আমারদেশ লাইভ, ঢাকা : ‘সেই দিন আমার আট বছরের ছোট মেয়ে হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করল, আম্মুু রেপ মানে কী? ধর্ষণ মানে কী? টিভিতে সারাক্ষণই তো শুনি। ১২ বছরের বড় মেয়ে কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলল, আম্মু টিভি আর পত্রিকায় রেপের সংবাদ আসছেই।’ কথাগুলো বলছিলেন মতিঝিল এলাকায় একটি বেসরকারি ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার নাজনিন সুলতানা বেবী। বেবী বললেন, ‘আমার দুই মেয়ে স্কুলভ্যানে স্কুলে আসা-যাওয়া করে। বিশ্বাস করুন, মেয়ে দুটি যতক্ষণ না বাসায় ফিরে, ততক্ষণ আমি ব্যাকুল থাকি। চিন্তায় শরীর কাঁপতে থাকে। একের পর এক ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণ শেষে নির্মমভাবে হত্যার সংবাদ আমাদের মতো মায়েদের আতঙ্কিত করে তুলছে।’
সাম্প্রতিক সময়ে কন্যাশিশু ও নারী ধর্ষণ, ধর্ষণ শেষে হত্যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে প্রকাশের পর সমাজ, অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। ২৩ মার্চ লক্ষ্মীপুর রামগঞ্জ এলাকায় ৭ বছরের কন্যাশিশু নুশরাত জাহান নিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। পরে ধর্ষণকারীরা তার লাশ লুকিয়ে রেখে ২ দিন পর স্থায়ী বিলে ফেলে দেয়। সিলেটের ব্রাহ্মণডোরা গ্রামে বিউটি আক্তার নামে এক কিশোরীকে অপহরণের পর ১৬ মার্চ নির্মমভাবে হত্যা করে তার লাশ হাওরে ফেলে দেয়া হয়। ২৪ ফেব্র“য়ারি রাজধানীর পল্লবীতে আঁখি আক্তার নামে এক কলেজছাত্রীকে নিজ ঘরে ধর্ষণ শেষে হত্যা করে তার লাশ বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় ফেলে রাখা হয়। ৩ ফেব্র“য়ারি নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লায় ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী মোনালিসা আক্তারকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়। পরে হত্যাকারী লাশের ওপর মোনালিসার রক্ত দিয়ে নামের প্রথম অক্ষর লিখে যায়। ২১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ থানা এলাকায় ফাতেমা আক্তার মীম নামে ৮ বছরের এক শিশুকে শারীরিক নির্যাতন শেষে খুন করা হয়।
২৬৯টি বেসরকারি সংস্থার প্লাটফর্ম বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম, মহিলা পরিষদ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের প্রতিবেদন ও বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, দেশে ধর্ষণ এখন মহামারী আকার ধারণ করেছে। ২০১৭ সালের প্রথম তিন মাসের চেয়ে চলতি বছরের তিন মাসে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণ শেষে হত্যার ঘটনা বেড়েছে প্রায় ১০০ ভাগ। চলতি বছরের তিন মাসে ১৭৬ জন শিশু ও ১৮৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর ১৯ নারী ও ২৫ জন কন্যাশিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ২ জন ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে। এ সময়ের মধ্যে গত বছর শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ১৪৫ এবং নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ১৫১ জন। এছাড়া গত তিন মাসে ৪২২ জন শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। যার মধ্যে ৭১ জনকে হত্যা, ২৬ শিশু আত্মহত্যা করে। নিখোঁজের পর ২ জন ও বিভিন্ন সময়ে ২০ শিশু ও ১৭ নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন যুগান্তরকে জানান, একটি সমাজের কন্যাশিশু ও নারীরা নিরাপদ নয় মানেই হচ্ছে এ সমাজ প্রতিবাদ, প্রতিরোধহীন হয়ে যাচ্ছে। এমন মানবতাবিরোধী নৃশংস ঘটনার বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে। বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে জানান, ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণের একশটি অপরাধে গড়ে দুইটির বেশি শাস্তি হয় না। যেহেতু এসব মানবতাবিরোধী ঘটনার বিচার হয় না, তাই এমন বর্বর ঘটনা সমাজে বাড়বে, এটাই তো স্বাভাবিক। ধর্ষণের পর হত্যার মতো নৃশংস ঘটনায় অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বলেই অপরাধীরাও এমন বর্বর ঘটনা পুনরায় ঘটাচ্ছে। জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি বলেন, কন্যাশিশু-নারী ধর্ষণ, ধর্ষণ শেষে খুন গত বছরের তিন মাসের চেয়ে চলতি বছরের তিন মাসে দ্বিগুণ হয়েছে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে কন্যাশিশু ও নারীদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত অন্ধকারের দিকে চলে যাবে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা জানান, গত তিন মাসে (জুনয়ারি-মার্চ) সারা দেশে ১৮৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর ১৯ জন নারীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারম্যান এমরানুল হক চৌধুরী জানান, শিশু কিংবা নারী ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধির কারণ মূলত বিচারহীনতা এবং বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সূত্রে জানা যায়, মার্চে ৮৮ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। যার মধ্যে ১২ জন গণধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর ৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। পরিষদের লিগ্যাল এইড বলছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা আছে, ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। কিন্তু এমন অনেক নজির আছে যে বছরের পর বছর মামলা চলছে।
কন্যাশিশু ও নারী নির্যাতন বন্ধ করতে না পারলে উন্নয়ন টেকসই হবে না জানিয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড ইউনিটের পরিচালক অ্যাডভোকেট মাকছুদা আক্তার লাইলী বলেন, বিচার নিশ্চিত করতে পারলে নৃশংস ঘটনা নিশ্চয়ই কমে আসত।