পদ্মা সেতুর মাঝনদী ও মাওয়া প্রান্তে ১৪টি খুঁটি (পিয়ার) নির্মাণ নিয়ে যে অনিশ্চয়তা ছিল তা কেটে গেছে। ফলে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অচিরেই নদীর তলদেশের গভীরে খুঁটিগুলোর পাইল স্থাপন শুরু হবে। শুধু তাই নয়, খুব শিগগিরই ৪র্থ স্প্যানটিও উঠে যাবে খুঁটির উপর।
জানা গেছে, ফেব্রুয়ারির শেষ ও চলতি মাসের প্রথম দিকে ১৪টি খুঁটি (পিলার) নির্মাণ জটিলতা নিয়ে জাজিরা সার্ভিস এরিয়ায় বিশেষজ্ঞ প্যানেলের দফায় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সর্বশেষ সভায় ১৪টি খুঁটি (পিলার) নির্মাণ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই সমস্যা সমাধানের খুব কাছে পৌঁছে গেছেন। বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য এবং পরামর্শক সবার মতামতের ভিত্তিতে ১৪ খুঁটির নতুন ডিজাইন চূড়ান্ত হচ্ছে। ডিজাইন চূড়ান্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর ১৪ খুঁটির নির্মাণ প্রক্রিয়ার সব অনিশ্চয়তা কেটে গেছে।
পদ্মা সেতুর দায়িত্বশীল এটি সূত্র জানিয়েছে, বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছয়টি পাইল নরম কাদামাটির প্রায় ৭ মিটার উপরে বালুর উপযোগী স্তরে পর্যাপ্ত গভীরতায় রাখা হবে। আর মাঝখানের একটি বাড়তি পাইল কাদামাটি ভেদ করে ১৪৫ থেকে ১৫০ মিটার পর্যন্ত গভীরে চলে যাবে, যেখানে উপযোগী বালুর স্তর রয়েছে। এতেই ঝুঁকিহীন হবে খুঁটি। সংশ্লিষ্টদের মতে, শক্ত ও মজবুত ভিতের জন্যই পদ্মা সেতুর সবগুলো পাইলই একটু হেলিয়ে বা বাঁকা করে ডিজাইন করা। তবে এই ১৪টি খুঁটির নিচে ছয়টি করে বাঁকা খুঁটির মাঝখানের একটি বাড়তি পাইল একেবারেই সোজাসুজি বসবে। তাই সোজা পাইলটিকে বলা হচ্ছে ভার্টিক্যাল পাইল। অবশেষে এই ভার্টিক্যাল পাইলেই পদ্মা সেতুর বড় চ্যালঞ্জটির সফল সমাধান হচ্ছে।
পদ্মা সেতুর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. জামিলুর রেজা চৌধুরী এই ১৪ খুঁটি সম্পর্কে জানান, এই পিলারগুলোর নকশা মোটামুটি ফাইনাল হয়ে গেছে। প্রকল্প ব্যবস্থাপক দেশের বাইরে আছেন। তিনি এলে চূড়ান্ত নকশা পাওয়া যাবে। তিনি আরো বলেন, এখন যে পাইলের নকশা আছে, সেগুলোর কাজ চলছে, চলতে থাকবে। কাজ আটকে নেই। সবকিছু চেক করা হচ্ছে, সমস্যার সমাধান হয়ে যাচ্ছে। এখন ভালো খবর হলো একে একে ৩টি স্প্যান খুঁটির উপর উঠে গেছে। খুব শিগগিরই ৪র্থ স্প্যানটি উঠে যাবে।
পদ্মা সেতুর অপর এটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ব্রিটিশ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাউই ইউকে লিমিটেড এই ১৪ খুঁটির নতুন ডিজাইন তৈরি করছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের পিলারের নিচে ৯৮ থেকে ১২৮ মিটার পর্যন্ত গভীর পাইল বসানো হচ্ছে। বিশে^ এত গভীরে পাইল বসিয়ে সেতু নির্মাণের নজির নেই বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ১৪টি পিলারের নিচে যে গভীরতায় পাইল বসানোর কথা, এর ৩ থেকে ৭ মিটার উপরে কাদামাটি পাওয়া গেছে। সাধারণত কাদামাটির স্তরের উপরে থাকা বালু মাটিতে পাইলের শেষাংশ থাকা বাঞ্ছনীয়। এ জন্যই ডিজাইন অনুযায়ী আলোচিত ১৪টি খুঁটির ৮৪টি পাইল আরো গভীরে বসানো হবে, নাকি গভীরতা কমিয়ে সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়া হবে- এটা নিয়েও সভায় সিদ্ধান্ত হয়।
সূত্র জানায়, মাটি থেকে পানি পর্যন্ত একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় পিলারের চারপাশে বেড়া দিয়েও এর সমাধান হতে পারে কিনা তা নিয়েও সভায় আলোচনা হয়। তবে এই ১৪ খুঁটির নিচে মাটির তলদেশে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন গভীরতায় কাদামাটির লেয়ার রয়েছে। পাইলগুলো ১১৪ থেকে প্রায় ১২০ মিটার পর্যন্ত গভীরতায়। পাইলের নিচের অংশ নরম কাদামাটির উপর রাখা হলে দেবে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। পাইলের বটম সেকশনের মাথার অংশ পর্যাপ্ত বালুর স্তরে রাখতেই হবে। তাই সাধারণত খুঁটির বটমের মাথার ১৪ মিটারের মধ্যে কাদামাটি গ্রহণযোগ্য নয়।
সূত্রগুলো জানায়, খুঁটিগুলোর ১৩০ মিটার পর্যন্ত তলদেশের ইতোমধ্যে পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১২৭ মিটারে নরম মাটির স্তর থাকলেও পরে রয়েছে বালুর উপযোগী স্তর। তাই এর পরের আরো ১১ মিটার পর্যন্ত এমন বালুর স্তর থাকলেই ডিজাইন পরিবর্তন ছাড়াই খুঁটির পাইল বসানো সম্ভব। কারণ ১২৭ মিটারের মাথায় যেহেতু বালুর স্তর রয়েছে তাই এর নিচে ১৪ মিটার বালু থাকলেই সমস্যা সমাধান সম্ভব। ১৪৫ মিটার পর্যন্ত গভীরতায় নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ৪টি পয়েন্টে পরীক্ষায় ভালো ফল পাওয়া গেছে। এসব কিছু বিবেচনায়ই বিশেষজ্ঞরা এগুচ্ছেন।
প্রসঙ্গত, নদীর তলদেশে মাটির গুণাগুণগত বৈচিত্র্যের কারণে পদ্মা সেতুর ১৪টি খুঁটির ৮৪টি পাইলের কাজ করতে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এ পিলারগুলো হলো- মাওয়ার কাছে ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১ ও ১২ এবং জাজিরার কাছে ২৬, ২৭, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২ ও ৩৫ নম্বর পিলার। সর্বশেষ খবর অনুয়ায়ী, উত্তাল পদ্মায় মাটির গঠনগত বৈচিত্র্য বিবেচনায় পাইল সংখ্যা আরো বাড়বে। সেতুর মাওয়া অংশে যে ১৪ পিলারের গভীরতা নিয়ে সমস্যা ছিল, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি, নকশা শেষ পর্যায়ে। আর নকশা এলে পুরোদমে কাজ শুরু হবে ১৪টি খুঁটির। এদিকে ৩য় স্প্যান ওঠানোর পর এবার ৪র্থ স্প্যান খুঁটিতে ওঠানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ৪০ এবং ৪১ নম্বর পিলারের কাজ বিরামহীনভাবে চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি মাসের শেষ কিংবা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ৪র্থ স্প্যান উঠতে পারে বলে পদ্মা সেতু সংশ্লিষ্টরা আভাস দিয়েছেন।