বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে প্রথমবারের মতো বয়স নির্ধারণ করে এমপিও নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ৩৫ বছরের অধিক বয়সী কেউ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাবেন না। পাশাপাশি শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬০ বছর রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। ৬০ বছর পূর্ণ করা কাউকে প্রতিষ্ঠান প্রধান, সহকারী প্রধান বা সাধারণ শিক্ষক পদে পুনঃনিয়োগ বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করা যাবে না।
এদিকে এমপিও নীতিমালা চূড়ান্ত হলেও চলতি অর্থবছরে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হচ্ছে না। এ খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নেই। তবে আগামী অর্থবছরে নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হবে বলে জানা গেছে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক) জাভেদ আহমেদ মঙ্গলবার বলেন, ‘কয়েকদিন আগে নীতিমালার খসড়ার ওপর অনাপত্তির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে আমাদের জানানো হয়েছে, নীতিমালার ওপর তাদের কাজ শেষ হয়েছে। এটি ফেরত পাঠালেই প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘চলতি অর্থবছরে নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই। আগামী অর্থবছরে এ খাতে অর্থ বরাদ্দ পেলেই নতুন প্রতিষ্ঠান কেবল এমপিওভুক্ত করা সম্ভব।’
জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সাধারণ শিক্ষা (স্কুল-কলেজ), মাদ্রাসা শিক্ষা এবং কারিগরি শিক্ষার জন্য আলাদাভাবে তিনটি নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। খসড়াগুলোতে এমপিও এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বা জনবল কাঠামোর আলাদা দু’টি অংশ আছে। তিনটি নীতিমালাতেই এমপিও দেয়া, শিক্ষক নিয়োগ, প্রাপ্যতাসহ বিভিন্ন বিষয়ের মৌলিক শর্তগুলো প্রায় অভিন্ন। এক্ষেত্রে নীতিমালাগুলোতে কেবলমাত্র ‘স্কুল বা কলেজ’, ‘মাদ্রাসা’ এবং ‘কারিগরি প্রতিষ্ঠান’ আলাদা যুক্ত হয়েছে। ২৫ পৃষ্ঠার নীতিমালায় শিক্ষকের এমপিওভুক্তির জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা, নিয়োগের স্বচ্ছতা, নিয়োগের প্রাথমিক বয়স, অবসরের বয়সসীমাসহ নানা দিক অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আছে প্রতিষ্ঠান এমপিওভক্ত হওয়ার শর্ত। প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত না হলে শিক্ষকও এমপিওর জন্য বিবেচিত হবেন না।
নীতিমালায় প্রথমবারের মতো স্কুলের পাশাপাশি মাদ্রাসায়ও অন্য ধর্মের শিক্ষার্থীর পথ খোলা রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে মাদ্রাসার জন্য প্রস্তাবিত এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামোতে বলা হয়েছে, ‘মাদ্রাসায় প্রথম-দশম শ্রেণীতে কোনো একটি ধর্মের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০ বা ততোধিক হলে সেই ধর্মের জন্য একজন করে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া যাবে।’ বর্তমানে অন্য ধর্মের শিক্ষার্থীদের মাদ্রাসায় ভর্তি বা তাদের জন্য শিক্ষক এমপিওভুক্তির ব্যবস্থা নেই।
এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলির বিধান রেখে নীতিমালায় বলা হয়েছে, সরকার প্রয়োজনবোধ করলে নীতিমালার মাধ্যমে বদলির ব্যবস্থা করতে পারবে। বর্তমানে এ ধরনের কোনো বিধান কার্যকর নেই। নীতিমালায় বলা হয়েছে, এক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক অন্য প্রতিষ্ঠানে সম বা উচ্চতর পদে আবেদন করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে কর্মরত প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি নিলে তিনি বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে গণ্য হবেন। কেউ যদি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি ত্যাগ করেন তাহলে সর্বোচ্চ ২ বছর তার ইনডেক্স (বেতন পাওয়ার কোড) নম্বর বহাল থাকবে। এর অধিক হলে তা ‘চাকরি বিরতি’ হিসেবে গণ্য হবে।
বেসরকারি শিক্ষকের জ্যেষ্ঠতা নির্ণয়ে তিনটি পন্থা উল্লেখ করা হয়েছে নীতিমালায়। সেগুলো হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট পদে জ্যেষ্ঠতা ও অভিজ্ঞতা নিরূপণে এমপিওভুক্তির তারিখ অনুযায়ী হবে। এমপিওভুক্তির তারিখ অভিন্ন হলে যোগদানের তারিখ অনুযায়ী হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়মিতকরণের বিষয় থাকলে (নিয়মিতকরণের) তারিখই যোগদানের তারিখ বলে বিবেচিত হবে। এটিও অভিন্ন হলে ব্যক্তির বয়স অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট পদে জ্যেষ্ঠতা ও অভিজ্ঞতা নিরূপণ করতে হবে। তবে কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি সরকারের আইন-নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো বিধান চালু করতে পারবে কিনা তা উল্লেখ নেই। বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি এ ধরনের অপকর্ম করে যাচ্ছে।
নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হবে ১০০ নম্বরের মধ্যে দেয়া গ্রেডিংয়ের ভিত্তিতে। একাডেমিক স্বীকৃতির বয়স, শিক্ষার্থী সংখ্যা, পরীক্ষার্থী সংখ্যা এবং উত্তীর্ণের সংখ্যা- এ চারটি বিষয়ে ২৫ নম্বর করে দেয়া হবে। নীতিমালায় অসত্য তথ্য দিয়ে বা জালিয়াতি করে এমপিওভুক্তির জন্য প্রধান প্রতিষ্ঠান ও পরিচালনা কমিটি দায়ী থাকবেন বলে উল্লেখ আছে। এ ক্ষেত্রে ‘যথোপযুক্ত আইনানুগ’ ব্যবস্থার কথা উল্লেখ থাকলেও সেটা কী তা বলা হয়নি। প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্যতা, স্বীকৃতি/অধিভুক্তি, জনবলকাঠামোর আরোপিত শর্ত, কাম্য শিক্ষার্থী-ফলাফল, পরিচালনা কমিটি না থাকলে এমপিও দেয়া হবে না। এনটিআরসিএ’র মেধাতালিকা থেকে নিয়োগ না দিলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক এমপিও পাবেন না।
নীতিমালা অনুযায়ী, এমপিওভুক্ত শিক্ষকের বার্ষিক কাজের মূল্যায়ন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে। নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সামঞ্জস্য রক্ষা করা হবে। প্রত্যেক শিক্ষকের নিজ মূল বিষয়ের বাইরে আরও ২টি বিষয়ে পাঠদানের দক্ষতা থাকতে হবে।
নীতিমালায় আরও বলা হয়, যেসব প্রতিষ্ঠানে শিফট চালু আছে, সেগুলোয় প্রতি শিফটের একেক শ্রেণীতে কমপক্ষে ১৫০ জন করে ছাত্রছাত্রী থাকতে হবে। ১৫০ জন বা এর অধিক শিক্ষার্থী থাকলেই শুধু শিফট চালু থাকবে। এ নীতিমালা জারির পর কোনো প্রতিষ্ঠানে দ্বিতীয় শিফট খোলা যাবে না। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদিত মূল ক্যাম্পাস ছাড়া অন্য কোথাও ক্যাম্পাস বা ব্রাঞ্চ খুলতে পারবে না।
প্রস্তাবিত নীতিমালা অনুযায়ী এমপিওপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জনবল অর্থাৎ শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে জনবল কাঠামোর শর্তের বাইরে এমপিওভুক্ত অতিরিক্ত শিক্ষক আছেন তারা ‘উদ্বৃত্ত’ হিসেবে কর্মরত থাকবেন। কিন্তু ওই শিক্ষক অবসরে যাওয়ার পর সেই পদে আর কাউকে নিয়োগ করা যাবে না। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠানের কোনো প্যাটার্নভুক্ত পদও যদি শূন্য হয়, তাহলে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে উদ্বৃত্ত পদের শিক্ষককে সেই (শূন্যপদে) সমন্বয় করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে এমপিওভুক্ত ‘উদ্বৃত্ত’ শিক্ষক আগে সমন্বয় হবে। এ ধরনের শিক্ষকের সমন্বয় হয়ে যাওয়ার পর যদি পদ শূন্য থাকে বা হয়, তাহলে ‘নন-এমপিও উদ্বৃত্ত’ শিক্ষক জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সমন্বয় হবে। কিন্তু ‘উদ্বৃত্ত’ শিক্ষক-কর্মচারী থাকতে কিছুতেই নতুন নিয়োগ দেয়া যাবে না। তবে একই বিষয় বা পদভুক্ত ‘উদ্বৃত্ত’ না থাকলে নতুন নিয়োগ করা যাবে। সব ধরনের নিয়োগের ক্ষেত্রে মহিলা কোটা অনুসরণ বাধ্যতামূলক। ইনডেক্স নম্বর বা নিবন্ধন সনদ ছাড়া নিয়োগ পাওয়া যাবে না। নিয়োগে এনটিআরসিএ’র মেধাক্রম/মনোনয়ন/নির্বাচন বাধ্যতামূলক।
নীতিমালার নির্ধারিত যোগ্যতা ছাড়া এমপিওবিহীন প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত প্রধান বা সহকারী প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্দেশনা কী হবে তা উল্লেখ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ওই ধরনের শিক্ষকরা এক ধাপ নিচে বেতন-ভাতা পাবেন। কিন্তু এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত যোগ্যতাবিহীন অসংখ্য প্রধান বা সহকারী প্রধান শিক্ষক কর্মরত আছেন। নীতিমালায় ওইসব শিক্ষকের ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই। তবে নির্ধারিত যোগ্যতা ছাড়া এসব পদে নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। শিক্ষায় ডিগ্রি না থাকলে বা জাতীয় বেতন স্কেলে ১০ম গ্রেড না পেয়ে থাকলে কেউ উচ্চতর গ্রেডে বেতন-ভাতা পাবেন না। নীতিমালায় পদোন্নতি, উচ্চতর স্কেল এবং টাইম স্কেলে বিধান রাখা হয়েছে।
কোনো প্রতিষ্ঠানে জনবল কাঠামোর অতিরিক্ত শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ করলে বেতন-ভাতা ও আনুষঙ্গিক সুবিধার শতভাগ (প্রতিষ্ঠানকে) পরিশোধ করতে হবে। ইনডেক্সধারী শিক্ষক-কর্মচারী অন্য প্রতিষ্ঠানে যোগ দিলে তার পূর্ব অভিজ্ঞতা গণনাযোগ্য হবে। তবে যোগদানের আগের বকেয়া প্রাপ্য হবেন না। ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের ক্ষেত্রে তাদের প্রথম নিয়োগকালীন শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রযোজ্য। এমপিওভুক্ত কোনো শিক্ষক বা কর্মচারী একাধিক পদে চাকরি বা আর্থিক লাভজনক পদে নিয়োজিত থাকতে পারবেন না। নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাজীবনে শুধু একটি তৃতীয় বিভাগ/সমমান গ্রহণযোগ্য হবে। এ নীতিমালা জারির পর কেউ যদি বকেয়াপ্রাপ্য হন, সে ক্ষেত্রে তা পরিশোধ করা হবে না।
বাড়তি শিক্ষক পাবে প্রতিষ্ঠান : নীতিমালায় শিক্ষক নিয়োগে বড় ধরনের পরিবর্তনের বিধান রাখা হয়েছে। বর্তমানে প্রতিটি নিু মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বাংলা, ইংরেজি ও সামাজিকবিজ্ঞান বিষয়ে একজন করে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া যায়। নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী, ইংরেজি বিষয়ের জন্য আলাদাভাবে একজন শিক্ষক থাকবেন। বাকি দুই বিষয়ের জন্য আরও একজন নিয়োগের সুযোগ থাকবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের শিক্ষক এমপিওভুক্ত হবেন। বর্তমানে সামাজিক বিজ্ঞান ও ভৌত বিজ্ঞানে (রসায়ন ও জীববিজ্ঞান) একজন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। প্রস্তাবিত নীতিমালায় প্রত্যেক বিষয়ের জন্য আলাদা শিক্ষক নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া কর্মচারীর সংখ্যাও বাড়ানোর প্রস্তাব আছে। সব মিলিয়ে লক্ষাধিক পদ বাড়বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে সারা দেশে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে ২৭ হাজার ৮১০টি। এমপিও না পাওয়া প্রতিষ্ঠান আছে আরও প্রায় ১০ হাজার। সরকার সর্বশেষ ২০১০ সালে এক হাজার ৬২৪টি প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করেছিল।