনগুলোকে বদলে একটি সতেজ শুভ্র ঝকঝকে সকাল উপহার দেয়ার ঘোষণার ভেতরে ছিল একসময় আওয়ামী লীগের দিনবদলের প্রত্যয়।
রাজনীতিকদের কাছে বছরের পর বছর প্রতারিত মানুষ মহাজোটের সে সময়ের দিনবদলের স্লোগান শুনে বড় লোভী হয়ে পড়েছিল। তারা বিশ্বাস করেছিল, নানা ঘাত-প্রতিঘাত দেখে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নতুনভাবে প্রত্যয়ী ও মার্জিত হবে। সব জরামুক্ত হয়ে দিন বদলে ফেলার জন্য আন্তরিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
বড় দাগে মানুষ যে রূপান্তর দেখতে চেয়েছে তা হচ্ছে- ক. জনস্বার্থ বিস্মৃত হয়ে যোগ্য মানুষের সঠিক মূল্যায়ন না করে সংকীর্ণ দলীয়করণে ব্যস্ত হবে না; খ. প্রশাসনিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হবে; গ. শিক্ষাঙ্গন থেকে শুরু করে নানা অঙ্গনে অঙ্গ সংগঠনগুলোকে পরিশুদ্ধ করবে; চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল বাণিজ্য আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকা নেবে; গ. নিজ দল থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দুর্নীতিবাজদের বিতাড়িত করবে; ঘ. সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির কাঠামো ভেঙে জনগণের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার পথে হাঁটবে। কিন্তু এই সরকারের দীর্ঘ শাসনে এসবের কতটুকু অর্জিত হয়েছে, তা হতাশ মনে প্রতিদিনই মূল্যায়ন করছে দেশবাসী।
আমাদের ক্ষমতাবান সব দলই গণতান্ত্রিক আচরণ থেকে যোজন দূরে সরে এসে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি নিয়ে যেন পুতুল খেলছে। বিরোধী দলে থাকলে বোধহয় আচরণটি এমনই হয়।
তাই আচরণ যাই হোক, বিরোধী দলে থেকে বিএনপির নেতানেত্রীদের জবানে গণতন্ত্র শব্দটি জড়িয়ে থাকে সব সময়। অথচ গণতন্ত্রের হন্তারকদের হাতেই দলটির সৃষ্টি। ক্ষমতার রাজনীতির কুটিল পথে হাঁটতে গিয়ে বারবার গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের পথে কাঁটা বিছিয়েছে। অন্যদিকে ঐতিহ্যগত কারণেই আওয়ামী লীগের হাতে গণতন্ত্র তার যোগ্য অবস্থানে পৌঁছে যাওয়ার কথা।
কিন্তু একালের আত্মবিশ্বাস আর প্রত্যয়হীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব প্রতিনিয়ত গণতান্ত্রিক চেতনা থেকে সরে যাচ্ছে যোজন যোজন দূরে।
নানা ঘাত-প্রতিঘাতের পরও এদেশের মানুষ এতকাল বিশ্বাস করত- দেশের রাজনীতির হাল ধরা আর দাঁড় টানায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এখনও বিকল্প তৈরি হয়নি। দেশ চালাতে হলে এ দুই দলকেই কখনও সরকারে কখনও বিরোধী দলে থাকতে হবে। এতে অন্তত কিছুটা রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার সুযোগ থাকে। এখন তো সেখানেও ছেদ পড়ছে।
নেতৃত্বের দুর্বলতায় এবং ক্রমাগত ভুল সিদ্ধান্তে বিএনপির তরী এখন ডুবন্তপ্রায়। দেশে গণতন্ত্র বিকাশের পথচলায় এর চেয়ে দুঃসংবাদ আর কিছু হতে পারে না।
আমরা মনে করি, সাধারণ মানুষের কাছে সব দল নিজেদের আস্থাশীল করে তোলার জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারলে নির্বাচনে যেমন সুস্থ প্রতিযোগিতা হতো, তেমনি এই পথ ধরে গণতন্ত্র খুঁজে পেত তার এগিয়ে যাওয়ার স্বচ্ছন্দ গতি। কিন্তু না, সব দলীয় রক্তে কেমন এক স্বৈরতন্ত্র যেন প্রবাহিত হয়। তাই ক্ষমতায় এসে ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য নানা ‘উপায় অন্বেষণ কর্মসূচি’ নিয়ে যেমন ব্যস্ত থাকেন, বিরোধী শিবিরও তেমন ক্ষমতার মোহ পাওয়ার জন্য নানা অন্ধকার গলিপথ খুঁজতে থাকে। এভাবে গণতন্ত্রের বিপন্ন দশাটিই দৃশ্যমান হয়।
এসব বাস্তবতায় গণতন্ত্রের প্রশ্নে মানুষের মধ্যে বাড়ছে হতাশা। আমাদের সব পক্ষের রাজনীতিকরা প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের রাজনীতি করেন না বলে নিজেদের অচলায়তন ভেঙে কেউ নেমে আসতে পারছেন না।
বাস্তবতা হচ্ছে, রাজনীতিকদের তৈরি চোরাবালিতে পড়ে গণতন্ত্র এখন বিপন্ন। একটি দলের রাজনীতি তো দলগুলোর প্রধান নেতানেত্রীদের জীবদ্দশা পর্যন্ত টিকে থাকার জন্য নয়।
রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখতে, দলকে ভবিষ্যতের পথে শক্তিশালী করতে, এগিয়ে নিতে হলে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এই সত্য বিশ্বাস করলে দলগুলোর ভেতর থেকেই সরব দাবি উত্থাপিত হওয়া উচিত। এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আর কালক্ষেপণ না করে তলিয়ে যাওয়ার আগে চোরাবালি থেকে উদ্ধার করা প্রয়োজন বিপন্ন গণতন্ত্রকে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়