দেশজুড়ে বেড়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। প্রতিদিনই সরকারি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রেকর্ড সংখ্যক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছেন। তাতে চিকিৎসা দিতেও বেশ হিমসিম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের অনেকেই রক্ত দেয়ার প্রয়োজন হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে খবর নিয়ে জানা গেছে, শুধু ডেঙ্গু নয়, যেকোনো রোগীর জন্য প্রয়োজনীয় রক্তের কোনো সংকট নেই। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগীর স্বজনরা ব্যক্তিগতভাবে রক্তের প্রয়োজন মেটাচ্ছেন।
রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে হানিফ মিয়ার চার বছরের মেয়ে তুলতুল। গত তিনদিন থেকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে সে।
গতকাল সোমবার সকাল থেকে রক্ত খুঁজছেন তুলতুলের বাবা। আত্মীয়দের কয়েকজনকেও জানিয়েছেন। কেউ কেউ রক্ত দেবেন বলে জানান। তবে হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক রেখে বাইরে থেকে রক্ত কেন জানতে চাইলে তুলতুলের বাবা হানিফ মিয়া বলেন, শুনেছি হাসপাতালের রক্ত নাকি নিরাপদ না। অনেক নেশাগ্রস্ত লোক রক্ত বিক্রি করে। তাই মেয়ের জন্য নিজস্ব মানুষদের মধ্যে রক্ত খুঁজছি। ডাক্তাররা বলেছিল। কিন্তু আমি নিই না।
এই হাসপাতালেরই আরেক রোগীর স্বজন শহিদ আহমেদ বলেন, আমার ছোট ভাই গত দুই দিন হলো ভর্তি হয়েছে। ও নেগেটিভ ব্লাড দরকার। কিন্তু হাসপাতালে এক ব্যাগ পাওয়ার পর আর পাচ্ছি না। এখন আত্মীয়দের সবাইকে জানালাম। আমার বন্ধুদেরও বলেছি। কিন্তু ওর প্লাটিলেটের যে অবস্থা তাতে খারাপ দিকেই যাচ্ছে। রক্ত আরো লাগবে। চলতি সপ্তাহেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১ বছর বয়সী শিশু স্বজন। শিশুটির অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক। স্বজনের জন্য রক্ত লাগছে প্রতিদিনই। তার মা সালমা মাসুদা শিলা রক্তের খোঁজে ফেসবুক থেকে শুরু করে সব আত্মীয়দের জানান দিচ্ছেন। তিনি জানান, পরিচিতদের কাছ থেকে রক্ত খুঁজছি। কেউ দিচ্ছে কেউ পারছে না। হাসপাতাল থেকে সংগ্রহ করছেন না কেন জানতে চাইলে স্বজনের মা বলেন, হাসপাতালের রক্ত ‘সিকিউরড’ নয়। কার না কার দেয়া। তাই পরিচিতদের কাছ থেকে নিচ্ছি। একটু কষ্ট হচ্ছে। কেউ সময়ের কারণে দিতে পারছেন না। আবার কেউ ঢাকার বাইরে থাকায় পারছেন না। তাই ঝামেলা হচ্ছে। প্রথম দুইদিন বেশি কষ্ট হয়েছে। ছেলেটা অবস্থা খুব খারাপ ছিল। খুব চিন্তিত হয়ে পড়ি। এখন একটু ভালোর দিকে।
সরজমিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাই বেশি। অনেকেরই জরুরি রক্তের প্রয়োজন। এদের কারো কারো ক্ষেত্রে ‘নেগেটিভ’ গ্রুপের রক্ত হওয়ায় হাসপাতাল থেকে বেশি পাচ্ছেন না। আবার কেউ কেউ হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত সংগ্রহ করছেন না। তারা বাইরে থেকেই স্বজনদের জন্য রক্তের ব্যবস্থা করছেন। মো. গনি নামের এক রোগীর স্বজন বলেন, আমার ছেলের ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। গত তিনদিন থেকে হাসপাতালে ভর্তি। রক্তের জন্য অনেক জায়গায় ঘুরছি। আত্মীয়দের কয়েকজন দিয়েছে। এখন আরো তিন ব্যাগ লাগবে। দেখি হয়তো ম্যানেজ হয়ে যাবে। পঞ্চগড় থেকে ছেলেকে নিয়ে এসেছেন শাহিনা বেগম। ছেলে তুর্য ডেঙ্গু আক্রান্ত। রোববার রাতে ভর্তির পর থেকে তার রক্ত লাগছে। ঢাকায় আত্মীয়রা রক্ত দিচ্ছেন তুর্যকে। তবে তার জন্য আরো রক্ত লাগবে। শাহিনা বেগম বলেন, পঞ্চগড়ে হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারিনি। সিট পাইনি। ঢাকায় নিয়ে এসে রক্তের জন্যই বিপাকে পড়লাম। এখানে কয়েকজন বন্ধু ও আত্মীয়রা থাকেন। তারাই জোগাড় করে দিচ্ছেন। এদিকে, হাসপাতালে রক্তের চাহিদা বেশি থাকলেও সে অনুযায়ী রোগীদের পর্যাপ্ত রক্ত দিতে পারার মতো ব্যবস্থা রয়েছে বলে জানিয়েছেন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের ডিজি ( মেডিকেল) ডা. স্বপন কুমার বর্মণ। তিনি মানবজমিনকে বলেন, ডেঙ্গুর কারণে এখন অনেক রোগী ভর্তি হচ্ছেন। অনেকেরই রক্তের দরকার হচ্ছে। আমাদের হাসপাতাল থেকে রক্তের কোনো ঘাটতি নেই। রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করার জন্য যা যা করার সবই করছি। তবে কেউ যদি নিজস্ব ডোনারের মাধ্যমে রক্তের ব্যবস্থা করেন সেটা তাদের ব্যাপার। সেচ্ছাসেবী রক্তদাতা সংগঠন বাঁধনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. জুনাহিদ এ বিষয়ে বলেন, ডেঙ্গুর প্রভাবে রক্তের চাহিদা বেড়েছে। আমাদের আগে যে হারে রক্ত লাগতো তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি এই মাসে লাগছে। তবে সংকট তৈরি হয় নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের দরকার হলে। তারপরও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে রক্ত সংগ্রহের ব্যবস্থা করি।