ডেঙ্গুর প্রকোপ ও এডিস মশার বিস্তার রোধে দুই সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে গাফিলতি ও ব্যর্থতার অভিযোগ থাকলেও প্রধানমন্ত্রী তা নাকচ করে বলেছেন, সংবাদমাধ্যমে ডেঙ্গু বিষয়ক খবর অনেক বেশি প্রকাশিত হচ্ছে এবং এর ফলে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে, আর সেটাই সমস্যা সৃষ্টি করছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটু উচ্চবিত্ত যারা, সেইসব জায়গাগুলোতেই এর প্রকোপ বেশি। আমাদের সবসময় লক্ষ্য থাকে বস্তি এলাকা, ড্রেন এসব দিকে। মশা মারা কিন্তু নিয়মিত একটা ব্যাপার।’
শুধু সিটি করপোরেশনকে দোষ না দিয়ে সব মানুষকে সতর্কতা অবলম্বন করতে আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। মশার ওষুধ কেনায় দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে, তাও তিনি নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মশার ওষুধ কেনার ব্যাপারে টেন্ডার করা হয়। যারা টেন্ডারে উপযুক্ত হয়, তারা কিনে নিয়ে আসে এবং সেগুলো ব্যবহারও হয়। তবে কোন ওষুধ এডিস মশার ওপরে কাজ করে, সেই ব্যাপারে বিভক্তিকরণ করা হয়নি বা সেই ধরনের সতর্কতা ছিল না।’
প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সরকারি হিসাবেই বলা হচ্ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ২৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে এবং এর সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে কীভাবে ভবিষ্যতে মশা নিয়ন্ত্রণ আরও সুষ্ঠুভাবে করা যায়?
এই প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং সরকারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরও পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাতে আহ্বান করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘শুধু ঢাকা নয়, পুরো দেশেই একটা পরিচ্ছন্নতা অভিযান দরকার।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারো ঘরের কাছে বা ঘরে কোথাও যদি পানি জমা থাকে এবং সেখানে মশার লার্ভা তৈরি হয়, তবে তাদের জরিমানা করা হবে। মানুষ যদি আগামীর জন্য প্রস্তুত থাকে, তবে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি হবে না বলে মনে করেন তিনি।
সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়েও কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, যেসব দেশ দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ তাদের একটি, কিন্তু এর সুফল সব পর্যায়ের মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে কিনা? জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অবশ্যই পৌঁছাচ্ছে। সেভাবেই আমরা পরিকল্পনা নিয়েছি। ২০০৫ বা ২০০৬ সালের দিকে আমাদের দারিদ্র্যের হার ৪১ ভাগের ওপরে ছিল। আজকে সেটা ২১.৪ ভাগে নেমে এসেছে। মাত্র ১০ বছরের মধ্যে আমরা সেটা অর্জন করতে পেরেছি। মানুষের মাথাপিছু আয় যেখানে ৪০০/৫০০ মার্কিন ডলার ছিল, আজকে সেখানে প্রায় ২ হাজার মার্কিন ডলারে সেটি উঠে এসেছে। প্রবৃদ্ধি আমরা এখন ৮.১ শতাংশ অর্জন করতে পেরেছি।’
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন বেশ নাজুক অবস্থায় আছে এবং ঋণখেলাপিরা হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে তা আর ফেরত দিচ্ছে না—এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শেখ হাসিনা বলেন, যতটা প্রচার হয় বিষয়টা ততটা না। ঋণ নিয়ে সেটা ফেরত না দেওয়া, এই কালচারটাও আমাদের এখানে শুরু হয় সামরিক স্বৈরাচারদের আমলে। যখন ক্ষমতায় এসেছি আমরা চেষ্টা করেছি, আমরা অনেক টাকা উদ্ধার করেছি। তারপরও কিছু মানুষের প্রবণতা থাকে যে, টাকা দিলে মনে হয় সেটি আর ফেরত দিতে হবে না।’
পদ্মা সেতুতে মানুষের কাটা মাথা লাগার গুজব এবং এর জেরে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যুর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রধানমন্ত্রী গুজবে কান না দেওয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। তিনি আরও জানান, যারা গুজব ছড়াচ্ছে, এরকম কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে। আপনিই বলুন আজকের দিনে, পদ্মা সেতুতে কাটা মাথা ও রক্ত লাগবে বলে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। রক্ত আর কাটা মাথা দিয়ে কি সেতু তৈরি হয়? এই গুজবটা যারা ছড়াচ্ছে, অপরাধী তো তারা।’ পদ্মা সেতুর ব্যাপারে শুরু থেকেই একটা চক্রান্ত ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মান ও এর চর্চা যেভাবে হচ্ছে তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের প্রশ্নের বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, দেশে এখন ৪৪টি প্রাইভেট টেলিভিশন আছে এবং তারা স্বাধীনভাবে কাজ করছে। স্বাধীনতা না থাকলে তারা আমার বিরুদ্ধে বা সরকারের বিরুদ্ধে এত অপপ্রচার করছে কীভাবে।
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অনেক কেন্দ্রে ১০০ শতাংশ ভোট পড়েছে এবং এ নিয়ে যে সমালোচনা রয়েছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেটা এখন কোনও কেন্দ্রে গোনার দিক থেকে হয়তো পেয়েছে। কোনও কেন্দ্রে হয়তো হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু আমাদের ট্রাইব্যুনাল আছে, সেখানে মামলা করতে পারে, কোর্টে মামলা করতে পারে। নির্বাচন কমিশনেও মামলা করতে পারেন। তারা তদন্ত করে দেখছেন।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষ যদি সত্যিই ভোট দিতে না পারতো, তাহলে তাদের ডাকা সাড়া দিয়ে মানুষ আন্দোলনে নামতো এবং আমরা ক্ষমতায় থাকতে পারতাম না।’
দেশে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন বন্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের পদক্ষেপের বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এমন মানসিকতা আমাদের নেই এবং আমরা সেটি করি না। ঘটনাচক্রে কিছু ঘটতে পারে। বরং আপনি যদি গত ১০ বছরে আমাদের অবস্থান দেখেন, আমরা কিন্তু অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পেরেছি।’
তিনি বলেন, ‘আপনি আমার নিজের কথাই চিন্তা করেন, যখন আমি আমার বাবা-মা সবাইকে হারালাম, গুলি করে মারা হলো। কই আমি তো বিচার পাইনি। খুনিদের বিচার না করে তাদের ইনডেমনিটি দেওয়া হলো। অর্থাৎ অপরাধকে প্রশ্রয় দিলেন। উল্টো তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যে দেশে অপরাধকে স্বীকৃতি দিয়েই একটা সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়, সেই দেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। হেফাজতে মানুষ হত্যা করার সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী আমার দলের নেতাকর্মীরা।’
নির্যাতনের সংস্কৃতি বন্ধে সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি। এখন ঠিক ওইভাবে হেফাজতে মৃত্যু হয় না। নির্যাতনও সেভাবে করা হয় না।’ তবে আন্তর্জাতিকভাবে অপরাধীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহে কিছু নিয়ম রয়েছে, এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর বাইরে কিছু করা হয় না। আওয়ামী সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন তিনি।
শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন, স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে দেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতিকে হত্যার ঘটনার পর থেকে অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়ার সংস্কৃতি শুরু হয়েছে। অসাংবিধানিক সরকারের সময় যারা বেশি সুযোগ ভোগ করেছে বা ক্ষমতাটা যারা উপভোগ করেছে, তারা কখনোই চায়নি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকুক। তিনি বলেন, ‘একটা শ্রেণি হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাদের মধ্যে কিছু আছে যারা অসাংবিধানিক সরকার, জরুরি অবস্থা অথবা মার্শাল ল’ বা মিলিটারি রুলার আসলে তাদের খুব দাম বাড়ে। কাজেই তারা সারাক্ষণ খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আমাদের পেছনে লেগেই আছে।’