প্রভাবশালীরা এতদিন সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দিতেন না। এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও এই প্রবণতা সংক্রমিত হয়েছে। তারা বেসরকারি ব্যাংকের টাকাও মেরে দেওয়া শুরু করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এ ধরনের তথ্য উঠে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবছরের মার্চ প্রান্তিকের তুলনায় জুন প্রান্তিকে সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ কমলেও বেড়ে গেছে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ। শুধু বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকা। গত মার্চ মাসের শেষে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ০৮ শতাংশ। জুনের শেষে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক র১৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ছয় মাসে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব মতে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা (অবলোপন ছাড়া)। এবছরের জুন শেষে অবলোপন বাদেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ মাসের শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ছিল ৫৩ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা বা ৩২.২০ শতাংশ। জুন প্রান্তিকে এসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা বা ৩১.৫৮ শতাংশ। একইভাবে গত মার্চ পর্যন্ত বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ২৫৬ কোটি টাকা বা ৬.২০ শতাংশ। জুন শেষে তা কমে হয়েছে দুই হাজার ৫৭ কোটি টাকা বা ৫.৪৮ শতাংশ। এ সময়ে বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। আগের প্রান্তিকে তাদের খেলাপি ঋণ ছিল চার হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারি ব্যাংকের রোগ এখন বেসরকারি ব্যাংকেও সংক্রমিত হয়েছে। প্রভাবশালীরা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মতোই বেসরকারি ব্যাংকের টাকাও লুটপাট শুরু করেছে। এর ফলে বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন পর হয়তো বেসরকারি ব্যাংকগুলোকেও বাজেট থেকে ভর্তুকি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।’ এরইমধ্যে বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংককে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি দিয়েই বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রভাবশালীরা অব্যাহতভাবে লুটপাট করার কারণে সরকারি ব্যাংকগুলোতে এখন আর্থিক সংকট চলছে। যে কারণে তাদের নজর এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোর দিকে। এরইমধ্যে বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক বলে পরিচিত ইসলামী ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা তুলে নেওয়ার কারণে এই ব্যাংকটিতেও আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে। এই ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণও এখন সবচেয়ে বেশি।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের মাঝামাঝি থেকে ইসলামী ব্যাংকের মালিকানায় পরিবর্তন আসে। তারপর থেকে ব্যাংকটির বিভিন্ন সূচকে অবনতি হতে থাকে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, তহবিল সংকটের কারণে ইসলামী ব্যাংক বর্তমানে আগের মতো ঋণ দিতে পারছে না। অন্যদিকে, বিতরণ করা ঋণও আগের মতো ফেরত আসছে না। ফলে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ এখন ইসলামী ব্যাংকের। গত মার্চ শেষে ইসলামী ব্যাংকের খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৮. ৮৩ শতাংশ। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংকটির খেলাপির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত এই তিন মাসে ব্যাংকিং খাতে নতুন করে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। আর জুন মাসের শেষে অবলোপন বাদেই খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ ছিল ৯০ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা। এই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এ বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৬২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবলোপন বাদে খেলাপি হয়েছে এক লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। এটা মোট বিতরণ করা ঋণের ১১.৬৯ শতাংশ। এর বাইরে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত অবলোপন করা খেলাপি ঋণ রয়েছে ৪০ হাজার ১০১ কোটি টাকা। এটি যোগ করলে ব্যাংকিং খাতে এখন প্রকৃত খেলাপি ঋণ প্রায় এক লাখ ৫২ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা।
আগের প্রান্তিক মার্চ পর্যন্ত অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের ১১.৮৭ শতাংশ ছিল। ফলে গত মার্চ থেকে জুন এই তিন মাসে নতুন করে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় এক হাজার ৫৫২ কোটি টাকা।