ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গিয়ে প্রায় ৬৮ শতাংশ নারী সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে নতুন চার ধরনের সাইবার অপরাধের প্রবণতা বেড়েছে। অপরাধের শিকার হয়ে একটি বড় অংশই অভিযোগ করেন না। ‘বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের প্রবণতা” শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
আজ রোববার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিসিএ ফাউন্ডেশন)। সাইবার সচেতনতা মাস অক্টোবর ২০১৯ উপলক্ষে এই প্রতিবদেন প্রকাশ হয়। এতে সহ আয়োজক ছিল নবগঠিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থিংক ট্যাঙ্ক ফর সিকিউর ডিজিটাল বাংলাদেশ।
অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন সিসিএ ফাউন্ডেশনের সভাপতি কাজী মুস্তাফিজ। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে সমান্তরাল হারে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। সহিংস উগ্রবাদ, গুজব, রাজনৈতিক অপপ্রচার, মিথ্যা সংবাদ, গ্যাং কালচার, আত্মহত্যা, পর্নোগ্রাফি, সাইবার বুলিং, জালিয়াতি, চাঁদাবাজি, পাইরেসি, আসক্তি- এর সবই হচ্ছে প্রযুক্তির মাধ্যমে। বাস্তব জীবনে ঘটমান অপরাধগুলো এখন ডিজিটাল মাধ্যমে স্থানান্তরিত হচ্ছে।
প্রতিবেদন বলছে, কৃষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পর্যন্ত সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ ইন্টারনেট নেটওয়ার্কে যুক্ত হচ্ছেন। অথচ এই ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে একটি ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা হলেও বিশ্বনাগরিক হিসেবে ব্যবহারকারীদের সিংহভাগই সচেতন নন। ‘অন্তর্জালে’ যুক্ত হতে গিয়ে ইচ্ছে-অনিচ্ছায় জড়িয়ে পড়ছেন ‘ভ্রান্তির-জালে’। এভাবেই অপরাধের ডিজিটাল রূপান্তর মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের মধ্যে ১১ ধাপে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এর মধ্যে চারটিই নতুন ধারার অপরাধ। এই অপরাধের শিকার হওয়াদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ব্যক্তি পর্যায়ে ভুক্তভোগীদের মধ্যে চালানো জরিপে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে দেশে সাইবার অপরাধের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ফোনে বার্তা পাঠিয়ে হুমকি দেওয়ার ঘটনা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কপিরাইট আইন লঙ্ঘন, অনলাইনে পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে প্রতারণা এবং অনলাইনে কাজ করিয়ে নেয়ার কথা বলে প্রতারণা।
প্রতিবেদনটির তথ্যমতে, সাইবার অপরাধে আক্রান্তদের মধ্যে ফোনে বার্তা পাঠিয়ে হুমকির শিকার হচ্ছেন ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ। কপিরাইট লঙ্ঘনের মাত্রা ৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ দখল করেছে। অনলাইনে কাজ করিয়ে নিয়ে প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে ১ দশমিক ৪০ শতাংশ। জরিপের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এগুলো দেশে নতুন ধরনের অপরাধ। আর এতদিন পণ্য কিনে প্রতারণার শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটলেও এবার সামনে এসেছে এর ব্যতিক্রমী ঘটনা। অনলাইনে বিক্রীত পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে গিয়ে প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ।
সিসিএ ফাউন্ডেশনের ২০১৮ সালের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগের বছরের তুলনায় মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে পর্নোগ্রাফি। এই অপরাধ ২ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশে। অনলাইনে বার্তা পাঠিয়ে হুমকির ঘটনা ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচারের ঘটনা কিছুটা কমলেও এখনো তা আশঙ্কাজনক। ভুক্তভোগীদের ২২ দশমিক ৩৩ শতাংশই এই ধরনের অপরাধের শিকার হচ্ছেন। আগের প্রতিবেদনে এই হার ছিল ২৭ দশমিক ০৭ শতাংশ।
ছবি বিকৃত করে অনলাইনে অপপ্রচারের ঘটনা রয়েছে আগের মতোই। এবার এই হার ১৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
দেশে ই-কমার্সের জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রতারণাও। ভুক্তভোগীদের ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ এই অপরাধের শিকার, যা আগের প্রতিবেদনে ছিল ৮ দশমিক ২৭ শতাংশ। তবে সময়ের সঙ্গে অনলাইন ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনা কমেছে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।
জরিপে বয়সভিত্তিক সাইবার অপরাধে আক্রান্তের ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এদের মধ্যে বেশির ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের কম। পরিসংখ্যানে ভুক্তভোগীদের দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে শিশু। ১৮ বছরের কম বয়সী এই ভুক্তভোগীদের হার ১১ দশমিক ১৬ শতাংশ।
জরিপে অংশ নেওয়াদের একটি বড় অংশ বলেছেন, অপরাধের শিকার হয়েও তাঁরা আইনের আশ্রয় নেন না। এটা প্রায় ৮০ দশমিক ৬ শতাংশ। যারা আইনের আশ্রয় নেন তাঁদের মাত্র ১৯ দশমিক ২ শতাংশ আইনি সহায়তা চেয়ে ‘আশানুরূপ ফল’ পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
দেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতে ১০ দফা সুপারিশও তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে, নিয়মিত সচেতনতামূলক কার্যক্রম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাইবার পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা, অফিস-আদালত সৎ ও নৈতিক জনবল নিয়োগ নিশ্চিত করা, দক্ষ জনশক্তি তৈরি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে দক্ষ প্রশিক্ষিত জনবল বাড়ানো, সাইবার নিরাপত্তায় দেশি প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্ব দেওয়া, প্রযুক্ত সেবায় দেশি প্রযুক্তিকে জনপ্রিয় করা।
সিসিএ ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, গত প্রায় এক বছর ধরে ব্যক্তি পর্যায়ে ভুক্তভোগীদের প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে দক্ষ পর্যালোচনা এবং তাদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে এই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এতে ১৩৪ জন ভুক্তভোগীকে ১৮টি প্রশ্ন করা হয়। সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় জানতে চাওয়া হয়েছে, কোন ধরনের অপরাধের শিকার হয়েছেন, প্রতিকারের জন্য আইনের আশ্রয় নিয়েছেন কি না, প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা না নিলে তার কারণ, অভিযোগ করার পর তার অভিজ্ঞতা কী এবং প্রতিকারের জন্য কী করা উচিত বলে তিনি মনে করেন ইত্যাদি।
প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান বলেন, আমরা ব্যর্থতার জন্য সরকারকে দায়ী করি। ভোটাধিকার গেছে, সেটা নিয়ে কথা বলি, দরকার আছে। কিন্তু এসব নিয়ে যতটা চিন্তা করি, তার চেয়ে একদম সম্পূর্ণ ভিন্ন। নতুন জগৎ সাইবার ওয়ার্ল্ড, সেটি নিয়ে ততটা চিন্তা করি না।
মিজানুর রহমান খান বলেন, আইন আমাদের ১০ থেকে ২০ ভাগ সুরক্ষা দিতে পারে, বাকিটা সচেতনতার মাধ্যমেই করতে হবে। সাইবার জগতে পরিবারকে বাঁচাতে হবে নিজেকেই।
মিজানুর রহমান খান বলেন, আমাদের মায়েরা তার সন্তানকে স্কুলে-ভার্সিটিতে নিয়ে যায়। সমাজে মেয়েদের চোখে চোখে রাখা হয়। অথচ সেটি অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে যখন সন্তানের হাতে যখন ডিজিটাল ডিভাইস তুলে দিচ্ছেন, স্মার্ট ফোন দিয়ে দিচ্ছেন। হয়তো একটি রুমে তাকে আবদ্ধ করে রাখা হচ্ছে, কিন্তু তখন সে ইন্টারনেটের সুবিধা নিয়ে পুরো সাইবার জগতে বিচরণ করছে।
থিংক ট্যাংক ফর সিকিউর ডিজিটাল বাংলাদেশের আহ্বায়ক কম্পিউটার প্রকৌশলী সৈয়দ জাহিদ হোসেন বলেন, কম্পিউটার এখন আমাদের জন্য শৌখিন কোনো বস্তু নয়, নিত্য প্রয়োজনীয়। অপরাধীরা আগের মতোই অপরাধ করছে, তবে ধরন পরিবর্তন হয়েছে। ইন্টারনেটের সুন্দর সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে অপরাধীরা ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেয় এবং পরে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটায়। এর জন্য কোনো কারিগরি জ্ঞান দরকার হয় না। এগুলোকে বলে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। অপরাধীরা অর্থনৈতিক লাভের জন্য এসব করে।
প্রযুক্তিবিদদের আন্তর্জাতিক সংগঠন আইসাকা ঢাকা চ্যাপ্টারের ডিরেক্টর (মার্কেটিং) মাহবুব উল আলম বলেন, সন্তান সাইবার জগতে কার সঙ্গে মিশছে, তার বন্ধু কে, কার সঙ্গে যোগাযোগ করছে, এসব বাবা-মায়েদের খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, সাইবার খাতে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় নিজেদেরই নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য পেশাদার সাইবার নিরাপত্তা প্রকৌশলী তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মাহমুদা আফরোজ বলেন, দিন দিন সাইবার অপরাধ বাড়ছে। আমাদের অজান্তেই অনেক তথ্য অন্যের কাছে চলে যাচ্ছে। এ জন্য এসব বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো দরকার। ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে সচেতনতা অবলম্বন করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা সব সময় পরামর্শ দিই মেসেঞ্জারের গোপনীয় বিষয়গুলো ডিলিট করতে। কারণ, এমন বহু ঘটনা ঘটেছে যে, কারও ফেসবুক হ্যাক (বেদখল) করে মেসেঞ্জারের একান্ত ব্যক্তিগত গোপন তথ্য ও ছবি নিয়ে টাকা দাবি করা হচ্ছে।
সাংবাদিক শাহরোজা নাহরিন বলেন, দৈনন্দিন কাজের নানা ব্যক্তিগত তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়ে দিচ্ছি আমরা। অপরাধীরা এগুলো কাজে লাগাচ্ছে। শিশুদের হাতে স্মার্টফোন দিয়ে দেওয়ার পর সেখানে কার্টুন দেখার নামে কুরুচিপূর্ণ কনটেন্ট দেখানো হচ্ছে।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনায় ছিলেন সিসিএ ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক নুরুন আশরাফী।