এই মুহূর্তে একের পর এক দেশে নতুন করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশকেও বলা হচ্ছে উচ্চ-ঝুঁকির দেশ। কীভাবে করোনা শনাক্ত এবং ভাইরাস রোধে কাজ করছে বাংলাদেশ এ নিয়ে উচ্চ আদালতও জানতে চেয়েছে।
এমন সন্দেহ আর বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে স্বভাবতই করোনা আতঙ্ক আর উদ্বেগ ভর করেছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও। বাংলাদেশ কখন এ ভাইরাস ঢুকে পড়ে, নাকি অজান্তে ঢুকেই পড়েছে – অনেকের মধ্যে কাজ করছে সে সন্দেহ।
কী বলছে আইইডিসিআর’বি?
চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্কতা জারী করার পর ২১ জানুয়ারি থেকে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চীন থেকে আসা নাগরিকদের স্ক্রিনিং শুরু করে।
এরপর ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাদেশে যেকোনো পথে এবং প্রতিটি দেশ থেকে আসা সব যাত্রী স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনা হয় বলে দাবি করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে একমাত্র রোগতত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং গবেষণা ইন্সটিটিউট – আইইডিসিআর করোনাভাইরাস শনাক্ত করতে পারে। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত করোনা সন্দেহভাজন ১০৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করেছে।
আর অসুস্থ ৪ জন দেশি বিদেশি নাগরিককে করোনা আইসোলেশন ইউনিটে সম্পূর্ণ আলাদা করে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। আইইডিসিআর জানাচ্ছে ২১ জানুয়ারির পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সাড়ে চার লাখের বেশি মানুষকে স্ক্রিনিংয়ের আওতায় নিয়ে এসেছে।
এসব তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতেই আইইডিসিআর’বি-এর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, বাংলাদেশে বৃহস্পতিবার (৫ই মার্চ) পর্যন্ত কাউকে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করা যায়নি।
তিনি আরো বলেন, মানবদেহে এ ভাইরাসের লক্ষণ এবং উপসর্গ না থাকলে করোনা বা কোভিড-১৯ ভাইরাস শনাক্ত করা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, “৭ই ফেব্রুয়ারি থেকে সমস্ত পোর্ট অর্থাৎ স্থলবন্দর, সমুদ্র বন্দর এবং সকল বিমানবন্দরে এবং সকল যানবাহনে যারা আমাদের দেশে বাইরে থেকে আসছেন প্রত্যেককে স্ক্রিনিংয়ের আওতায় এনেছি। এ পর্যন্ত আমরা সাড়ে চার লাখের বেশি যাত্রীকে স্ক্রিনিংয়ের মধ্যে এনেছি তাদেরকে স্ক্রিনিং করা হয়েছে”।
স্ক্রিনিং করে কতটা ঠেকানো সম্ভব?
দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, দুটি সমুদ্র বন্দর এবং সবগুলো স্থলবন্দরে থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে যাত্রীদের স্ক্রিনিং হচ্ছে বলে জানায় আইইডিসিআর’বি।
এর মধ্যে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থার্মাল আর্চওয়ে এবং হ্যান্ডহেল্ড স্ক্যানার দিয়ে যাত্রী স্ক্রিনিং করা হয়।
তবে সিলেট ও চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং সমুদ্র বন্দর এবং স্থল বন্দরে কোনো আর্চওয়ে নেই সেখানে থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে যাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হয়।
বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের অনেকেই বিমানবন্দর পার হয়ে অভিযোগ করেছেন যে বাংলাদেশে এই স্ক্রিনিং ঠিলেঠালাভাবে হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, যেহেতু এ ভাইরাস মানুষে শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়াচ্ছে তাই এটি দ্রুতগতিতে দেশে দেশে সংক্রমিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, “যদি আপনি শতভাগ মনিটরিংও করেন, গবেষণায় দেখা গেছে মাত্র আপনি ৪৬ শতাংশ কেইসকে আপনি শনাক্ত করতে পারবেন। রিয়েল কেইস যারা।”
“তার মানে ধরেন একশ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি আসলেন আজকে এয়ারপোর্ট দিয়ে, এরমধ্যে ৪৬ জনকে আপনি আইডেন্টিফাই করতে পারবেন। সুতরাং এখানে একটা বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন এখানেই রয়ে গেল আগে থেকেই।”
তিনি আরো বলেন, “তারমধ্যে যদি ঠিলেঠালাভাবে হয় তাহলেতো বুঝতেই পারছেন যে এটার কী অবস্থা হবে”।
বাংলাদেশে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কিনা সেটি শনাক্ত করতে শুধু স্ক্রিনিংয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বলে জানান সেব্রিনা ফ্লোরা।
তিনি বলেন “আমরা এয়ারপোর্টে যে স্ক্রিনিং করি সেখানে কেবলমাত্র লক্ষণ উপসর্গ আছে কিনা সেটা দেখা হয়। স্ক্যানারের মাধ্যমে জ্বর আছে কিনা সেটা দেখা হয়। এর পাশাপাশি তাদের মধ্যে অন্য লক্ষণ উপসর্গ আছে কিনা সেটা দেখার জন্য আমরা একটা হেলথ ডিক্লারেশন ফর্ম দেই তার মধ্যে লক্ষণ উপসর্গের তালিকা থাকে সে অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহ করা হয়।”
সেব্রিনা ফ্লোরা আরো জানান, “আমরা যে হেলথ কার্ডটি দিয়ে থাকি সে কার্ডের মধ্যে আমাদের দেশে আসার ১৪ দিনের মধ্যে একই লক্ষণ উপসর্গ দেখা দেয় তারা যাতে আমাদের হটলাইনে যোগাযোগ করে তার মাধ্যমেও আমরা সার্ভিলেন্স কার্যক্রম পরিচালনা করি। এছাড়া হেলথ ডিক্লারেশন ফর্ম ফোন নম্বরসহ আইইডিসিআরে চলে আসে। সেই ফরমটিকে আমরা সেলফোন ভিত্তিক সার্ভিলেন্স সার্ভিসের আওতায় নিয়ে আসি।”
“কার্ডে থাকা ফোন নাম্বার ধরে দেশে আসার পর প্রত্যেক যাত্রীকে অন্তত দুইবার ফোন করা হয়। দেশে এসে পৌঁছানোর দুই থেকে তিনদিনের মধ্যে একবার এবং ১০-১৪ দিনের মধ্যে আরেকবার ফোন করে তার মধ্যে লক্ষণ উপসর্গ আছে কিনা সেটা জিজ্ঞেস করা হয়।”
তিনি বলছিলেন, “পাশাপাশি স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় যে ১৪ দিনের মধ্যে লক্ষণ উপসর্গ দেখা দিলে যাতে আমাদের হটলাইন নাম্বারে যোগাযোগ করে। এভাবে আমরা আমাদের স্ক্রিনিং কার্যক্রম পরিচালনা করি।”
ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে কিছু পরামর্শ
এদিকে সবরকম চেষ্টা করেও উন্নত বিশ্বের বহু দেশ করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। মারাত্মক ছোঁয়াচে হওয়ায় এ ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে সাধারণ মানুষকে বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া এবং হাচিঁ-কাশি দেয়ার সময় নাকমুখ ঢাকার পরামর্শ মেনে চলার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
বাংলাদেশে একবার এ ভাইরাস সংক্রমণ শুরু হলে সেটা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে যে কারণে সবাইকে সচেতন হবারও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
এছাড়া এই মুহূর্তে অত্যাবশ্যকীয় না হলে বিদেশ ভ্রমণ এবং বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদেরও দেশে না আসার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে সাধারণ মানুষকে কোলাকুলি এবং করমর্দন না করারও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
চীনের উহান থেকে শুরু করে এ ভাইরাসে এ পর্যন্ত ৯৩ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত এবং ৩ হাজার ১৯৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে চীনের বাইরে আক্রান্তের সংখ্যা ১২ হাজার ৬শ ৮৬জন এবং মৃত্যু হয়েছে ২১৪ জনের।
চীনের বাইরে দক্ষিণ কোরিয়াতেই এখন সবচে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে করোনাভাইরাসে। এছাড়া জাপান, ইতালি এবং ইরানকে করোনা ‘হটস্পট’ হিসেবে উল্লেখ করছে বিশ্ব-স্বাস্থ্য সংস্থা। করোনা সংক্রমণে বাংলাদেশকে দেখা হচ্ছে এখন উচ্চ ঝুঁকির দেশ হিসেবে।