বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতের বর্তমান গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। মার্কিন একটি পত্রিকাকে দেয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে খোলাখুলি জানালেন সে-কথা। সাক্ষাৎকারে নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ সরাসরি আক্রমণ করেছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। সাক্ষাৎকারে অমর্ত্য সেন বলেন,‘জন স্টুয়ার্ট মিলের কাছ থেকে বড় যে বিষয়টি আমরা জেনেছি তা হল, গণতন্ত্র মানে আলোচনার ভিত্তিতে চলা সরকার। ভোট যে ভাবেই গণনা করো, আলোচনাকে ভয়ের বস্তু করে তুললে তুমি গণতন্ত্র পাবে না।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ভারতে এখন একচেটিয়া কট্টর বা উগ্র হিন্দুত্বের দাপট চলছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্পর্কে নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদের মূল্যায়ন,‘বহু ধর্ম ও বহু জাতির দেশ ভারতকে বোঝার মতো মনের প্রসারই (জ্ঞান) নেই মোদির।’
এতো গেল মোদির ব্যর্থতা বা সমালোচনার কথা। কিন্তু ২০১৫ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোদির সব চেয়ে বড় সাফল্য কি? এমন প্রশ্নের উত্তরে অমর্ত্য সেনের উত্তর, ক্ষমতায় আসার পর মোদি নিজেকে গোধরা মামলা থেকে মুক্ত করেছেন। এর ফলে ২০০২-এর যে-ঘটনায় হাজারের বেশি মানুষ খুন হয়েছিলেন, তার পিছনে মোদির একটা ভূমিকা ছিল— ভারতে অনেকে তা বিশ্বাসই করেন না। আর নিজেকে মামলা থেকে মুক্ত করতে পারা-টাই মোদির বড় সাফল্য।
গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ অর্থ্যাৎ সংবামাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে অমর্ত্য সেন বলেন, সরকার যদি বিরুদ্ধে থাকে, তবে সরকারি শুধু নয়, সম্ভবত অনেক বেসরকারি বিজ্ঞাপনও পায় না সংবাদমাধ্যম। ফলে স্বাধীন সংবাদপত্র বা সংবাদ চ্যানেল পাওয়াই দুষ্কর। স্টুয়ার্ট মিলের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন,‘মানুষ ভয়ে আছেন। এটা আগে কখনও দেখিনি। আমার সঙ্গে ফোনেও সরকারের সমালোচনার প্রসঙ্গ উঠলে অনেকে বলছেন,‘থাক, দেখা হলে বলবো। আমি নিশ্চিত ওরা আমাদের কথা শুনছে।’ এটা গণতন্ত্রের পন্থা নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কী চান, সেটা বোঝারও পথ নয় এটা।’
ভারতে চলমান দুঃসময়ের প্রসঙ্গে ছোটবেলার অনেক স্মৃতি তিনি তুলে ধরেন সাক্ষাৎকারে। চুম্বকে যা এই রকম: ছেলেবেলাতেও খুব খারাপ সময় দেখেছি। দেখেছি, কাকাদের সকলকে জেলে আটকে রাখা হয়েছে। ন’বছর বয়সে দেখেছি মন্বন্তর (দুর্ভিক্ষ)। এতে তিন লাখ মানুষ মারা যান। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা দেখেছি। মুসলিম দিনমজুরকে কুপিয়ে খুন করেছে আমারই পাড়ার কিছু হিন্দু। আমি তখন দশ কি এগারো বছর বয়সের। বাগানে খেলছিলাম। দেখি, রক্তাক্ত অবস্থায় ছুটে আসছেন একজন। চিৎকার করে বাবাকে ডাকলাম। পানি খেতে দিলাম। এত রক্ত কখনও দেখিনি। আমার কোলে মাথা রেখে সেই মুসলিম দিনমজুর স্পষ্ট বলেছিলেন, বিবি বলেছিল- হিন্দু এলাকায় কাজ করতে যেও না। কিন্তু বাচ্চারা যে না-খেয়ে আছে। কিছু তো রোজগার করতেই হবে…। এরপর বাবা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। পুলিশকেও জানিয়েছিলেন। কিন্তু হিন্দু এলাকার পুলিশ কিছু করতে রাজি হয়নি। আবার অনেক বড় বড় সমস্যা মিটে যেতেও দেখেছি। তবে তার অর্থ এই নয় যে আমি নিশ্চিত। কোনও কিছু সম্পর্কেই আমি নিশ্চিত নই। এর অর্থ এটাও নয় যে, হতাশার পরিস্থিতিতে সব আশা ছেড়ে দিতে হবে।
আশা তাই ছাড়ছেন না নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। সূত্র : আনন্দবাজার।