এম মাহাবুবুর রহমান
শিরোনামটা পড়ে সবাই আমার ওপর রাগান্বিত হবেন জানি। জাতীয়তাবাদী ঘরানায় তরুন রাজনীতিকদের অন্যতম আইকন হয়ে উঠেছিলেন এম ইলিয়াস আলী। আমাদের ইলিয়াস ভাই। ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। সাবেক এমপি। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। ছাত্রসমাজের কাছে অন্যতম শীর্ষ জনপ্রিয় নেতা। জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে রাজপথের আন্দোলন পরিচালনায় যারা এখনও শেষ সম্বল হিসেবে মাঠে আছেন, তারা মোস্টলি ইলিয়াস আলীর ছোট ভাই। রাজনৈতিক ছোট ভাই। তারাও সাবেক ছাত্রনেতা।
আজকের বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ রুখতে উল্লেখযোগ্য অঅন্দোলনের দেখা না মিলছে না। তবে যদি কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়, তবে অঅন্দোলনের কর্মীদের আদর্শ-অনুপ্রেরণায় থাকতে হবে ইলিয়াস আলীর মতো সাহসী মানুষদের। বিগত অঅন্দোলনে সারা দেশে যতটুকু রাজপথে মানুষের দেখা মিলেছে, তারা প্রায় সবাই তরুন-যুবক। আর তাই শেখ হাসিনার বাহিনী সেই যুবকদেরই ধরে ধরে হত্যা করেছে। আমি পুরোনোদের অবদানের কথা অস্বীকার করছি না। অনেক পুরোনো, অভিজ্ঞ এবং সিনিয়র নেতা আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে কাজ করেছেন, করছেন। তবে সেখানে আন্তরিকতার অভাব ছিল না, সেটা কেউ হলফ করে বলতে পারবেন না। বিএনপির ‘নিজের সন্তান জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের’ পুরোনো নেতৃত্বই বেশীরভাগ এলাকায় রাজপথে ভুমিকা রেখেছে বিগত সব আন্দোলনে। দেশমাতা বেগম খালেদা জিয়া যখন অবরুদ্ধ ছিলেন, কারাবন্দী ছিলনে, সেখানে ছাত্রদলের সাবেক ও বর্তমান ভাইয়েরা যথাযথ ভুমিকা রাখতে পারেননি, এখনও পারছেন না। এটা নির্ধিদ্বায় স্বীকার করে নিতে হবে।
প্রশ্ন হলো, ইলিয়াস আলীকে নিয়ে বলতে গিয়ে এসব আলোচনা কেন? ব্যক্তিগতভাবে ইলিয়াস আলীকে কাছ থেকে চিনতাম, জানতাম বলেই বলছি, বাংলাদেশের বর্তমান ফ্যাসিবাদকে সরাতে ইলিয়াস আলীকে ফিরতেই হবে। জীবিত ইলিয়াস আলী না ফিরলে তাঁর আদর্শে বলীয়ন তরুন প্রজন্মকে ভুমিকা রাখতে হবে।
বাংলাদেশে প্রথম আলোচিত বিচার বহির্ভুত হত্যা সিরাজ শিকদার হত্যা। সিরাজ শিকদারকে হত্যা করে শেখ মুজিবুর রহমান মনে করেছিলেন, প্রতিবাদী মানুষদের কেন্দ্রবিন্দু সিরাজ শিকদারকে হত্যার মাধ্যমে ‘বাকশাল’ গঠনের আর কোনো বাধা রইল না। এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সেভাবেই এগিয়েছিলেন। মুজিব বুঝতে পেরেছিলেন, সিরাজ শিকদারকে ঘিরে প্রতিবাদী মানুষের বলয় তৈরী হতে পারে। তাই তিনি তাকে হত্যা করলেন। কিন্তু বাংলায় বহু সিরাজ শিকদারের জন্ম হয় তখন। এক পর্যায়ে একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বিদায় নিতে হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবের মেয়ে শেখ হাসিনাও সাবেক ছাত্রনেতা ও বিএনপির জনপ্রিয় সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীকে ঘিরে যুব-তরুন রাজনীতিকদের একটি বলয় গড়ে ওঠার দৃশ্য অবলোকন করছিলেন। বাবার মতো দূরদৃষ্টি সম্পন্ন শেখ হাসিনা সেই বলয় ভেঙ্গে দিতেই এম ইলিয়াস আলীকে গুম করলেন। কারণ এম ইলিয়াস আলী বুঝেছিলেন, শেখ হাসিনা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দীর্ঘ স্থায়ী ক্ষমতার পরিকল্পনা করছেন। গুম হয়ে যাওয়ার কিছুদিন আগে তিনি বৃটেনে এসে পার্লামেন্টে গিয়ে বাংলাদেশের মানবাধিকারের পরিস্থিতি তুলে ধরে একটি রিপোর্ট পেশ করেন। এরপর দেশে ফিরে দৈনিক আমার দেশ কার্যালয়ে এ বিষয়ে ইলিয়াস আলী আমাদের বলেছিলেন, মাহাবুব – সত্যিই শেখ হাসিনা এদেশ ধ্বংস করে ছাড়বে। মাহমুদ ভাই (আমার দেশ সম্পাদক) এটি বুঝতে পারছেন। আমাদের দলের নেতারা বুঝতে চাইছেন না। তোমরা ম্যাডামকে বলো, ঢাকা মহানগর গোছানোর জন্য। যুবদল-ছাত্রদল-ঢাকা মহানগর না গোছাতে পারলে অনেক বড় বিপদ সামনে। তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, আমান ভাই’র সাথে কথা বলো। উনি ঢাকা মহানগরের সভাপতির দায়িত্ব নেক। আমি সব ধরণের সহায়তা করবো। ম্যাডামকে বলো, প্রয়োজনে যুবদল আমি গুছিয়ে দিতে পারি। ছয় মাসের সময় বেধে দিয়ে আমাকে যুবদলের দায়িত্ব দিতে পারেন। আমি ছয় মাসে ৬৪ জেলায় যুবদলকে শক্তিশালী করতে পারবো। এরপর ডিসেম্বরে (২০১২ সাল) নতুন কাউন্সিলে বিএনপির নেতৃত্বও সঠিকভাবে বন্টন করা জরুরী। তুমি মাহমুদ ভাইকে বলো, ম্যাডামের সাথে এসব নিয়ে কথা বলতে। নইলে আমরা কেউ কিন্তু রক্ষা পাবো না।
ইলিয়াস আলী বুঝতে পেরেছিলেন, কাউকে শেখ হাসিনা রাখবেন না। থাকতে দেবেন না। এজন্য টিপাইমুখে বাঁধের বিরুদ্ধে লংমার্চ এবং হরতাল করেছিলেন তিনি। ঢাকায় নেতাকর্মীদের সাহস দিতে সবসময় সচেষ্ট ছিলেন। সবাইকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন এম ইলিয়াস আলী। হয়তো তিনি এখনও বেঁচে থাকতে পারেন। আল্লাহই ভাল জানেন। শেখ হাসিনাও হয়তো জানেন। যেমনটা শেখ হাসিনা জানেন, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য চৌধুরী আলম, হিরু, ছাত্রদল নেতা আনিসুর রহমান খোকন, যুবনেতা সুমন সহ হাজারো রাজনীতিকের সর্বশেষ অবস্থান। আরো স্পষ্ট করে বলছি, আল্লাহর পরে কেবল শেখ হাসিনা বলতে পারেন, বাংলার হারিয়ে যাওয়া মানুষদের অস্তিত্ব এখন কোথায়!!!!!
যাইহোক, আসল কথায় আসি। শিরোনামে প্রশ্ন রেখেছিলাম = ইলিয়াস আলী কী ফিরবেন? আসলে তাকে ফিরতেই হবে। কেননা ইলিয়াস আলী সহ কিছু মানুষ যেটা ১০ বছর আগে বুঝতে পেরেছিলেন, আজকে বাংলাদেশের মানুষ জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে, সম্ভ্রম দিয়ে সেটা বুঝতে পেরেছেন। এখন সবাই বলেন, ইলিয়াস আলী সঠিক ছিলেন। যেমনটা সঠিক ছিলেন মুজিব বিরোধী আন্দোলনে শহীদ সিরাজ শিকদার। বুঝতে পেরেছেন শেখ হাসিনার অন্ধ কারাপ্রকোষ্ঠে দীর্ঘদিন বন্দী জীবন কাটানো সত্যনিষ্ঠ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
আমরাও এখন সঠিকটা বুঝতে পারছি। আমাদের অনেক সহযোদ্ধাকে হারানোর পর। বহু রক্ত দেয়ার পর। বহু বোনের সম্ভ্রম হারানোর পর। এতো কিছুর পরও বাস্তবতা বুঝতে পারলেও আমাদের হাত-পা যেন বাধা। কোন অজানা রশি দিয়ে আমাদের অগ্রগতিকে আটকে রাখা হয়েছে। বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে কেন যেনো নিজের সন্তান ছাত্রদলের কোনো লোক রাখা হয় না। এই নীতি পাল্টাতে হবে, বুঝতে হবে নিজের সন্তান বড় হয়েছে। তাদের মধ্যে বিপদগামী থাকতে পারে। কিন্তু নিশ্চয়ই তারা কারো এজেন্ট হবেন না। এজেন্টমুক্ত শক্তিশালী বিএনপি গড়ে তুলতে হবে। আর সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ইলিয়াস আলীর মতো দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এবং সাহসী কর্মী হয়ে উঠতে হবে। সেটা সম্ভব না হলে কেউ রক্ষা পাবেন না। শেখ হাসিনার বাহিনীর তালিকায় নাম যেহেতু আপনার উঠে গেছে, সেহেতু রক্ষা নেই। বাঁচলে একসঙ্গে লড়াই করে বাঁচুন। মরলে একসঙ্গে মরুন। বাঁচতে চাইলে ইলিয়াস আলীকে চেতনায় ফেরাতে হবে। ইলিয়াস আলীকে ধারণ করতে না পারলে বাংলাদেশ শত্রু মুক্ত হবে না, এটা হলফ করে বলতে পারি।
তাই বলি, সবাই চিন্তা-আদর্শ ও মননে ইলিয়াস আলী হয়ে উঠুন। সবাই গর্জে উঠতে পারলে ফ্যাসিবাদ পিছপা হতে বাধ্য। প্রত্যাশা করি, ইলিয়াস আলী জীবিত ফিরবেন। যেমনটা সালাউদ্দিন আহমেদ, আনিসুর রহমান খোকনকে আমরা সন্ধান পেয়েছি। অন্য সব বন্ধুরাও ফিরে আসবেন আমাদের মাঝে। আবারো দেখা হবে, কথা হবে, শলাপরামর্শ হবে, সবাই মিলে ফ্যাসিবাদের পতন নিশ্চিত করবো, এই প্রত্যাশা রাখি।
লেখক: যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত সাংবাদিক ও আইনজীবী।