দিল্লির সহিংসতা শুরু হয়েছে মোদি সরকারের বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইন নিয়ে। গত ডিসেম্বরে পাস হওয়া ওই আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে ভারতীয়রা, বিশেষ করে মুসলিমরা।
দিল্লি হত্যাযজ্ঞের আগে পার্শ্ববর্তী বিজেপিশাসিত উত্তরপ্রদেশে ১৯ বিক্ষোভকারীকে হত্যা করা হয়েছে।
দিল্লির সাম্প্রতিক নির্বাচনে মোদির দল বিপজ্জনক সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালিয়েছে। দলনেতারা নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনেছে। তাদের হত্যাকারী বলে বর্ণনা করেছে। নির্বাচনে হেরে যায় বিজেপি। কিন্তু বিক্ষোভ চলতে থাকে। ২৩শে ফেব্রুয়ারি বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র’রা দিল্লির উত্তরাংশে রাস্তা আটকে বিক্ষোভরত একদল মুসলিম নারীকে সরাতে জনতাকে উস্কানি দেন। এর পরপরই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
এক সপ্তাহ পর ওই সহিংসতার বিস্তৃত বর্ণনা প্রকাশ হলে তাতে দিল্লি পুলিশের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। বাহিনীটির বিরুদ্ধে হিন্দু হামলাকারীদের সহায়তা ও মুসলিমদের টার্গেট করার অভিযোগ ওঠে। মিশ্রের উস্কানিমূলক বক্তব্য থেকে এ সহিংসতার সূত্রপাত। তিনি যখন ওই হুমকি দিচ্ছিলেন, তখন তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন উত্তর দিল্লি পুলিশের ডেপুটি কমিশনার ভেদ প্রকাশ। তিনি মিশ্রকে কোনো বাধা দেননি। পরদিন দাঙ্গাকারীরা যখন সহিংসতায় নামে, প্রকাশ ও তার পুলিশকর্মীদের এক হিন্দু হামলাকারীর সঙ্গে হাত মেলাতে দেখা যায়। ওই হামলাকারী দিল্লি পুলিশ ও তাদের সহায়তা উদ্যাপন করছিল।
পুলিশ বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা খুব স্বাভাবিকভাবে হিন্দু দাঙ্গাকারীদের পক্ষে তাদের সমর্থন ও মুসলিমভীতি প্রকাশ করেন। দাঙ্গায় গত তিন দশক ধরে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা যুদ্ধের স্লোগান হিসেবে ‘জয় শ্রীরাম’ ব্যবহার করে আসছে। দিল্লি সহিংসতাকারীরাও হামলার সময় এই স্লোগান দিয়েছে। এমন খবরও প্রকাশ পেয়েছে যে, দিল্লি পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা ‘জয় শ্রীরাম’ বলে মুসলিমদের ওপর হামলা চালিয়েছে।
সত্য হিসেবে যাচাই করা নৃশংস একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, দিল্লি পুলিশের সদস্যরা রাস্তায় পড়ে থাকা পাঁচজন গুরুতর আহত মুসলিমের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের ‘জয় শ্রীরাম’ গাইতে বাধ্য করছে। তাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। ওই পাঁচজনের একজন পরবর্তীতে জখমে ধুঁকে মারা গেছেন। ভিডিওটির সত্যতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
গত সপ্তাহের সহিংসতার আগেও দিল্লি পুলিশের এরকম আচরণ দেখা গেছে। ৩০শে জানুয়ারি শাহীনবাগে একজন বন্দুকধারী পুলিশের উপস্থিতিতে নাগরিকত্ব আইনের বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি ছোড়ে। ওই ঘটনার ভিডিও ও ছবিতে দেখা যায় যে, অস্ত্র হাতে একজন ব্যক্তি বিক্ষোভকারীদের দিকে মুখ করে আছেন। ধীরে-সুস্থে নিজের লক্ষ্য ঠিক করে দিল্লি পুলিশের সামনে গুলি করছে। পুলিশ বাহিনীটির এমন পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ কেবল তাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে নিয়োগের জন্যই হয় না। তাদের বিশ্বাস, এ ধরনের কর্মকা-ের জন্য তারা মোদি সরকারের কাছ থেকে পুরস্কৃত হবে। ভারতের ইতিহাসে আগে ঘটে যাওয়া বড় মাত্রার ধর্মীয় সহিংসতাগুলোর দৃষ্টান্ত থেকে তাদের এ বিশ্বাস জোরদার হয়েছে। বিশেষ করে, ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা ও ১৯৮৪ সালে শিখদের বিরুদ্ধে ঘটা দিল্লি দাঙ্গা।
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অল্প সময় পর, রাজ্যের গোধরা শহরে ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে হিন্দু ধর্মীয় স্বেচ্ছাসেবকবাহী একটি ট্রেনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। অভিযোগ রয়েছে, মুসলিমদের একটি দল ওই আগুন লাগিয়েছিল। ওই আগুনে প্রাণ হারায় ৫৯ জন মানুষ। মোদি নিশ্চিত করেন, ওই নিহতদের পুড়ে যাওয়া লাশগুলো নিয়ে গুজরাটের সবচেয়ে বড় শহরে আহমেদাবাদজুড়ে যেন মহড়া হয়। মোদির দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠনের নেতারা উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। তাদের বক্তব্যে জ্বলে ওঠে মুসলিমদের বাড়ি ও দোকানে হামলা চালায় উত্তেজিত হিন্দু জনতা। ওই দাঙ্গায় প্রাণ হারান ১ হাজারের বেশি মানুষ। এদের মধ্যে ৭০০’র বেশি ছিলেন মুসলিম।
দিল্লি পুলিশের মতো গুজরাটের তৎকালীন পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধেও দাঙ্গাকারীদের সঙ্গে হাত মেলানোর ও মুসলিমদের ওপর হামলা ঠেকাতে কিছু না করার অভিযোগ রয়েছে। দাঙ্গাটি প্রশমিত করতে কয়েকজন পুলিশকর্মী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তাদের সবাইকে তড়িঘড়ি করে বদলি করে দেন মোদি ও তার তখনকার ও এখনকার ঘনিষ্ঠ সহযোগী অমিত শাহ। পরবর্তী বছরগুলোয় ওই পুলিশকর্মীদের নানাভাবে হয়রানি করে সরকার।
দিল্লি পুলিশ বাহিনীতে কাজ করা প্রত্যেক কর্মী গুজরাটের ওই পুলিশকর্মীদের ভাগ্য সম্পর্কে বেশ ভালোভাবে সচেতন। দিল্লি রাজধানী হওয়ার পর থেকে শহরটির পুলিশকর্মীরা গুজরাটের তৎকালীন পুলিশ বাহিনীর মতো সরাসরি মোদি সরকারের কাছে জবাবদিহিতা করে। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে কাজ করে তারা। ২০০২ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকা মোদির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন অমিত শাহ। বর্তমানে তিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।
দিল্লি পুলিশের কাছে আরো সুস্পষ্ট দৃষ্টান্তও ছিল। ১৯৮৪ সালের ৩১শে অক্টোবর তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করে তার শিখ দেহরক্ষীরা। এর এক সপ্তাহ পর থেকে শুরু হয় ভয়াবহ এক দাঙ্গা। সহিংস হিন্দু জনতার হাতে খুন হয় ৩ হাজারের বেশি শিখ ধর্মাবলম্বী। দাঙ্গায় পুলিশের ভূমিকা বিস্তৃত আকারে সমালোচিত হয়। সরকারের নিয়োগ দেয়া এক কমিশন জানায়, বহু জায়গায় দিল্লি পুলিশ শিখদের কাছ থেকে অস্ত্র বা অন্যান্য হাতিয়ার, যেগুলো দিয়ে তারা নিজেদের রক্ষা করতে পারতো, তা কেড়ে নিয়েছে। তাদের রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে হামলা চালানো হয়েছে। এসব অভিযোগ প্রমাণের জন্য পর্যাপ্ত প্রমাণ রয়েছে। পরবর্তীকালে অপর এক কমিশন ৭২ পুলিশকর্মীকে দোষী সাব্যস্ত করে। এক সুপারিশে, দোষী সাব্যস্ত পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার দায়িত্ব দিল্লি পুলিশ ব্যতীত অন্য কোনো সংস্থাকে দিতে বলে। কিন্তু ওই সুপারিশ মানা হয়নি। দাঙ্গায় তাদের ভূমিকার জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও শাস্তি থেকে বেঁচে যায় অনেকে। দিল্লি পুলিশের অনেক সদস্যই ওই কর্মীদের অধীনে কাজ করেছেন বা তাদের দ্বারা প্রশিক্ষিত হয়েছেন।
মোদি সরকারের পক্ষ থেকে পুলিশের জন্য সহায়তার বার্তা অটল, স্পষ্ট ও বাহিনীর ঊর্ধ্বে। সাম্প্রতিক সহিংসতায় নিষ্ক্রিয়তার জন্য পুলিশকে চরম ভর্ৎসনা করেন দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি এস. মুরালিধর। দাঙ্গায় হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতাদের ভূমিকা তদন্তের নির্দেশ দেন তিনি। এর পরপরই তাকে অন্য এক রাজ্যে বদলি করে দেয়া হয়। তাকে বদলে দেয়ার সিদ্ধান্ত আগে থেকে করা থাকলেও, এর সময়কাল ঠিক করেছে মোদি সরকারই। এক আইনজীবী জানান, কোনো শুনানি বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কাজ করার মধ্যে কোনো বিচারককে বদলির ঘটনা নজিরবিহীন। মোদি সরকারের বার্তা সকলের কাছেই স্পষ্ট। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর পক্ষে কাজ করা এই সরকার তাদের এজেন্ডা পূরণের পথে বিচার বিভাগ বা আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে বাধা সৃষ্টি করতে দেবে না।
দিল্লি সহিংসতায় জড়িত পুলিশকর্মীরা কোনো আইনি পদক্ষেপের সম্মুখীন হবে না। তারা হয়তো সংবিধান মেনে চলেনি, কিন্তু তারা বিজেপিকে মেনে চলেছে। ভবিষ্যতে ভারতের মোদি সরকারশাসিত কোনো অঞ্চলে হিন্দু উগ্র জনতা যখন মুসলিমদের ওপর হামলা চালাবে, আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি যে, পুলিশ তাদের সহায়তা করবে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতামত বিভাগে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ।