এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : বছর শেষে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের সব প্রস্তুতি চলছে। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হবে এ নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন আর বিতর্ক থাকলেও বিরোধী জোটের দাবি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের
অধীনে নির্বাচন। আর সরকারি দল বলছে, সংবিধান অনুয়ায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। ক্ষমতাসীনদের কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনের সময় সরকার শুধু রুটিন কাজ করবে। নির্বাচনকালীন সরকারের পরিসর হবে ছোট।
এমন পাল্টাপাল্টি আলোচনার মধ্যে নির্বাচনী বড় জোট গঠনের চেষ্টায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। এক্ষেত্রে ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলো। ঈদের পর থেকেই এই ঐক্য প্রক্রিয়া শুরুর ইঙ্গিত দিয়েছেন নেতারা। প্রাথমিক আলোচনা ফলপ্রসূ হলে জাতীয় সমাবেশে ডেকে ঐক্যের ঘোষণা এবং কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে।
অনেক দিন থেকেই দুই জোটের বাইরে থাকা ছোট রাজনৈতিক দলগুলো জোটবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে। ঐক্য নিয়ে কথা বললেও মতের ঐক্য না হওয়ায় নেতারা এক প্ল্যাটফরমে আসতে পারেননি। তবে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবিতে বৃহৎ রাজনৈতিক জোট গঠনের সম্ভাবনা দেখছেন নেতারা। বিশেষ করে বিরোধী জোট ২০ দল একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন দাবিতে জাতীয় ঐক্যের আহবান করে আসছে অনেক দিন থেকে। একই দাবিতে জাতীয় ঐক্যের কথা বলছেন সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি প্রফেসর একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা। এসব দল ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এবং পেশাজীবী নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্ট নাগরিকদেরও এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার চিন্তা করা হচ্ছে। সূত্র বলছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে বৃহৎ নির্বাচনী জোট গড়ে তুলাই তাদের লক্ষ্য। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তারা বিরোধী জোটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছেন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের বাইরে থাকা এসব দলের নেতারা প্রায়শই ২০ দল বা সমমনা দলের রাজনৈতিক সভা সমাবেশে অংশ নিচ্ছেন। এমনকি বিএনপি ঘরানার বিভিন্ন সংগঠনের কর্মসূচিতেও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। রাজনীতিবিদদের সম্মানে আয়োজিত বিএনপির ইফতার মাহফিলে ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতারা অংশ নেন। যদিও ওই অনুষ্ঠানে সাবেক প্রেসিডেন্ট একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর তার বক্তব্যে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি গড়ার প্রসঙ্গ এনে অনেকটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন।
পরে অবশ্য তিনি তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এদিকে সর্বশেষ রোববার নাগরিক ঐক্যের ইফতার মাহফিলে ঐক্য প্রক্রিয়ার শীর্ষ নেতারা অংশ নেন। এতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস উপস্থিত ছিলেন। ওই ইফতার পার্টিতে দেয়া বক্তব্যে নেতারা প্রায় সবাই জাতীয় ঐক্যের আহবান জানান। নেতারা বলছেন, সরকারের বাইরে থাকা প্রায় সব দলের মধ্যে বৃহৎ ঐক্যের বিষয়ে চিন্তা করছেন তারা। আর এটি নির্বাচনের আগেই হবে। তবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতকে কোনভাবেই এই রাজনৈতিক ঐক্যে স্থান দেয়া হবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডির সভাপতি আসম আবদুর রব বলেন, ঘুষ, দুর্নীতি ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে আমরা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের জোট শরিক এবং জামায়াত ছাড়া অন্য সব দলের মধ্যে এই ঐক্য গড়ার প্রক্রিয়া চলছে। আশা করি নির্বাচনের আগেই তেমন একটি বৃহৎ ঐক্য গড়ে উঠবে। এবং এই ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এদেশে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন আদায় করা হবে। তিনি বলেন, আগামী মাসের শুরুতে জেএসডি একটি গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করবে। এই অনুষ্ঠান থেকে আমরা সমমনা দল ও পেশাজীবীদের কাছে ঐক্যের একটি প্রস্তাবনা তুলে ধরব।
গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আসছে ঈদের পরে জাতীয়ভাবে মহাসমাবেশ করে জাতীয় ঐক্যের ঘোষণা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে এবং কাজ চলছে। জাতীয় ঐক্যে কোন কোন দল থাকবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখন ক্ষমতাসীন দল ছাড়া বাকি সবাই জাতীয় ঐক্য চাইছে। আশা করি ক্ষমতাসীনদের বাইরে অন্য সবাই ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবে। বিরোধী রাজনৈতিক জোট বা বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নির্বাচনী জোট হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এমন সম্ভাবনা আছে। একটি প্রক্রিয়া চলছে। যথা সময়ে সবকিছু জানা যাবে। এদিকে রাজনৈতিক জোট গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একটি সূত্র বলছে, একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে থাকা জাতীয় পার্টির অবস্থানও তারা পর্যবেক্ষণ করছেন। দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের বিরোধী ছিলেন। যদিও পরে পরিস্থিতিতে পড়ে তিনি অবস্থান বদলান। এখন যদি তার দল জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে চায় তাও বিবেচনা করা হবে। নেতারা বলছেন, এরশাদ বরাবরই সুবিধা বুঝে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। সামনে পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তিনি হয়তো নিজেই জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে চাইবেন।
সূত্র বলছে, তৃতীয় রাজনৈতিক জোট গঠনের চেষ্টায় থাকা দলগুলো আগামী নির্বাচনের আগেই তাদের জোটসঙ্গী চূড়ান্ত করতে চায়। পৃথক জোট গঠন এবং বিরোধী জোটের সঙ্গে মিশে বৃহৎ রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা এই দুই বিকল্প নিয়ে নেতারা কাজ করছেন। সূত্র বলছে, বৃহৎ জোট গঠনের দিকেই নেতারা বেশি আগ্রহী। এলক্ষ্য সামনে রেখেই গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বার বার জাতীয় ঐক্যের আহ্বান করে আসছেন। নানা কারণে রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়া জাতীয় নেতাদেরও ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা হবে। এছাড়া দেশের খ্যাতিমান পেশাজীবী ও বিশিষ্ট নাগরিকরাও থাকবেন এ প্রক্রিয়ায়। এ ছাড়া বাম ধারার কয়েকটি দলও যুক্ত হতে পারে ঐক্য প্রক্রিয়ায়। এসব ছোট দলের নেতাদের দাবি আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা না হলেও বিরোধী জোটের নেতাদের সঙ্গে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে।
এর আগে গত বছরের আগস্টে একটি বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটানোর জন্য জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং সংবিধান প্রণেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। গণমাধ্যমে দেয়া এক যৌথ ঘোষণায় তারা এ ঐক্যের ডাক দেন। যৌথ ঘোষণায় তারা আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ এবং অবাধ, সুুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী আইন ও নির্বাচন ব্যবস্থার দাবিতে এবং দারিদ্র্যমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত এবং সন্ত্রাসমুক্ত একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি ছাত্রসমাজ, শিক্ষিত ও সুধীজন, আইনজ্ঞ, চিকিৎসক, শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারবর্গ, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, কৃষক, সাবেক সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের সমন্বয়ে বৃহত্তম একটি রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটাতে হবে।
তাদের এ ঐক্যের আহ্বানের পর যদিও জোট গঠন প্রক্রিয়ার কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। তবে সম্প্রতি তারা তৎপরতা জোরদার করেছেন। সমমনা দলগুলার ইফতার মাহফিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে তারা অংশ নিচ্ছেন। আলাপ আলোচনা করছেন। অভিন্ন কণ্ঠে বক্তব্য দিচ্ছেন। সামনে নির্বাচনী জোট গঠন বা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় এটি বড় অগ্রগতি বলে মনে করছেন নেতারা।