এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : আসন্ন গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে বিপুল সংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। নানা তৎপরতার পরও এই পদে একক প্রার্থী নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে দল দুটি। বিদ্রোহীরা দু’দিন ধরে দল সমর্থিত প্রার্থীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গণসংযোগ চালাচ্ছেন। এতে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। যার নেতিবাচক প্রভাব শুধু দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থীর ওপরই নয়, মেয়র প্রার্থীর প্রার্থীদের ওপর পড়তে পারে- এমন আশঙ্কা উভয় দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের। তাদের মতে, যেসব কাউন্সিলর প্রার্থীর (বিদ্রোহীসহ) সঙ্গে মেয়র প্রার্থীদের সুসম্পর্ক রয়েছে, ওইসব প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বীরা দলীয় মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ভোটের মাঠে একক প্রার্থী নিশ্চিত করতে দুই দলই মরিয়া হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়ভাবে নেয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। এক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে আছেন ক্ষমতাসীনরা। বিদ্রোহীরা যদি নির্বাচনী মাঠ ছেড়ে না দেন, সেক্ষেত্রে নির্বাচনের আগেই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে তারা। অন্যদিকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানোর পরও যদি বিদ্রোহীদের নিষ্ক্রিয় না হন, সেক্ষেত্রে কৌশলগত কারণে নমনীয় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। এ মুহূর্তের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে কোনো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধেই কঠোর ব্যবস্থা না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দলটি।
১৫ মে অনুষ্ঠেয় গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর (সংরক্ষিতসহ) পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ১৭০ ও বিএনপির ৫৮। এর মধ্যে গাজীপুরে ১৩৯ ও বিএনপির ৩৫ এবং খুলনায় আওয়ামী লীগের ৩১ ও বিএনপির ২৩ জন বিদ্রোহী রয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই কাউন্সিলর পদে একাধিক প্রার্থীর বিষয়ে কঠোর অবস্থানের কথা বলে আসছে। এরপরও যারা দলের পদে থেকে দল সমর্থিত প্রার্থীর বাইরে গিয়ে নির্বাচন করছেন, তাদের এবার আর ছাড় দেয়া হবে না। নির্বাচনকালীনই তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গাজীপুর সিটি নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, কাউন্সির প্রার্থীদের বিষয়ে স্থানীয় নেতারা যে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন। কেন্দ্র থেকে এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই। আমরা শুধু মেয়র প্রার্থীকে নিয়ে কাজ করছি।
তিনি বলেন, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় শেষ হলেও সমস্যা নেই। একটি ওয়ার্ডে দুই বা তিনজন প্রার্থী থাকলে একজন রেখে বাকিরা দলের স্বার্থে নির্বাচনের মাঠ ছেড়ে দেবেন। আশা করছি, প্রতিটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরে একক প্রার্থী হবে।
এদিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, শেষ পর্যন্ত যদি বিদ্রোহী প্রার্থী থেকেই যান, সেক্ষেত্রে যারা জয়ী হবেন, তাদের দলের পক্ষ থেকে সমর্থন দেয়া হবে- এমন একটি অনানুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে দল দুটি। এক্ষেত্রে দলীয় মেয়র প্রার্থীরা যাতে কোনো কাউন্সিল প্রার্থীর পক্ষাবলম্বন না করেন, সে বিষয়টি নিশ্চিত করবে দু’দলের হাইকমান্ড। এরপরও বিজয় নিশ্চিত করতে ভোটের মাঠে একক প্রার্থী রাখতে দলের পক্ষ থেকে নানা তৎপরতা চালানো হচ্ছে।
সূত্র আরও জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দুই সিটির নির্বাচনকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এ নির্বাচনের ফল দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটারদের ওপর একধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়বে বলে ধারণা তাদের। এ নির্বাচনে শাসকদল আওয়ামী লীগ চায় বিজয়ী হয়ে দুটি সিটি কর্পোরেশন করায়ত্ত করতে। অন্যদিকে নিজেদের দখলে থাকা মেয়র পদ ধরে রাখতে মরিয়া বিএনপি। এজন্য জোটগতভাবে নির্বাচনকেই প্রাধান্য দিচ্ছে দুই দল। তারা শুধু মেয়র পদেই নয়, কাউন্সিলর পদেও জোটগতভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে এবার ভোটের মাঠে চালেঞ্জ নিয়ে নেমেছে আওয়ামী লীগ। গত কয়েক বছরে অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনগুলোয় একাধিক প্রার্থী থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিশ্চিত জয় হাতছাড়া হয়েছে তাদের। পরাজয়ের কারণ উদ্ঘাটনে গঠিত তদন্ত টিমের রিপোর্টেও সেই চিত্র ওঠে এসেছে। এবার সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চায় না দলটি। কয়েকদিনের মধ্যে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষনেতাদের নিয়ে গঠিত সমন্বয় কমিটি গাজীপুর ও খুলনা যাবে। তারা মেয়র পদে দলীয় প্রার্থীর প্রচারণার পাশাপাশি কাউন্সিলর পদে বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করবে।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, প্রতিটি নির্বাচনে আমাদের দলের প্রার্থীদের একটি চ্যালেঞ্জ থাকে। দলের বাইরে গিয়ে অনেকে নির্বাচন করে। দলীয় প্রার্থী হেরে যায়। এটা দলীয় কোন্দলের কারণে হলেও আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে সুরাহার চেষ্টা করি। তিনি বলেন, গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচনে প্রতিনিধি টিম পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে এটা যথা সময়েই হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিটি ওয়ার্ডে একাধিক প্রার্থী থাকলে তার প্রভাব দলীয় মেয়র প্রার্থীর ওপর পড়বে। এজন্য কেন্দ্র থেকে দুই সিটিতে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি টিম পাঠানো হবে। তারা স্থানীয় নেতাদের নিয়ে বসে কাউন্সিলর পদে ভোটের মাঠে অন্তত একক প্রার্থী রাখার প্রয়াস চালাবেন।
বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রতি কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, এবার আর কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। দল থেকে বারবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরপরও যদি কেউ প্রার্থী হয়ে থাকে, তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা দ্রুত নেয়া হবে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য ‘এসিড-টেস্ট’। এখানে হারলে প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়তে পারে। এজন্য দুই সিটিতে দলীয় প্রার্থী জিতিয়ে আনতে কমতি নেই আওয়ামী লীগের। গাজীপুর ও খুলনা সিটিসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পরাজয়ের শিক্ষা কাজে লাগিয়ে জয় নিশ্চিত করতে চায় দলটি। দলীয় কোন্দল ও বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় ২৯ মার্চ অনুষ্ঠিত গাজীপুর সদরের পিরুজালী, মির্জাপুর ও ভাওয়ালগড় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়েছে। পরাজয়ের কারণ উদ্ঘাটনে গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সিকদার মোশারফ হোসেনকে আহ্বায়ক করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপি ও তার ছেলের ভূমিকাকে দায়ী করা হয়েছে। একই সঙ্গে দলের একাধিক নেতা ও তাদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষে ভোট চাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে।
এছাড়া সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন পরিষদ ভোটে চারটিতেই ভরাডুবি হয়েছে আওয়ামী লীগের। এ চারটিতে পরাজয়ের পেছনে বিদ্রোহীদের দায়ী করেছেন পরাজিত নৌকার প্রার্থীরা।
এমন চিত্র সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অধিকাংশ ইউনিয়ন, পৌরসভার নির্বাচনে। পরাজয়ের কারণ হিসেবে স্থানীয় প্রভাবশালী আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী ও নেতাদের দায়ী করেছে তৃণমূল আওয়ামী লীগ। বিদ্রোহের কারণে দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। একই সঙ্গে দলে অন্তর্কোন্দল সৃষ্টিকারী নেতাদের আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না দেয়া, দল থেকে বিহষ্কারের কথা বলেছেন। একই সঙ্গে এসব বিদ্রোহী নেতার তালিকা করতে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৪নং ওয়ার্ডে বিএনপির একক প্রার্থী। এখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী তিনজন। একইভাবে ২, ৩, ১১, ১২ ও ১৮নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী থাকলেও বিএনপির একক প্রার্থী। অন্যান্য ওয়ার্ডের অধিকাংশেই উভয় দলের একাধিক প্রার্থী আছেন। আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থীর কারণে প্রতিপক্ষের একক প্রার্থীর জিতে আসার পথ সুগম করবে বলে ধারণা অনেকের।
একই অবস্থা গাজীপুরেও। এখানকার ১নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ৬ জন। আর বিএনপির একজন। মঙ্গলবার এ ওয়ার্ডের একাধিক ভোটার যুগান্তরের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আওয়ামী লীগের একাধিক একাধিক প্রার্থী হওয়ায় তাদের জেতার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এতে ভোটের মাঠে মেয়র পদেও এর প্রভাব পড়বে।
এদিকে গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে একক প্রার্থী করার চেষ্টা করছে বিএনপি। এজন্য বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে সমঝোতায় যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে বিদ্রোহীরা সরে না দাঁড়ালেও কেন্দ্র থেকে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা নেই। গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলন বলেন, বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে সমাঝোতার চেষ্টা চলছে। এ ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্র থেকে কঠোর হওয়ার ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই। বিএনপি ঐক্যবদ্ধভাবে এ নির্বাচন করতে চায়। শেষপর্যন্ত সমঝোতা চালিয়ে যাব। আশা করছি বিদ্রোহী প্রার্থীরা দলের স্বার্থে নিজ থেকে সরে দাঁড়াবেন। তারপরও দু-একটি জায়গায় সমস্যা হলে সে ব্যাপারে পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
খুলনা জেলা বিএনপির সভাপতি শফিকুল আলম মনা বলেন, খুলনা সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে বিএনপি সমর্থিত বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা কম। এর জন্য একটি কমিটি করা হয়েছে। তারা বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছেন। শেষপর্যন্ত তাদের সঙ্গে সমঝোতা না হলে কেন্দ্র থেকে যে নির্দেশনা দেয়া হবে, তা বাস্তবায়ন করা হবে।
গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচন পরিচালনায় আলাদা দুটি ‘সমন্বয় কমিটি’ করেছে বিএনপি। এছাড়া গাজীপুর সদর ও টঙ্গীকে দুটি জোনে ভাগ করে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পাশাপাশি ৫৭ ওয়ার্ডে ৫৭টি টিমও গঠন করেছে দলটি। গাজীপুর সিটিতে ২০ দলীয় জোটেরও রয়েছে নির্বাচন পরিচালনায় আরেকটি কমিটি। খুলনায়ও সমন্বয় কমিটির পাশাপাশি জেলা, মহানগর ও ২০ দলীয় জোটেরও নির্বাচন পরিচালনায় আলাদা তিনটি কমিটি করা হয়েছে।
নির্বাচন পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত এক নেতা যুগান্তরকে জানান, কেন্দ্র থেকে গঠিত কমিটিকে বিদ্রোহী কাউন্সিলরদের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো কথাই না বলার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এদের বিষয়ে স্থানীয় নেতারা বসে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে এসব সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে মেয়র প্রার্থীর ভোটের ওপর কোনো প্রভাব যেন না পড়ে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে স্থানীয় নেতাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, বিএনপি মূলত দুই সিটির মেয়র নির্বাচনে গুরুত্ব দিচ্ছে। এ দুই সিটিতে মেয়র প্রার্থীর জয় পেতে চায় দলটি। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এ নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে বিএনপি। এজন্য বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের ব্যাপারে কেন্দ্র থেকে কোনো নির্দেশনা দেয়নি তারা। তবে বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে সমঝোতা করার জন্য স্থানীয় নেতাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে মেয়র প্রার্থীর ভোটে প্রভাব পড়ে- এমন কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়ার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে স্থানীয় নেতাদের। এজন্য খুব সতর্কতার সঙ্গে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছেন তারা।
খুলনা নগরীর এক নেতা বলেন, দীর্ঘদিন বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। এ সময়ে দলের জন্য অনেক নেতাই শ্রম দিয়েছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বিদ্রোহী প্রার্থীরা এখন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে পারবেন না। তাই তারা যাতে ভোটের মাঠ থেকে সরে যান, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে।
খুলনা সিটি নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বিএনপি মূলত মেয়র নির্বাচন নিয়ে ভাবছে। তারপরও কাউন্সিলর প্রার্থীদের নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে। সেখানে যেসব ওয়ার্ডে দলের একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থী আছেন একক প্রার্থী করার জন্য তাদের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা চলছে।
গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন বিদ্রোহী প্রার্থীরা। এ নিয়ে এলাকায় দলীয় নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। অনেক প্রার্থী দীর্ঘদিন দলের সঙ্গে যুক্ত থেকেও কাউন্সিল পদে কাক্সিক্ষত মনোনয়ন না পেয়ে অনেক প্রার্থী চরম ক্ষুব্ধ হয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা মেয়র প্রার্থীর চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কেন্দ থেকে কাউন্সিলর পদে দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণার পর গাজীপুরে মনোনয়নবঞ্চিত কাউন্সিলর প্রার্থীরা ক্ষোভে ফুসে উঠেছেন। তারা না পারছেন প্রতিবাদ করতে, না পারছেন দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিতে। এ অবস্থায় বিদ্রোহী প্রার্থীদের মনে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ২১নং ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর মো. ফারুক আহমেদ। তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়ে টিফিন ক্যারিয়ার প্রতীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এই ওয়ার্ডে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে ঘুড়ি প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন গাজীপুর মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মো. দেলোয়ার হোসেন বাদল। তিনি জানান, ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সঙ্গে পূর্বে কোনো ধরনের আলোচনা না করেই একতরফাভাবে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করায় এলাকার নেতাকর্মীরা চরম হতাশ ও ক্ষুব্ধ। তিনি জানান, নির্বাচন থেকে কোনোমতেই তিনি সরে যাবেন না। এই ওয়ার্ডে তিনি ছাড়াও একাধিক প্রার্থী রয়েছেন। তারাও নিজ নিজ অবস্থানে থেকে নির্বাচন করে যাচ্ছেন।
সিটি কর্পোরেশনের ৭নং ওয়ার্ডে মো. হুমায়ূন কবীর কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। তিনি লাটিম প্রতীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ ওয়ার্ডে বিদ্রোহী প্রার্থী কাওসার আহমেদ ঠেলাগাড়ি প্রতীকে নির্বাচন করছেন। তিনি বলেন, দল আমাকে মনোনয়ন না দিলেও নির্বাচনে লড়াই চালিয়ে যাবেন। কাউন্সিলর পদে দলের চাইতে এলাকায় গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিরাই নির্বাচিত হয়ে থাকেন। সেই ক্ষেত্রে দল নয়, নিজের যোগ্যতায় এলাকাবাসীর ভালোবাসা নিয়ে নির্বাচিত হয়ে জনগণের সেবা করে যেতে চান।
এদিকে আওয়ামী লীগ থেকে দলীয়ভাবে কাউন্সিলর প্রার্থী মনোনয়ন দিলেও বিএনপি গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে দলীয়ভাবে কোনো কাউন্সিলর প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়নি। গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী ছাইয়েদুল আলম বাবুল যুগান্তরকে জানান, গাজীপুর সিটিতে দলীয়ভাবে আনুষ্ঠানিক কোনো কাউন্সিলর প্রার্থীকে সমর্থন বা মনোনয়ন দেয়া হয়নি। বেশিরভাগ স্থানে আমাদের একক প্রার্থী রয়েছেন। আর সেই প্রার্থীকে দলীয় মনোনয়ন দেয়ার ব্যাপারে মৌখিকভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া কয়েকটি ওয়ার্ডে দলের একাধিক কাউন্সিলর প্রার্থী আছেন, তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলছি। আশা করছি দলীয় কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী থাকবে না।
গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মজিবুর রহমান জানান, গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয়ভাবে কাউন্সিলর প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এখানে আমাদের কিছুই করার নেই। আমরা মেয়র প্রার্থী নিয়ে প্রচারণায় আছি। যেহেতু মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি যদি কোনো প্রার্থীকে সমর্থন দেন তাহলে অপর প্রার্থীরা মনোক্ষুণ্ণ হবেন। এতে নৌকার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই আমরা আপাতত মেয়র প্রার্থীর প্রচার-প্রচারণাকে গুরুত্ব দিচ্ছি। কাউন্সিলর প্রার্থীদের ব্যাপারে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। এটা কেন্দ্রের ব্যাপার।
খুলনা ব্যুরো জানায়, খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিষ ফোঁড়া হিসেবে দেখা দিয়েছে বিদ্রোহী প্রার্থীরা। এ বিদ্রোহ মেয়র পদের ভোটে প্রভাব না ফেললেও কাউন্সিলর পদে জয় পরাজয়ের হিসাব-নিকাশে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। নেতারা যদিও এ বিষয়টিকে উড়িয়ে দিচ্ছেন, তবে ভোটার এবং তৃণমূল নেতাকর্মীদের ভাবনায় ফেলেছে বিদ্রোহী প্রার্থীরা।
দলীয় সূত্র জানিয়েছে, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে নির্বাচন করা নিয়ে বড় দুই দলের কেন্দ থেকেই কঠোর নির্দেশনা ছিল। অতীতে নির্বাচনে যে ওয়ার্ড থেকে দলীয় মনোনয়নের বাইরে একাধিক প্রার্থী নির্বাচন করেছে সেখানে সেই দলের প্রার্থী হেরেছে। বিষয়টি নিয়ে ভাবনায় ফেলেছে বড় দু’দলের নেতাদের। দলীয় প্রার্থীকে জয়ী করতে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান ধরে রেখেছে দু’দলই। ইতিমধ্যে মহানগর আওয়ামী লীগের সভায় কেসিসির ২নং ওয়ার্ডের বিদ্রোহী প্রার্থী এফএম জাহিদ হাসান জাকিরকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলীয় এ সিদ্ধান্ত কেন্দ্রের কাছে জানানো হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন মহানগর আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য মিজানুর রহমান মিজান।
দলীয় সূত্র জানায়, গত নির্বাচনে ৩১নং ওয়ার্ড থেকে আ’লীগের প্রার্থী ছিল ৩ জন। একাধিক প্রার্থী থাকায় এ ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত হন জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী। যদিও এ ওয়ার্ডে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। তবে ভোটের হিসাবে তখন আ’লীগের তিন প্রার্থী মিলে নির্বাচিত কাউন্সিলর থেকে প্রায় ২ হাজার ভোট বেশি পান। এ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী হলে জয়ের পাল্লা আ’লীগের দিকেই ভারি হতো। একইভাবে নগরীর ৩০নং ওয়ার্ডে আ’লীগের প্রার্থী ছিলেন ৩ জন। বিএনপি এ ওয়ার্ডে একক প্রার্থী দেয়ায় জয়লাভ করেন। গেল নির্বাচনে নগরীর ২৭নং ওয়ার্ডে বিএনপির ৪ প্রার্থী থাকায় জয়লাভ করেছিলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জেডএ মাহমুদ ডন। একাধিক প্রার্থীর কারণে কয়েকটি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ পরাজিত হওয়ায় কাউন্সিলর পদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বিএনপি। ফলে প্যানেল মেয়র নির্বাচনে আ’লীগের কাউন্সিলররা তাদের পছন্দের কাউন্সিলরকে প্যানেল মেয়র নির্বাচিত করতে পারেননি।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা এসএম কামাল হোসেন বলেন, ‘আশা করি কোনো ওয়ার্ডেই বিদ্রোহী প্রার্থী থাকবে না। সবার সঙ্গেই যোগাযোগ অব্যাহত আছে। দু’চারদিনের মধ্যেই বিদ্রোহীরা দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে ভোট চাইতে শুরু করবে এবং পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে সমর্থনের কথা জানাবে। তারপরও যদি কেউ নির্দেশনা না মানে তখন অবাধ্যদের লিস্ট কেন্দ্রে পাঠানো হবে। কেন্দ্রই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেবে।’
এ বিষয়ে মহানগর আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক সংসদ সদস্য মিজানুর রহমান বলেন, ‘২নং ওয়ার্ডের বিদ্রোহী প্রার্থীকে দল থেকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় কমিটিকে জানানো হয়েছে। বাকি বিদ্রোহীদের নমনীয় করতে প্রতিদিন দফায় দফায় থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে বৈঠক চলছে। আশা করি কয়েক দিনের মধ্যেই বিদ্রোহীরা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে বিবৃতি দিয়ে প্রচারণায় অংশ নেবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘বড় দলে প্রার্থীদের সংখ্যা বেশি থাকে। সেক্ষেত্রে সাময়িক যে জটিলতা তা কেটে যাবে এবং এসব জটিলতা মেয়রের ভোটের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলবে না। সব প্রার্থীই মেয়র প্রার্থীর পক্ষে ভোট প্রার্থনা করে চলেছে।
বিএনপির মহানগর সাংগঠনিক সম্পাদক ফখরুল আলম বলেন, ‘১০ ও ২৬ নং ওয়ার্ডে বিএনপিতে মাত্র দু’জন বিদ্রোহী প্রার্থী আছে। কয়েকটি ওয়ার্ডে একাধিক প্রার্থী থাকায় আমরা উন্মুক্ত করে দিয়েছি। ফলে সেসব ওয়ার্ডের প্রার্থীদের আর বিদ্রোহী বলা যাবে না। এছাড়া এতে মেয়র প্রার্থীর ভোটের ওপরও কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না। কারণ তারা সবাই ধানের শীষের পক্ষে কাজ করছেন।’