আসন্ন ঈদুল আজহাকে ঘিরে রাজধানীতে মৌসুমী অপরাধীর দৌরাত্ম বাড়ছে। ঈদ আসলেই এ চক্রগুলো বেশি সক্রিয় হয়ে যায়। প্রতিদিনই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এসব মৌসুমী অপরাধীদের কার্যক্রম। বাস টার্মিনাল, লঞ্চঘাট আর রেলস্টেশনে, চলতি পথে, মার্কেট-বাজারে অজ্ঞান পার্টি, থুথু পার্টি, ধাক্কা পার্টি, সালাম পার্টির সীমাহীন দৌরাত্মে অসহায় সাধারণ মানুষ। এরা বিভিন্ন কৌশলে প্রতারণা করছে সাধারণ মানুষের সাথে। কখনো অচেতন করে, আবার কখনো অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে এরা লুটে নিচ্ছে টাকা-পয়সাসহ মূল্যবান সম্পদ। শুধু টাকা-পয়সা বা মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে এরা ক্ষান্ত হচ্ছে না, সামান্য বাধা পেলেই কারো প্রাণ নিতেও দ্বিধা করছে না। অজ্ঞানপার্টি-ছিনতাইকারীর পাশাপাশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে জাল টাকার ব্যবসায়ীরা।
এদিকে, লোকাল বাস স্টেশনে সক্রিয় রয়েছে পকেটমার চক্রের কয়েকশ’ সদস্য। নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে ওঁৎ পেতে আছে চাঁদাবাজ চক্র। বুধবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের বিভিন্ন বিভাগের একাধিক টিম গত ২৪ ঘণ্টায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে অজ্ঞান পার্টির ৪০ সদস্যকে গ্রেফতার কররেছে। এরমধ্যে গোয়েন্দা দক্ষিণ বিভাগ ১৯জন, পশ্চিম বিভাগ ৭ জন ও সিরিয়াস ক্রাইম বিভাগ ১৪ জন অজ্ঞান পার্টির সদস্যকে গ্রেফতার করেছে।
এছাড়া ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পূর্ব বিভাগের একটি টিম নগরীর ফকিরাপুল ও সবুজবাগে অভিযান চালিয়ে ৯০ লাখ টাকার জাল নোটসহ চারজন জাল নোট কারবারীকে গ্রেফতার করেছে। গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগের একটি টিম বুধবার মধ্যেরাতে মাতুয়াইলে বিশেষ অভিযান চালিয়ে ভারতীয় জাল রুপি, জাল রুপি তৈরীর সরঞ্জামাদিসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে।
পুলিশ বলছে, ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে মৌসুমি অপরাধীর দৌরাত্ম কিছুটা বাড়ে। তবে তাদের ধরতে পুলিশ কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ঈদকে কেন্দ্র করে বিশেষ অভিযানে শতাধিক ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ ও অজ্ঞানপার্টির সদস্য গ্রেফতার করা হয়েছে। নিরাপত্তায় নেয়া হয়েছে ভিন্নধর্মী কৌশল। অপরাধীদের ধরতে প্রযুক্তির পাশাপাশি পুলিশ ছদ্মবেশে অভিযান চালাচ্ছে। ফুটপাতের চা-সিগারেট বিক্রেতা ও সিএনজি চালকের বেশে তারা ছিনতাইকারী ও অজ্ঞানপার্টির সদস্যদের ধরতে ফাঁদ পেতেছে। পুলিশের পাতা গোয়েন্দা ফাঁদে ধরা পড়ছে অপরাধীরা। আর অর্ধশতাধিক পয়েন্টকে ক্রাইম হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। টহল ও চেকপোস্ট বাড়ানো হয়েছে নগরজুড়ে। এছাড়াও ডিএমপির পক্ষ থেকে অজ্ঞান পার্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে জনসাধারণকে সচেতনতামূলক পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কাজ করছে না। প্রতিদিনই রাজধানীতে ছিনতাই-চাঁদাবাজি ও অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ছে পথচারীরা। ছিনতাইকারী বা অজ্ঞানপার্টির হাতে আহত ব্যক্তিরা চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গেলে ঘটনা প্রকাশ পায়। কিন্তু আহত করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে কম। অস্ত্র ঠেকিয়ে বেশি ছিনতাই হয়। কখনও কখনও পরিচিত ব্যক্তির ভান করে থামিয়ে ছিনতাই হয়। ছিনতাইয়ের শিকার বেশিরভাগ মানুষই হয়রানি ও ঝামেলার আশঙ্কায় মামলা করেন না। ফলে ছিনতাইয়ের মামলা হয় কম। মামলা হলেও ছিনতাইকৃত টাকা উদ্ধার করতে পারে না পুলিশ। আবার কেউ কেউ মামলা করতে গেলেও থানা তা নেয় জিডি হিসেবে। ফলে ছিনতাইয়ের প্রকৃত হিসাব পুলিশের কাছেও থাকে না। ছিনতাইয়ের পাশাপাশি ঈদ সামনে রেখে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে চাঁদাবাজি। পেশাদার অপরাধী থেকে মৌসুমি অপরাধী, রাজনৈতিক প্রভাবশালী থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কোনো কর্মকর্তা চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, সাধারণত ঈদে অজ্ঞানপার্টি, ছিনতাই ও জাল টাকা চক্রের আনাগোনা বেড়ে যায়। তাই জনসাধারণের নিরাপত্তায় সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। ডিবি পুলিশের টিম কয়েক স্তরে ভাগ হয়ে দায়িত্ব পালন করছে। শপিংমল ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরাপত্তার পাশাপাশি অলিগলিতেও নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেনে সহায়তার জন্য প্রস্তুত রয়েছে পুলিশের মানি স্কট। জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালয়ে অজ্ঞান পার্টির ৪০ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এসময় তাদের কাছ থেকে চেতনানাশক ট্যাবলেট, ট্যাবলেট মিশ্রিত খেজুর, হালুয়া ও জুস উদ্ধার করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেন, আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট-শপিংমল, পশুর হাট, বাসস্ট্যান্ড, সদরঘাট ও রেলস্টেশন এলাকায় আগত ব্যক্তিদের টার্গেট করতো গ্রেফতারকৃতরা। টার্গেটকৃত ব্যক্তির সঙ্গে সখ্যতা স্থাপন করে চেতনানাশক ট্যাবলেট মিশ্রিত খাবার খাইয়ে সর্বস্ব লুট করে নিতো। এক্ষেত্রে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা খাদ্যদ্রব্য হিসেবে চা, কফি, জুস, ডাবের পানি, পান, ক্রিম জাতীয় বিস্কুট ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে।
এছাড়া বুধবার মধ্যেরাতে মাতুয়াইলের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ভারতীয় জাল রুপি, জাল রুপি তৈরির সরঞ্জামাদিসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দারা। তারা হলেন- হোসেন ওরফে জাকির, শান্তা আক্তার ও মমতাজ বেগম। এ সময় তাদের কাছ থেকে ভারতীয় ২০০০ টাকা মূল্যমানের সর্বমোট ২৬ লাখ জাল রুপির নোট এবং জাল রুপি তৈরির কাজে ব্যবহৃত ১টি ল্যাপটপ, ০১ টি কালার প্রিন্টার, ১টি লেমিনেশন মেশিন, জাল রুপি তৈরির বিপুল পরিমাণ কাগজ, প্রিন্টারে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের কালির কার্টিজ, সিকিউরিটি সিল সম্বলিত স্ক্রীন বোর্ড, গাম ও ভারতীয় জাল রুপি বানানোর জন্য ব্যবহৃত সিল মারা ফয়েল পেপার উদ্ধার করা হয়।
এদিকে গোয়েন্দা পুলিশের অন্য একটি টিম ফকিরাপুলে অভিযান চালিয়ে ৫০ লাখ জাল নোটসহ লাল মিয়া ও শহিদুল ইসলামকে গ্রেফতার করে। ওই রাতেই অপর একটি টিম সবুজবাগে অভিযান চালিয়ে ৪০ লাখ ২০ হাজার জাল নোটসহ আবিদা সুলতানা ও আল আমিনকে গ্রেফতার করে। এ চক্রটি আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে গরুর হাটসহ বিভিন্ন এলাকায় জাল টাকা সরবরাহ করত।
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেন, গ্রেফতারকৃতরা আসন্ন কোরবানির ঈদে পোশাক ও গরু আমদানির কাজে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে জাল ভারতীয় রুপি পাচার করে আর্থিকভাবে লাভবান হবার উদ্দেশ্যে সক্রিয় হয়। চক্রটির মূল হোতা লিয়াকত হোসেন ওরফে জাকির। সে বিভিন্ন স্থান হতে জাল রুপি তৈরির প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবরাহ এবং প্রস্তুতকৃত জাল ভারতীয় রুপি দেশের সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের আগ্রহী ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করত। শান্তা আক্তার ও মমতাজ বেগম জাল রুপি তৈরীর দক্ষ কারিগর ছিল। তারা জাল ভারতীয় রুপির সাথে আসল রুপির পার্থক্য সুচারুরূপে প্রায় নির্ভুলভাবে জাল রুপি তৈরী করত। প্রায় ১০ বছর যাবত নোট জালিয়াতির সাথে যুক্ত এই চক্রটি।
তিনি আরো বলেন, প্রথম দিকে এই চক্রটি বাংলাদেশি নোট জালয়াতিতে যুক্ত থাকলেও সম্প্রতি ভারতীয় রুপি জালিয়াতিতে যুক্ত হয়। তারা গ্রেফতার এড়াতে বারবার বাসা পরিবর্তন করত । কোন বাসাতেই ২/৩ মাসের বেশি থাকত না। তারা বাসা ভাড়া নেয়ার ক্ষেত্রে বহুতল ভবনের উপরের দিকের ফ্ল্যাটই বেছে নিত, কেননা উপরের দিকের ফ্ল্যাটে লোক যাতায়াত কম থাকে। সম্প্রতি শেষ হওয়া ডিএমপি’র উদ্যোগ ‘নাগরিক তথ্য সংগ্রহ সপ্তাহ’ তে পুলিশের সক্রিয় নজরদারি বাড়ার কারণে এই চক্রটি মাত্র ৩ দিনের মাথায় একটি নতুন বাসা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। এছাড়া জাল নোট তৈরির চক্রটির টার্গেট ছিলো ঈদকে সামনে রেখে গরুর হাট। বিপুল অর্থের লেনদেনের সুযোগে জাল নোট ছড়িয়ে দেয়ার টার্গেট করেছিলো চক্রটি। জাল নোট ও জাল রুপির বিরুদ্ধে ডিবির এ অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার।