সৈয়দ আবুল মকসুদ : বাংলাদেশের জনগণের একটি বিশাল অংশ রাষ্ট্র থেকে কিছুই আশা করে না। নিজের ইচ্ছায় দুনিয়াতে তারা আসেওনি, অনিচ্ছা সত্ত্বেও চলে যেতে হবে। কোনোরকমে বেঁচে থাকাতেই তারা সন্তুষ্ট। কারও প্রতি তাদের কোনো অনুযোগ নেই। আরেকটি শ্রেণি আছে, তারা অতি অল্প প্রাপ্তিতেই সন্তুষ্ট। কিন্তু সেই অল্প সুযোগ-সুবিধাও যখন তারা পায় না, তখন তারা মনে খুব কষ্ট পায়। অন্য একটি ছোট শ্রেণি আছে, তাদের চাওয়া-পাওয়ার যেমন শেষ নেই, রাষ্ট্র থেকে প্রাপ্তিরও শেষ নেই। দেশের সব খাসজমি এবং ব্যাংকগুলোর সব টাকা তাদের মধ্যে বিলিবণ্টন করে দিলেও তাদের সন্তুষ্টি নেই।
সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি অন্তর্জ্বালায় দগ্ধ হয়, যখন তারা দেখতে পায়, একটি গোত্রের প্রতি রাষ্ট্র গভীর দয়া প্রদর্শন করছে। রাষ্ট্র নিজে একটি জড় বস্তু, তার নিজের কোনো ছেলেমেয়ে, ভাগনে-ভাগনি, শালা-ভগ্নিপতি নেই। যার কোনো স্বজন নেই, তার স্বজনপ্রীতির প্রশ্ন আসে না। মায়া-মমতা থাকলে আছে রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপক বা পরিচালকদের। সাধারণ মানুষ তাদের অল্প বুদ্ধি দিয়ে ভেবে একটি বিষয়ের কূলকিনারা পায় না যে কী কারণে আইন অমান্যকারী একশ্রেণির প্রতি ব্যবস্থাপকদের এত মমতা।
বাংলাদেশকে এখন আর কেউ গরিব দেশ বলে হেয়প্রতিপন্ন করতে পারবে না। তার এখন অঢেল টাকা। বাংলাদেশকে এখন আর কেউ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলতে পারবে না। তবে বাংলাদেশ না হলেও বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো তলাবিহীন ঝুড়ি। ‘মাত্র ৩৯ মাসে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪৩ হাজার ২১০ কোটি টাকা। আর এ সময়ে ঋণখেলাপির সংখ্যা বেড়েছে ৫৮ হাজার ৪৩৬ জন। এ হিসাব ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত। ফলে ২০১৮ সাল শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। আর এ সময়ে খেলাপি হয়ে গেছেন ১ লাখ ৭০ হাজার ৩৯০ জন গ্রাহক ও প্রতিষ্ঠান।’ [প্রথম আলো, ২৩ জুন ২০১৯ ]
এই তথ্য পাওয়া গেছে ২২ জুন জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বের অর্থমন্ত্রীর দেওয়া লিখিত জবাবে। এ সময় শীর্ষ ৩০০ ঋণখেলাপির নামও প্রকাশ করা হয়। তালিকা অনুযায়ী এই ৩০০ খেলাপি গ্রাহকের কাছে আটকা আছে ৫১ হাজার কোটি টাকা। পাঁচ কোটি টাকার বেশি ঋণের তথ্য দেওয়া হয়। এ হিসাবে ৫ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন, এমন গ্রাহকের সংখ্যা ১৪ হাজার ৬১৭ জন। তাঁদের ঋণের পরিমাণ ৭ লাখ ৮৪ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ১ লাখ ১৮৩ কোটি টাকা।
এই খবর পড়ে গ্রামের একজন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রছাত্রী দুঃখবোধ করতে পারে। সে মনে করতে পারে, দেশের এত ব্যবসায়ী ও বড়লোক ফতুর হয়ে গেছেন যে তাঁরা ঋণের টাকাও পরিশোধ করতে পারছেন না। কিন্তু কিশোর-কিশোরী পাঠক জানে না যে ঋণ নিয়ে কেউই দেউলিয়া হননি। তাঁরা দিব্যি ভালো আছেন, সুখে আছেন। ‘থাকেন শতকোটি টাকার আলিশান বাড়িতে, চড়েন কোটি টাকার বিলাসবহুল গাড়িতে। নিজ ও পরিবারের নামে করেছেন স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা-মসজিদ। নামে-বেনামে কিনেছেন জমি, নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ছেন। সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তিও বিপুল। নিয়মিত যান বিদেশে। আবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গড়েছেন সেকেন্ড হোম। পাচার করছেন অর্থ। সবই ঠিক চলছে। শুধু ব্যাংকঋণের টাকা ফেরত দেওয়াতে যত অনীহা।’ [কালের কণ্ঠ, ২৩ জুন ২০১৯ ]
ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ সোনার বাংলা ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এই একমাত্র মাটি, যেখানে ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিয়ে ধনকুবের হওয়া যায়। যাঁরা ঋণখেলাপি হয়েছেন, নিন্দুকেরা তাঁদের প্রশংসা করবে না, কিন্তু তাঁদের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা হাওলাত যাঁরা দিয়েছেন, তাঁদের পরিচয় জানাও দরকার। কারণ, খেলাপিরা কেউই বাড়ি থেকে বস্তা নিয়ে গিয়ে ব্যাংকের টাকা তাতে ভর্তি করে মুটের মাথায় দিয়ে নিয়ে আসতে পারেননি। প্রতিষ্ঠানের কঠিন নিয়মকানুনের ভেতর দিয়েই ঋণ পেয়ে ধন্য হয়েছেন খাতক। স্রেফ বোকাও বোঝে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান যদি যথাযথ দায়িত্ব পালন করত, তাহলে অল্প কিছু মানুষ ছাড়া এত বেশি খেলাপি হওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব হতো না।
মানুষ সন্দেহপ্রবণ প্রাণী। তারা অনেক বিষয়ে সন্দেহ করে, যা অমূলক নয়, তার কিছুটা হলেও সত্য। যেসব কর্মকর্তার হাত দিয়ে কোটি কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, তাঁরা চা-সিগারেট খাওয়ার জন্য কিছুই পাননি, তা অবিশ্বাস্য। আর যদি পার্সেন্টেজ বা বখরার মাধ্যমে হয়ে থাকে, তাহলে তো আনন্দের সীমা নেই।
শুধু কর্মকর্তাদের ঘাড়ে সব দায় চাপানো সুবিচারের কাজ হবে না। একজন কর্মকর্তার কাছে যদি ওপর থেকে চাপ আসে, তাঁর পিতা-পিতামহের পক্ষেও সম্ভব নয় তা অগ্রাহ্য করা। প্রতিটি ব্যাংকের মাথায় রয়েছেন তার চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালকেরা। সরকারে আছেন তাঁদের মামা। যে দেশে ব্যাংকের পিয়ন, মেসেঞ্জার, ক্লিনারের চাকরি-বদলি চেয়ারম্যান-এমডির অনুমতি ছাড়া হয় না, সেখানে শত শত কোটি টাকা একজন এসে নিয়ে যাবেন, তাঁরা কিছুই জানবেন না, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
ব্যাংক হলো টাকার জাহাজ। পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতার লেখকদের অবস্থা আদার ব্যাপারীর মতো। জাহাজের খোল-মাস্তুল নিয়ে যেমন আদার ব্যাপারীর মাথা ঘামানো অর্থহীন, তেমনি বঙ্গীয় ঋণখেলাপিদের নিয়ে আমাদের আলোচনাও অর্থহীন। তাঁদের তাতে কিছুই যায়-আসে না। তাঁরা কর্জের টাকা ফেরত দিতে বাধ্য নন। মানুষ জানে, ফেরত দেওয়ার অঙ্গীকার করে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ নিয়ে তা আত্মসাৎ করা বা পরিশোধ না করা শক্ত দেওয়ানি অপরাধ। তবে বাংলাদেশে আইন নিজস্ব গতিতে না চললেও অপরাধীরা নিজস্ব গতিতেই চলেন। তাঁদের সাবলীল গতি কে রুধিবে দিয়ে লেখালেখির বালির বাঁধ?
অনিবার্য কারণে অনেকে যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না। টাকা খাটিয়ে কোনো কারণে ব্যবসায় লোকসান হয় এবং পুঁজিটাও খোয়া যায়। ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা সম্ভব হয় না। কেউ ভবলীলা সাঙ্গ করে না-ফেরার দেশে চলে যান। তাঁদের কথা আলাদা। কিন্তু ঋণ নিয়ে না-ফেরার দেশে নয়, ফেরার দেশে গিয়ে সে দেশের ব্যাংকে টাকা জমা রাখবেন বা বিষয়সম্পত্তি করবেন, নিজের এলাকায় স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা-মসজিদ বানাবেন নিজের, স্ত্রীর বা মরহুম মা-বাবার নামে, তাঁদের নিয়ে ভাববার বিষয়।
বাংলাদেশের ঋণখেলাপিরা শুধু অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আলোচনা-গবেষণার বিষয় নয়, তাঁদের নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের। তাঁদের পূর্বপুরুষের ইতিহাস এবং তাঁদের নিজেদের জীবন ও মনোজগতের বিশ্লেষণ করা দরকার। কেন তাঁরা ঋণ নিয়ে ব্যবসায় না খাটিয়ে জোতজমি কেনায় লাগাচ্ছেন, সপরিবার বিশ্ব ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এলাকায় দাতা কর্ণ হিসেবে পরিচিতি পেতে নিজেদের নামে প্রতিষ্ঠান গড়ছেন। কেন তাঁরা তা করেন, তা তাঁদের জিন বা বংশানুগতি বিশ্লেষণ ছাড়া বোঝা যাবে না।
তবে এই মুহূর্তে বিষয়টি শুধু গবেষণার নয়। আর্থসামাজিক উন্নয়নের স্বার্থে রাষ্ট্র ব্যবসা-বাণিজ্যবান্ধব হবে, কিন্তু ঋণখেলাপিবান্ধব নয়। সে জন্য রাজনীতিকদের দায় সবচেয়ে বেশি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তাঁদের ভূমিকা প্রধান। খেলাপি ঋণ আদায়ে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে, সেই সঙ্গে নিতে হবে খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা। তা না হলে অনেক অর্জন সত্ত্বেও দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। সূত্র : প্রথম আলো
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক