এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত খুলনা সিটি নির্বাচন নিয়ে চলছে নানা আলোচনা বিচার-বিশ্লেষণ। প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে এ নির্বাচন সারা দেশের নজর কাড়ে। ভোটশেষে বিএনপি ব্যাপক ভোট জালিয়াতির অভিযোগ করলেও আওয়ামী লীগ একে ভিত্তিহীন এবং অপপ্রচার হিসেবে আখ্যায়িত করছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কেমন হলো খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন?
খুলনার ডাকবাংলা মোড়ে ভোটের পরদিন খবরের কাগজের স্টলে কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। একজন ব্যবসায়ী বলছিলেন, “খালেক ভাই নিঃসন্দেহে ভালো লোক। তার উন্নয়ন ছিল। কিন্তু আমরা চেয়েছিলাম সুন্দর একটা নির্বাচন। খুলনার জনগণ যদি বিবেকবান হন তাহলে এবার তাকে নির্বাচিত করবে। কিন্তু এভাবে নির্বাচিত হয়ে আসাটা আমার কাছে কাম্য ছিল না।” কর্মজীবী এক তরুণের অভিযোগ, “অনেকে ওপেন জালভোট দিয়েছে, অনেকে ভোট দিতে এসে ফিরে গেছে। ভোট দিতে পারেনি।”
নির্বাচন কমিশন কি তার দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছে এমন প্রশ্নে সেখানে উপস্থিত কয়েকজন বলে উঠলেন, “না, না।” অবশ্য পাশে দাঁড়ানো বয়স্ক একজন বলেন, “এটা কমিশনারদের দ্বন্দ্ব, মেয়রের না। কমিশনারদের দ্বন্দ্বে দুটো কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জালভোট হয়েছে প্রথম শুনলাম। প্রশাসন খুব ভাল পদক্ষেপ নিয়েছে।”
সাধারণ মানুষের বক্তব্যের যথার্থতা নির্ণয় করা মুশকিল। কে কোন দলের সেটিও বোঝা যায় না। তবে খুলনার নাগরিকদের বক্তব্য যাই হোক বোঝা দরকার নির্বাচনটি কেমন হলো।
ভোটের দিন সকাল থেকে খুলনা শহরে বেশকটি কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছি। সকালের দিকে যারা ভোট দিতে এসেছেন তারা অনেকেই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ভোটের পরিবেশও ছিল দৃশ্যত শান্তিপূর্ণ। কিন্তু সকাল থেকেই বিএনপির প্রার্থী অভিযোগ করেন, ৪০টি কেন্দ্রে তাদের এজেন্টদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। কোথাও ভয়-ভীতি দেখিয়ে এবং কোথাও মারধর করে বের করে দেয়া হয়েছে।
এমন অভিযোগও পাওয়া যায় যে আওয়ামী লীগের কর্মীরা দেখানোর জন্য ধানের শীষের ব্যাজ পরে বিএনপির প্রার্থীর এজেন্ট সেজে বসে আছে। যদিও আওয়ামী লীগের পক্ষে এসব অভিযোগ নাকচ করা হয়।
কিছু কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে যে বিএনপির এজেন্টরা সত্যিই অনুপস্থিত। আর অন্যদিকে, সব কেন্দ্রে এবং কেন্দ্রের বাইরে নৌকা মার্কার ব্যাজপরা কর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি।
ভোটকেন্দ্রগুলো কার্যত নৌকার কর্মীদের টহল এবং নিয়ন্ত্রণে ছিল বলেই মনে হয়েছে। পরিচয় গোপন রেখে কয়েকজন জানান, “কিছু কেন্দ্রে দলবেঁধে ঢুকে ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে ভোট কাটার ঘটনা ঘটেছে। প্রকাশ্যে কোনো দাঙ্গা হাঙামা না বাঁধিয়ে সুকৌশলে কাজ হয়েছে।”
দুপুরের পর কয়েক জায়গা থেকে ভোটে অনিয়মের ব্যাপক অভিযোগ আসে। যে কারণে তিনটি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করে দেয়া হয়। অনেকে ভোট দিতে এসে হতাশ হয়ে সেসব কেন্দ্র থেকে ফেরত গিয়েছেন।
ভোটের প্রকৃত অবস্থা বোঝার জন্য একটি কেন্দ্রে ভোট গণনার সময় উপস্থিত ছিলাম। ওই কেন্দ্রে ৬৮ শতাংশের ওপরে ভোট পড়েছে। ব্যালট বাক্স থেকে বের করে গণনার সময় দেখেছি কিছু ব্যালটের পেছনে সিল এবং স্বাক্ষর আছে। কিছু ব্যালটের পেছনে দেখেছি সিলমোহর আছে কিন্তু স্বাক্ষর নেই। আবার কিছু দেখেছি সিল স্বাক্ষর কিছুই নেই। নির্বাচনী কর্মকর্তারা ভোট গণনার এক পর্যায়ে স্বাক্ষরবিহীন একটি ব্যালট প্রিজাইডিং অফিসারকে দেখালে তিনি অবৈধ ঘোষণা করেন। পরক্ষণেই একইরকম একগাদা ব্যালট তার হাতে দেয়া হলে তিনি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। ওই সবগুলো ব্যালটই ছিল নৌকা মার্কায় দেয়া ভোট।
পরে ভোটকেন্দ্রে অবস্থানরত পুলিশের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রিজাইডিং অফিসার ব্যালটে স্বাক্ষরবিহীন ভোট বৈধ হিসেবে গণনার নির্দেশ দেন। এরপর আর ব্যালটে স্বাক্ষর আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা হয়নি।
এ ব্যাপারে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইনত এসব ভোট বাতিল হওয়ার কথা। কিন্তু স্বাক্ষরবিহীন সব ব্যালটকে বৈধ ধরে নিয়েই গণনা হয়েছে ১৮৬ নম্বর কেন্দ্রে।
ওই কেন্দ্রে নৌকা মার্কা পেয়েছে ১১৫৬ ভোট আর ধানের শীষ পেয়েছে ১৩৩ ভোট। ওই কেন্দ্রে বিএনপি প্রার্থীর কোনো এজেন্ট উপস্থিত ছিল না।
কেন্দ্রের গণনা শেষে ফলাফল নির্ধারণ হওয়ার পর প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি মন্তব্য না করেই দ্রুত বেরিয়ে যান।
কেন্দ্রের নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে আড়ালে কথা বলে জানা যায় ওই কেন্দ্রে ভোটে অনিয়ম হয়েছে। একই ব্যক্তি একাধিকবার ভোট দিয়েছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে। অপ্রাপ্তবয়স্করাও ভোট দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, “হুমকি দিয়েছে যে, কথা না শুনলে একজনও বাড়িতে ফিরতে পারবে না।” তার ভাষায় “এরে নির্বাচন কয় না।”
ভোটশেষে ১০৫টি কেন্দ্রে ব্যাপক অনিয়ম ও ভোট কাটার অভিযোগ তুলে পুনঃ নির্বাচন দাবি করেছেন বিএনপির প্রার্থী। আরো ৪৫টি কেন্দ্রে তদন্ত দাবি করা হয়েছে।
ভোটের পরদিন সংবাদ সম্মেলনে নজরুল ইসলাম মঞ্জু চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেছেন ওসব কেন্দ্রে অধিকাংশ ভোটে সিল স্বাক্ষর পাওয়া যাবে না। এছাড়া মেয়রের ভোট এবং কাউন্সিলরদের ভোটের তারতম্য রয়েছে বলেও তার দাবি।
মি. মঞ্জু বলেন, “এ সরকারের অধীনে এবং এ নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন সম্ভব নয়।” অবশ্য ভোটের দিন সকালে মি. মঞ্জুর বক্তব্য ছিল এ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ভোট সম্ভব নয় সেটিই তিনি খুলনার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে চান। বিএনপির কর্মী সমর্থকরা ভোটের দিন তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি।
এদিকে খুলনার এ ভোট জাতীয় নির্বাচনেও প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন অনেকে। নির্বাচন কমিশনের জন্যও ছিল এটি একটি পরীক্ষা। আওয়ামী লীগের দাবি বিএনপির এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন, অপপ্রচার। তারা নির্বাচন এবং কমিশনকে বিতর্কিত করতে চায়। আর নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও দাবি করা হয় বিচ্ছিন্ন দু’একটি ঘটনা ছাড়া খুলনার ভোট অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হয়েছে। এবং কমিশন সন্তোষ জানাচ্ছে খুলনায় এরকম নির্বাচন আয়োজন করতে পেরে।
ভোটের পর খুলনার অনেকেই নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাদের আস্থা কমেছে বলেই জানিয়েছেন। সার্বিকভাবে খুলনার এ ভোট নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি পর্যবেক্ষকরাও। নির্বাচনী কার্যক্রম দেখেছেন খুলনার শিক্ষাবিদ আনোয়ারুল কাদির।
তিনি বলেন, “পুরনো খুলনার টুটপাড়া, ইকবালনগর, শিপইয়ার্ড এই বেল্টে বেশকিছু অনিয়ম আমাদের চোখে পড়েছে। শুধু আমাদের চোখে না এটা কিছুকিছু জায়গায় একেবারে ওপেন হয়ে গিয়েছিল। আমাদের এখানকার নির্বাচনী রাজনীতিতে এই কাজটি চলছে। আমরা বারবারই চাইছিলাম যে এটি থেকে বের হয়ে আসতে। কিন্তু এই আশাটা আর পূরণ হলো না।”