শুভ্র দেব ও পিয়াস সরকার : কিডনি কেনাবেচার ভয়ঙ্কর চক্র জাল ছড়িয়েছে সারা দেশে। মানুষের সংকটময় অবস্থাকে পুঁজি করে প্রতারণার নানামুখী শাখা-প্রশাখা তৈরি করেছে এসব চক্র। অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহক-দাতাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে নিচ্ছে চক্রটি। এসব চক্র গরিব অসহায় লোকদের নানা লোভ দেখিয়ে কিডনি বিক্রিতে উদ্বুদ্ধ করে। পরে তাদের কাছ থেকে কম দামে কিডনি নিয়ে বিক্রি করে বেশি দামে। এসব চক্র দেশ ছাড়িয়ে এখন ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া বাংলাদেশি রোগীদের কিডনির ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। আইনগত দিক দিয়ে কিডনি বিক্রি অপরাধ ও রোগীর স্বজন ছাড়া কেউ কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করতে পারবে না। কিন্তু এই দালালরা কিডনি দাতাদের এফিডিভিটের মাধ্যমে রোগীর স্বজন বানিয়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করাচ্ছে। সূত্র বলছে সারা দেশে কিডনি কেনা-বেচার কাজে ১০ থেকে ১৫টি গ্রুপ সক্রিয়।
তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে সব সময় সক্রিয় থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে কিডনি রোগী ও দাতার ব্যবস্থা করে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও দালাল চক্রের সদস্যরা সক্রিয়। তাদের চাহিদামত বাংলাদেশ থেকে কিডনি দাতার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু এদের মধ্যে কিছু চক্র রোগীকে কিডনি পাইয়ে দিতে সহযোগীতা করে আর আরও কিছু প্রতারক রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে পাইয়ে দেয়ার কথা বলে অগ্রিম টাকা নেয়। টাকা নেয়ার পর তাদের আর খোঁজে পাওয়া যায় না।
চিকিৎসক সূত্র জানিয়েছে, ঢাকায় কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট খুব স্বল্প পরিসরে হয়। তাই রোগীরা পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে গিয়ে ট্রান্সপ্লান্ট করতে আগ্রহী হয়। কারণ সেখানে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক স্বল্প খরচে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা যায়। বিশেষ করে ভারতের কলকাতা, মুম্বই, হায়দ্রাবাদ, দিল্লি, ব্যাঙ্গালুরু, চেন্নাইয়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়। তাই এসব স্থানের ইন্টারন্যাশনাল পেসেন্ট সার্ভিসকে (আইপিএস) ঘিরে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি দালাল চক্র। এসব দালালরা তিনটি ধাপে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের কাজ করে। প্রথমত কোন কোন রোগীর কিডনির প্রয়োজন তাদের খোঁজার দায়িত্ব থাকে কিছু সদস্যদের। আবার কিডনির দাতা সংগ্রহ করার দায়িত্বে থাকেন কেউ কেউ। ডোনারের ব্যবস্থা হলে তাকে রোগীর স্বজন বানানোর জন্য বেশ কিছু কাগজপত্র তৈরি করেন চক্রের বাকি সদস্যরা।
সূত্র বলছে, ভারতের যেসকল স্থানে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হয় এসব জায়গায় তৎপর থাকে বাংলাদেশী দালাল চক্র। দালালরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে গরীব অসহায় অভাবী মানুষদের টার্গেট করে, টাকার লোভ দেখিয়ে কিডনি বিক্রি করতে উদ্বুদ্ধ করে। পরে ভারতের দালাল চক্রের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করে। বিনিময়ে তারা কিডনি বিক্রির টাকা থেকে একটি অংশ নেয়। এই সূত্র আরও জানিয়েছে, দেশের বাইরে গিয়ে কিডনি বিক্রি করতে হলে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে ৭ থেকে ৯ লাখ টাকা নেয়া হয়। এক্ষেত্রে কিডনির ডোনার পায় ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। বাকী টাকা ভারত ও বাংলাদেশের দালালরা ভাগ করে নেয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কিডনি রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. নিজাম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে সব কিডনি রোগীদের কিডনির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না। অধিকাংশ রোগী ডায়ালাইসিস করে বেঁচে থাকেন। আর অল্প কিছু মানুষ কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করে। তিনি বলেন, নিজের আত্মীয় স্বজনের বাইরে কিডনি ট্র্যান্সপ্লান্ট বা কেনা-বেঁচা করা একটা অপরাধ। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় আত্মীয় স্বজন কিডনি না দিয়ে বাইরে থেকে কিনে নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে কিডনি দাতাকে বিভিন্ন কাগজপত্র তৈরি করে রোগীর আত্মীয় হিসাবে পরিচয় দেয়া হয়। চিকিৎসকরা অনেক সময় এসব কাগজপত্র যাচাই-বাচাই করার সুযোগ পান না।
তিনি বলেন, কিছু গরীব লোকদের টাকার লোভ দেখিয়ে এক শ্রেণীর প্রতারক চক্র কিডনি কিনে নেয়।
অনুসন্ধানে জানা যায় – উত্তরাঞ্চলের বিশেষ করে জয়পুরহাট, নঁওগা, পাবনা, দিনাজপুর জেলার দিনমজুর, শ্রমিক, রিকশা চালক, ভ্যান চালক, কৃষক এমন লোকদের দারিদ্রতা, অভাব অনটনের সুযোগ নিয়ে লোভ দেখায় প্রতারকরা। ঋণগ্রস্ত মানুষদের ঋণমুক্তি ও সাবলম্বী হওয়ার লোভ দেখিয়ে অল্প দামে কিডনি কিনে তারা। পরে সেটা সুযোগ বুঝে কিডনি রোগীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। স্বজন ছাড়া এখন আর কেউ ট্রান্সপ্লান্ট বা বিক্রি করতে পারবে না। তারপরও প্রতারক চক্রের সদস্যরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপ, পেইজে কিডনি কেনা বেচার বিজ্ঞাপন দেয়। রোগীর স্বজনরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে খুব কম দামে কিডনি দেয়ার নিশ্চয়তা দেয়। পরে রোগীর স্বজনদের ম্যানেজ করে পরীক্ষা নীরিক্ষা করার কথা বলে অগ্রিম ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে যায়। টাকা নেয়ার পরে সেই প্রতারক যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তাকে আর খোঁজে পাওয়া যায় না।
আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন সময় কিডনি বিক্রির চক্রকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে চক্রের সদস্যরা জানিয়েছেন, আইনে বিধি নিষেধ থাকা সত্বেও তারা কিডনি বিক্রি করে থাকে। এজন্য তাদের নানা রকম ঝক্কি-ঝামেলাও পোহাতে হয়।
কিডনি বিক্রির জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপ, পেইজ ও ব্যক্তিগত আইডি থেকে দেদারছে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। কিডনি ডোনার, কিডনি ডোনার সার্ভিস, কিডনি ডোনার বাংলাদেশ, জীবন বাঁচাতে কিডনি দান, কিডনি চাই, কিডনি ডোনার সার্ভিস অ্যান্ড পেসেন্ট বাংলাদেশ, কিডনি ক্রয় বিক্রয়, জরুরি প্রয়োজনে কিডনি এরকম বেশ কয়েকটি পেইজ ও আইডি পর্যালোচনা করে কিডনি কেনা বেঁচা নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। এসব গ্রুপ থেকে শুধু কিডনি বিক্রি করা হয় না কিডনি পাইয়ে দেয়ার কথা বলে হাতিয়ে নেয়া হয় লাখ লাখ টাকা।
আবার গ্রুপে দেখা মেলে মূলত কয়েকটি আইডি থেকে দেয়া হচ্ছে স্ট্যাটাস এবং আবদার করা হচ্ছে বিভিন্ন গ্রুপের কিডনি। জয়পি হাসপাতাল নামক একটি পেইজ থেকে কিডনির প্রয়োজন এমন পোস্ট শেয়ার দেয়া হয়। সেখানের একটি পোস্টে কিডনি প্রয়োজন চেয়ে স্ট্যাটাস দেয়া হয়। কিডনি ফেইলিয়রের চিকিৎসা করছেন ওই হাসপাতালের ইউরোলজি বিভাগের অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টের ড. অমিত কে ডেভরা। মূলত কিডনির চাহিদা ও দেশীয় রোগীর চাহিদাগুলো তুলে ধরা হয় এসব গ্রুপে। চাহিদাপত্রের কথা বলে খোঁজা হয় ডোনার। তাদের কিডনি নিয়ে বিক্রি করে দেয়া হয় অধিক মূল্যে। সেই সঙ্গে রোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয় লাখ লাখ টাকা।
‘কিডনি ডোনার’ নামক একটি গ্রুপ পর্যালোচনা করে দেখা যায় গ্রুপটিতে কিডনি চেয়ে একাধিক পোস্ট দেয়া হয়েছে। একটি ‘বি পজেটিভ কিডনি ডোনার প্রয়োজন। পাসপোর্ট লাগবে না।’ এই পোস্টের নিচে দেখা মেলে প্রচুর কমেন্ট। সেখানে দেয়া অনেক নম্বর। কয়েকটি নম্বরে পরিচয় গোপন করে কথা হয়। রানা হোসেন নামে একজনকে ভাইয়ের জন্য বি পজেটিভ কিডনির প্রয়োজন জানালে তিনি বলেন, দেয়া যাবে। দিতে হবে দেড় লাখ টাকা। কিছু কমিয়ে রাখা সম্ভব কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ভাই আগে বিভিন্ন টেস্ট করতে হবে। টেস্টে মিলে গেলে তারপর কিছু টাকা কমিয়ে রাখা সম্ভব। এরজন্য দিতে হবে ১০ হাজার টাকা অগ্রিম। কিন্তু এই অগ্রীম টাকা দেবার পর শারীরিক পরীক্ষায় পাস করলে? এর উত্তরে বলেন, ভাই সেই পাবনা আর না হয় নওগা থেকে লোক আসবে পরীক্ষার জন্য। না মিললেও তাকে টাকা দিতে হবে। কিন্তু সময় যে নষ্ট হচ্ছে এতে। আমারতো জরুরি দরকার। তখন তিনি বলেন, আপনি টাকা পাঠালে কালকেই আসবে পরীক্ষার জন্য। কিন্তু এই কিডনি কে দিবে জানতে চাইলে বলেন, সেটা আপনার না জানলেও চলবে। আপনার ভাইয়ের কিডনি দরকার কিডনি পাবেন। পরে তার সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি বলেন ঢাকা মেডিকেলে এসে ফোন দিয়েন। আমি ঢাকা মেডিকেলেই থাকি।
কিন্তু তার কথা মত ঢামেকে গিয়ে একাধিকবার ফোনে কথা হলেও সে নানান অযুহাত দেখিয়ে দেখা করেনি। কখনো জানায় মিটিংয়ে, কখনো ব্যস্ত। আবার কখনও জানায় পরে ফোন করছি। পরে আর ফোন রিসিভ করেননি সে।
সানিয়া ইসলাম জারা নামে একটি অ্যাকাউন্ট থেকে কমেন্ট করা হয়, আমি আমার একটি কিডনি বিক্রি করতে চাই। আমার বিশেষভাবে টাকার প্রয়োজন। আমার রক্তের গ্রুপ এ পজেটিভ। পোস্টের নিচে একটি মোবাইল নম্বর দেয়া ছিল। সেই নম্বরে যোগাযোগ করলে শোনা যায় একটি পুরুষ কণ্ঠ। পরিচয় গোপন করে ফের কথা হয় তার সঙ্গে। চাচার জন্য জরুরি ভিত্তিতে এ পজেটিভ কিডনি ডোনার প্রয়োজন বলে তাকে অনুরোধ করা হয়। তখন তিনি অনেকটা শান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ভাই আপনি কোন টেনশন করবেন না। ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে। টাকা কত লাগবে? এই প্রশ্নের জবাবে বলেন, ভাই টাকা কোন সমস্যা না। আপনার চাচা মানে আমার চাচা। টাকা তো আর আমি নিব না।
যে দিবে তাকে দিতে হবে। কিন্তু কত? তাকে দেড় লাখ টাকা দিবেন আর আমারে কিছু দিবেন। অনেক হয়ে যায়। আমার চাচা কৃষক। এক লাখ টাকায় হয় না। কি যে বলেন, এক লাখ টাকায় তাই কি রাজি হয়? আমি বলে কয়ে ১০ হাজার টাকা কমাতে পারবো। আর আমাকে দিতে হবে ১০ হাজার টাকা। এরকম কিছু সময় কথা কথা বলার পর তিনি ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় রাজি হন। এরপর বলেন, ১০ হাজার টাকা দিতে হবে অগ্রীম।
মো. হানিফ নামে একজন ফেসবুকে পোস্ট দেন। তিনি তাতে এক দালালের মোবাইল নম্বরসহ ছবি দেয়া এবং সাবধান থাকতে বলেন। মো হানিফের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, বিএসএমএমইউ হাসপাতালের কিডনির দালাল। সে রিফাত নামে পরিচিত। এছাড়াও এই দালাল বাপ্পি ও সাইফুল নামেও পরিচয় দিয়ে থাকে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই দালালের বাড়ি যশোরে। থাকে রাজধানীর ঝিগাতলায়। রিফাত প্রথমে ছিলো মোবাইল চোর। পরে পেশা বদলিয়ে হয় কিডনি ব্যবসায়ী। কিডনি ব্যবসায় আসার পর সে দ্বিতীয় বিয়ে করে। কিডনি প্রয়োজন যাদের এমন ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে সে। এরপর দ্বিতীয় স্ত্রীকে ডোনার সাজিয়ে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা। রিফাতের রয়েছে আরো ৪ জন সহযোগী। মোট ৬ জনের এই দল চালাচ্ছে কিডনি কেনা-বেচার নামে প্রতারণা। আরেক জনের ফেসবুক আইডির নাম এম এ মান্নান ভুইয়া। ফেসবুকের দেয়া তথ্য মতে তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। তার বায়োতে লেখা ‘কিডনি দান করা একটি মহৎ কাজ। একটি কিডনি নিয়ে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই জীবন-যাপন করতে পারে।’ আরেকটি আইডির নাম হাসান রহমান। সেখানের দেয়া তথ্যানুযায়ী সে কাজ করে জয়পি হাসপাতাল, ভারতে।
অপরাধ বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, এটি একটি স্পষ্ট অপরাধ। বাংলাদেশের অভাবতাড়িত এলাকায় এসব বেশি দেখা যায়। আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে এসব অপরাধ অনেক কমে যাবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেন, অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা আগে অনেক প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছি। সম্প্রতি আমাদের কাছে এ ধরনের অভিযোগ কেউ করেনি। অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব। সূত্র ; মানবজমিন