গণতন্ত্রের শরীরটা ভালো নেই। দেশে দেশে জাতীয়তাবাদী নেতাদের উত্থান। এমনকি এই প্রশ্নও উঠেছে যে, গণতন্ত্র কি মারা যাচ্ছে? প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডেভিড রাঞ্জিম্যান ‘কীভাবে গণতন্ত্রের বিনাশ হবে’ শীর্ষক বইতে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। তার জবাব চমকপ্রদ। রাঞ্জিম্যানের ভাষ্য- গণতন্ত্র মারা যাচ্ছে না, কিন্তু এটি অনিশ্চিত মধ্যবয়সের সংকটে পড়েছে। তার মতে, বেশিরভাগ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং হতাশার শুরু ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট থেকে। তারই জের ধরে রাজনীতিতে যেসব ভূমিকম্প হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ডনাল্ড ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া এবং বৃটেনের ব্রেক্সিট গণভোট। ঘটনার পাঁচ বছর আগেও কেউ ভাবতে পারেনি, এগুলো ঘটতে পারে।
এখন সবার মধ্যেই এই অনুভূতি কাজ করছে যে, আমরা এমন কিছুর ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, যা আসলে আমরা বুঝতে পারছি না। কেউ কোন আগাম ধারণ করতে পারছে না। এটাই কি শেষ? সবাই জানতে চায়, এরপর কি হতে যাচ্ছে? র্যাঞ্জিমানের এই বয়ানের বাইরেও গণতন্ত্রের নামে হরেক কিসিমের শাসন ব্যবস্থা চালু হয়েছে দেশে দেশে।
ব্রেক্সিট গণভোটের মাধ্যমে বিলাতের রাজনীতিতে যে ঝড় শুরু হয়েছিল তা আজও থামেনি। এরই মধ্যে দুই জন প্রধানমন্ত্রী এই ঝড় সামলাতে না পেরে বিদায় নিয়েছেন।
বরিস জনসনের আসনও নড়বড়ে। ‘মাদার অব পার্লামেন্টস’ এ মিনিটে মিনিটে পরিস্থিতি পরিবর্তন হচ্ছে। এতো সব সংকট আর নাটকীয়তার মধ্যেও গণতন্ত্র তার স্বমহিমায় হাজির হয়েছে। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এক পার্লামেন্ট এটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে, একটি পার্লামেন্ট কী করতে পারে আর কী পারেনা! পার্লামেন্টের ক্ষমতার কাছে প্রধানমন্ত্রী যেন অসহায়! বরিস জনসন একের পর এক পরাজয় বরণ করছেন পার্লামেন্টে। নিজ দলের একটি অংশও ভোট দিচ্ছে তার বিরুদ্ধে। মুসলিম নারীদের বোরকা নিয়ে মন্তব্য করে পার্লামেন্টে জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে।
একের পর এক ভোটে পরাজিত হয়ে বরিস জনসনের কণ্ঠে হতাশা। তিনি বলেছেন, সরকারের আনা একের পর এক প্রস্তাব যদি পার্লামেন্ট পাস না করে তাহলে সরকার পরিচালনা করা পুরোপুরি অসম্ভব। বুধবার রাতে বিরোধী দল ও ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের বিদ্রোহী এমপিরা ‘নো-ডিল ব্রেক্সিট’ বা চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট বন্ধের প্রস্তাব উত্থাপন করেন পার্লামেন্টে। এ বিল পাস করেছে পার্লামেন্ট। ব্রেক্সিট প্রশ্নে সরকারের ভূমিকা কি হবে তা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে এই বিলে। এই বিলে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একটি সমঝোতা করে পার্লামেন্টে ফল নিয়ে আসতে না পারেন, তাহলে তাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে ফিরে যেতে হবে। তাদেরকে অনুরোধ জানাতে হবে, ব্রেক্সিটের সময়সীমা ২০২০ সালের ৩১শে জানুয়ারি পর্যন্ত পিছিয়ে দিতে। ইউরোপীয় ইউনিয়নকে এই অনুরোধ জানানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যে চিঠি পাঠাবেন তার ভাষা কী হবে তা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে এই বিলে। এর মধ্য দিয়ে বুধবার রাতে প্রথম দফা পরাজয়বরণ করেন জনসন। বিলটি পাস হওয়ার পর বরিস জনসন আগাম নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব আনেন।
এই প্রস্তাবটি পাস হতে প্রয়োজন হয় দুই-তৃতীয়াংশ এমপি’র সমর্থন। কিন্তু তার প্রস্তাব এই পরিমাণ সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়। ফলে তার ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়। এ অবস্থায় পাস হওয়া ‘নো-ডিল ব্রেক্সিট’ বা চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট আটকে দিয়ে পার্লামেন্ট যে বিল পাস করেছে তাকে এক অর্থে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে আত্মসমর্পণ বলে বর্ণনা করেছেন বরিস জনসন। ওই বিল পাসের পর তিনি আগামী ১৫ই অক্টোবর নির্বাচনের প্রস্তাব আনেন। কিন্তু বৃটেনে এখন যে ‘ফিক্সড টার্ম পার্লামেন্ট অ্যাক্ট’ রয়েছে তাতে বলা আছে যে, একটি পার্লামেন্ট যে মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হবে সেই মেয়াদ পর্যন্ত থাকবে। যদি আগাম নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হয় তাহলে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সমর্থন লাগবে। কিন্তু আগাম নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তিনি দ্বিতীয় দফায় পরাজিত হন বুধবার রাতে।
বিবিসি লিখেছে, আগাম নির্বাচনের প্রস্তাব রেখে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে এটা নজিরবিহীন যে, সরকার নির্বাচন দিতে চাইছে আর বিরোধী দল তা প্রত্যাখ্যান করছে। তবে বিরোধী দল লেবার পার্টি বলছে, তারা আগাম নির্বাচনের বিরোধী নয়। গত দুই বছর যাবৎ লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন আগাম নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু এই মূহুর্তে লেবার পার্টির অগ্রাধিকার হচ্ছে ‘নো ডিল ব্রেক্সিট’ বন্ধ করা। ‘নো ডিল ব্রেক্সিট’ আটকে দিয়ে হাউজ অব কমন্সে যে বিল পাস হয়েছে সেটি এখন হাউজ অব লর্ডসে যাবে। এরপর রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সম্মতির জন্য তা পাঠানো হবে। এই সবগুলো ধাপ পার হবার যখন পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে যে, ‘নো ডিল ব্রেক্সিট’ আর হচ্ছে না, তখন নির্বাচনের ব্যাপারে বিরোধী দল লেবার পার্টির কোনো আপত্তি নেই।