এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : বাঙালির সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখের হাওয়া লেগেছে অর্থনীতিতে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বৈশাখে কর্মীদের বোনাস দেয়ায় বাজারে টাকার জোগান বেড়েছে। ফলে বৈশাখকে কেন্দ্র করে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়েছে। বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক বিক্রি বেড়েছে। কার্ড ও মোবাইল ফোনে শুভেচ্ছা বিনিময় করা হচ্ছে। এ উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে বসেছে মেলা। বৈশাখে থাকছে রকমারি বাঙালি খাবারের আয়োজন। এ উৎসবের মূল আকর্ষণ ইলিশ। বর্তমানে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও বিভিন্ন হিমঘরে (কোল্ডস্টোরেজ) মজুদ করা ইলিশ বাজারজাত শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। বৈশাখের অর্থনীতির সুনির্দিষ্ট আকার নিয়ে এখনও প্রাতিষ্ঠানিক কোনো গবেষণা হয়নি। তবে একটি সূত্র জানায়, বৈশাখে সম্ভাব্য লেনদেনের পরিমাণ হবে ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা।
নতুন পোশাক কিনতে প্রতিদিনই ভিড় বাড়ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে নামিদামি শপিংমল পর্যন্ত সবখানেই বৈশাখের ছাপ পড়েছে। ফ্যাশন হাউসগুলোয় বাহারি রং ও ডিজাইনের বাঙালি পোশাকের সমারোহ। ক্রেতা আকর্ষণে বিভিন্ন কোম্পানি বিশেষ মূল্যছাড়ও দিয়েছে। এদিকে দুই বছরে অনলাইনে কেনাকাটায় গ্রাহকের আগ্রহ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। পিছিয়ে নেই নিত্যপণ্য, ফুল, মৃৎশিল্প ও গহনার ব্যবসায়ীরা। গ্রাম থেকে শহর সর্বত্রই বৈশাখ ঘিরে জমজমাট। চলছে বাংলা নববর্ষ বরণ করতে প্রস্তুতি। বিভিন্ন স্থানে বৈশাখী তাঁত মেলা শুরু হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ড ঘিরে অর্থনীতির লেনদেন বাড়ছে কয়েকগুণ। সবকিছু মিলে বৈশাখকে ঘিরে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নতুন গতি এসেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ায় অর্থনীতিতে গতি বাড়বে। তবে এতে মূল্যস্ফীতিও কিছুটা বাড়বে।
এ ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে পুরো জাতি উৎসবে মেতে উঠে। অর্থনীতিতে এর একটি ইতিবাচক দিক রয়েছে। কারণ এতে দেশে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। তার মতে, চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ঠিক রাখতে পারলে এ উৎসব পুরোটাই ইতিবাচক বলা যায়। তিনি আরও বলেন, সরকারি চাকরিজীবী ও কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাও বোনাস পেয়েছে। বাজারে এই বাড়তি টাকা আসায় কিছু মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। এতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টি হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্য উৎসবের সঙ্গে বৈশাখের সুনির্দিষ্ট কয়েকটি পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত ঈদ, কোরবানি, পূজা ও বড়দিনের উৎসব নির্দিষ্ট ধর্ম অনুসারীরা পালন করে থাকেন। কিন্তু বৈশাখ হল সর্বজনীন বাঙালির উৎসব। অন্য উৎসবে বিদেশি পণ্যের ব্যবহার বেশি। কিন্তু বৈশাখে ৯০ শতাংশই দেশের পণ্য ব্যবহার হয়ে থাকে। এছাড়া বৈশাখ শুধু ঘরোয়া উৎসব নয়। হোটেল-রেস্তোরাঁ এমনকি পাঁচতারকা হোটেলেও জমজমাট আয়োজন হয়ে থাকে। এছাড়া ঈদ-কোরবানিতে মানুষ গ্রামে চলে যায়। কিন্তু বৈশাখে যে যেখানে থাকে, সেখানেই উৎসব পালন করে। ফলে এ উৎসব এককেন্দ্রিক নয়। এ উপলক্ষে বিভিন্ন কোম্পানি বিশাল ছাড় দেয়। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক পণ্যে ছাড় দেয়া হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে গ্রাহককে ছাড় দিচ্ছে। নির্দিষ্ট শপিংমলে বা রেস্টুরেন্টে ১০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছে আমেরিকান এক্সপ্রেস। এছাড়া ভিসা ও মাস্টার কার্ডেও ছাড় রয়েছে। হোটেল-রেস্তোরাঁ ও পর্যটন কোম্পানিগুলোও বিশেষ ছাড় দিচ্ছে। ব্র্যান্ডের জুতা কোম্পানি বাটা ও অ্যাপেক্সে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড় দিচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বৈশাখে বেশি কেনাকাটা হয় পোশাক। বছরের ২০ শতাংশ কেনাকাটা হয় বৈশাখে। শাড়ি, পাঞ্জাবি ও ফতুয়া বেশি বিক্রি হয়। এশিয়ার বৃহত্তম মার্কেট যমুনা ফিউচার পার্ক ঘুরে দেখা গেছে, অভিজাত ও মধ্যম আয়ের ক্রেতাদের জন্য সব ধরনের বৈশাখী সাজ ও পোশাক কিনতে ব্যাপক ভিড়। নামিদামি ব্র্যান্ডের শোরুমগুলোয় উপচেপড়া ভিড়। বিশেষ করে আড়ং, অঞ্জন’স, দেশী দশ, নবরূপা, মেট্রো, জেন্টালপার্ক, ইনফিনিটি, ক্যাটসআইসহ দেশের শীর্র্ষ ব্র্যান্ডগুলো সাজিয়েছে বৈশাখী পোশাকের পসরা। বিভিন্ন ধরনের পোশাক ৫ থেকে ৫০ শতাংশ মূল্যছাড়ে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রায় প্রতিটি দোকান ঘুড়ি, মুখোশ ও লাল-নীল বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে।
যমুনা ফিউচার পার্কের অঞ্জন’স ফ্যাশন হাউসের সেলস এক্সিকিউটিভ রেজাউল করিম যুগান্তরকে জানান, মেয়েদের রং-বেরঙের থ্রি-পিস, কুর্তি ও শাড়ি এবং ছেলেদের জন্য পাঞ্জাবি ও ফতুয়া বেশি বিক্রি হচ্ছে। শিশুদের জন্যও রয়েছে দারুণ সংগ্রহ। গতবারের তুলনায় এবার পোশাকের দাম বেশি হবে না।
রাজধানীর শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন রং ও বাহারি ডিজাইনের পোশাকের পসরা সাজিয়েছেন দোকানিরা। রয়েছে মেয়েদের বাঙালিয়ানা সাজের গলার মালা, দুল ব্রেসলেট, চুড়ি ও কারুকাজের হাতব্যাগও। ছেলেদের পোশাকে রয়েছে বিভিন্ন রঙের পাঞ্জাবি, লুঙ্গি ও গামছা। শিশুদের বিশেষ আকর্ষণ ধুতি ও রং-বেরঙের পাঞ্জাবি। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈশাখ উপলক্ষে এবার বিভিন্ন ধরনের পাঞ্জাবি ৮০০ থেকে ২৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফতুয়া পাওয়া যাবে ৪০০ থেকে ৮০০ টাকায়। এছাড়া মেয়েদের থ্রি-পিস মিলবে ১২০০ থেকে ৩২০০ টাকায়। ফতুয়া বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকায়।
শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটের হাল ফ্যাশনের ব্যবসায়ী মো. জুলহাস বলেন, বৈশাখী পোশাকের দাম খুব বেশি নয়। সময়ের সঙ্গে কিছুটা দাম ওঠানামা করে। সারা বছর বেচাকেনা কম হলেও বৈশাখে বিক্রি বাড়ে। ফ্যাশনপ্রেমীদের মার্কেট রাজধানীর বেইলি রোড ঘুরে দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা এখন চরম ব্যস্ত সময় পার করছেন। ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণে সেখানকার সব ফ্যাশন হাউস রাঙিয়ে তোলা হয়েছে নানা রঙের বৈশাখী পোশাক দিয়ে। রয়েছে লাল-নীল বাতিতে বর্ণিল আলোকসজ্জাও।
বেইলি রোডে কেনাকাটায় আসা গ্রামীণফোনের কর্মকর্তা আশিকুল আরশাদ জানান, উৎসবটি ঈদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। ঈদের মতো কেনাকাটার বাজেট করেছেন তিনি। ব্যবসায়ীরা জানান, এ বছর বেচাকেনা বেশ ভালো। সামনের দিনগুলোয় বেচাকেনা আরও বাড়বে। লাল-সাদা শাড়ি ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। লেডিস গ্রাউন্ডের দাম ২ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা। বেইলী রোডের ‘তাঁত কুটির’ দেশীয় ফ্যাশন হাউসের ব্যবস্থাপক সিপলু যুগান্তরকে বলেন, দেশজ বৈশিষ্ট্য ও ধারা বজায় রেখে লাল-সাদার পাশাপাশি উজ্জ্বল রঙের পোশাক উপস্থাপন করা হয়েছে। নির্দিষ্ট মডেলের শাড়িতে থাকবে আকর্ষণীয় গিফটসহ নানা উপহার। বরাবরের মতো ঢোল, তবলা, একতারা, কুলা, বাঁশি, ছবিসংবলিত পোশাকগুলো বেশি বিক্রি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ক্রেতাদের কাছে সুতি, ভয়েল, নেট, ধুপিয়ান ও লিলেনের পোশাকের কদর বেশি। সেক্ষেত্রে ছেলেদের ফতুয়া বয়স ও সাইজ ভেদে ৪০০ থেকে ১ হাজার টাকা, পাঞ্জাবি ৯৫০ থেকে ৩ হাজার টাকা, টি-শার্ট ২০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর মেয়েদের থ্রি-পিস ১ হাজার ২০০ থেকে ৪ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
পার্লার ও জুয়েলারি দোকানেও ভিড় বেড়েছে। রঙিন ম্যাগাজিন এরই মধ্যে বাজারে এসেছে। প্রবাসী স্বজনদের কাছে পছন্দ অনুযায়ী নববর্ষের উপহার এরই মধ্যে পাঠানো হয়েছে। পহেলা বৈশাখে তাজা ফুলের চাহিদা রয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠানের নতুন মিউজিক ভিডিও বাজারে এসেছে।