পাশ্চাত্য চিন্তাবিদদের যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন তাদের লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়ে থাকি। যেমন মোহাম্মদ আসাদ, মরিয়ম জামিলা প্রমুখ। বছর কয়েক আগে সাবেক ক্যাথলিক খ্রিষ্টান চিন্তাবিদ জেফরি ল্যাংয়ের বই ‘আত্মসমর্পণের দ্বন্দ্ব’ পড়েছিলাম। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট (বিআইআইটি)। বাড়ি # ৪, রোড # ২, সেক্টর # ৯,উত্তরা ঢাকা-১২৩০। ফোন : ০২-৫৮৯৫৪২৫৬, ০২-৫৮৯৫৭৫০৯)।
বইটি ২০১৯ সালে পুনরায় প্রকাশ করেছে একাডেমিয়া পাবলিশার্স লিমিটেড-এপিএল কনকর্ড এম্পোরিয়াম শপিং কমপ্লেক্স, ২৫৩/২৫৪, এলিফ্যান্ট রোড, কাঁটাবন, ঢাকা। এটি একটি অসাধারণ বই যা সবারই পড়া উচিত।
জেফরি ল্যাং পুস্তকের প্রথম অধ্যায়ে তার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি স্কুলজীবনের শেষ দিকে নাস্তিক হয়ে গিয়েছিলেন। তবে তার জীবনে অল্প বয়সেই স্বপ্ন দেখতেন যে, তিনি নামাজ পড়ছেন। তিনি পিএইচডি শেষ করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সেখানে একজন অত্যন্ত ব্যক্তিত্বশালী আরব মুসলিম, মাহমুদ কানদিলের সাথে তার পরিচয় হয়। কানদিলের মাধ্যমেই তিনি ইসলাম সম্পর্কে অবহিত হন এবং শেষ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে ল্যাং আল কুরআন পড়ার ফলে তার যে অনুভূতি হয়েছে, তা আলোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন, ইসলাম যুক্তির ওপর জোর দিয়েছে। কুরআনে ৫০ জায়গায় ‘আকালা’র (যুক্তির) কথা এসেছে। তবে মুসলমানদের অবশ্যই শেষ পর্যন্ত ওহিলব্ধ জ্ঞান অর্থাৎ কুরআনের কাছেই যেতে হবে।
জেফরি ল্যাং বিভিন্ন বিষয়ে বাইবেল ও কুরআনের তুলনামূলক আলোচনাও করেছেন। তিনি কুরআন ও বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করে বলেছেন, কুরআনে বিজ্ঞাবনবিরোধী কোনো কিছু পাওয়া যায়নি। তবে কুরআন বিজ্ঞানের বই নয়, হেদায়েতের বই। এ অধ্যায়ে তিনি কুরআনে ব্যবহৃত রূপক, কুরআনের অনুপম বৈশিষ্ট্য এবং মানবজীবনের মূল লক্ষ্য সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন।
তৃতীয় অধ্যায়ে ল্যাং রাসূল সা: এবং হাদিসশাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন। হাদিসের সব ধরনের সমালোচনার তিনি উত্তর দিয়েছেন। জাল হাদিস ও দুর্বল হাদিস চিহ্নিত করার জন্য মুসলিম পণ্ডিতদের অসাধারণ প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেছেন। এ কাজ এখনো জারি আছে। এ প্রসঙ্গে আমরা ড. ইউসুফ আল-কারযাভীর ‘সুন্নাহর সান্নিধ্যে’ বইয়ের উল্লেখ করতে পারি। সেখানে তিনি সুন্নাহ যাচাই ও গ্রহণের ৯টি নীতির কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে, কুরআনের আলোকে হাদিস বুঝতে হবে; কুরআনবিরোধী কোনো হাদিস গ্রহণযোগ্য নয়। এ অধ্যায়ে আলোচ্য লেখক উল্লেখ করেন, রাসূল সা:কে কুরআনের আলোকে চিনতে হবে এবং তার সম্পর্কে অপ্রামাণ্য কোনো কাহিনী গ্রহণ করা যাবে না (পৃ.১০৬-৮)।
চতুর্থ অধ্যায়ে জেফরি ল্যাং মুসলিম উম্মাহ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ইসলাম ভৌগোলিক পরিচয় এবং গোত্রবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি। এখানে কালো-সাদা পার্থক্য নেই। পরিবারকে ইসলাম সার্বিকভাবে শক্তিশালী করতে চেয়েছে।
এ অধ্যায়ে তিনি নারীদের প্রসঙ্গেও ব্যাপকভাবে আলোচনা করেছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, আল্লাহর খলিফা হিসেবে, মানুষ হিসেবে এবং মুসলিম হিসেবে নারী-পুরুষ সমান। মানুষের মর্যাদা নির্ধারিত হয় তাকওয়ার ভিত্তিতে; নারী-পুরুষ হিসেবে নয়। তিনি মনে করেন, মুসলিম সমাজে নারীর অবস্থা তত ভালো নয়; তাদের ওপর বিধিনিষেধ অনেক বেশি। কুরআনের আলোকে তাদের অবস্থা আরো উন্নত করতে হবে। এ ছাড়া তিনি মুসলিম নারীর পোশাক, নারীর নেতৃত্ব, নারীর সাক্ষ্য, নারীদের বিভিন্ন অভিযোগ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এসব ব্যাপারে তিনি ড. জামাল বাদাবির মত সমর্থন করেছেন।
ল্যাং এ অধ্যায়ে জিহাদ ও রিদ্দা (ধর্মত্যাগ) নিয়ে আলোচনা করেছেন। রিদ্দা বা ইসলাম ত্যাগের ব্যাপারে তিনি ওই সব মুসলিম পণ্ডিতের মত সমর্থন করেছেন, যারা বলেছেন, ‘ইসলাম ত্যাগ করে যারা ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে না, তাদের কোনো শাস্তি হবে না।’
বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তাবিদদের ভিন্নমত থাকা অস্বাভাবিক নয়। এ বইটি সবার পড়া উচিত বলেই মনে করি।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার।