এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই তুরস্কে ঘটে যায় অবিস্মণীয় এক ঘটনা। সেনা অভ্যুত্থান ঠেকিয়ে দেয় সাধারণ জনগণ। রক্ষা পায় গণতন্ত্র। আরেকটি মিসর হওয়া থেকে বেঁচে যায় তুরস্ক। সে দিনের সেই অভিজ্ঞতা ডেইলি সাবাহর কাছে বর্ণনা করেছেন সে সময় আঙ্কারায় থাকা বেশ কয়েকজন রাষ্ট্রদূত। এরদোগানের এক ডাকে রাস্তায় নেমে আসা জনগণের সাহসের ভূয়সী প্রশংসাও করেন তারা।
২০১৬ সালের ১৫ জুলাই রাতে ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী একটি ক্যু-প্রচেষ্টার সাক্ষী হয় তুরস্ক। গণতন্ত্র রক্ষায় সে দিন প্রাণ হারিয়েছিলেন ২৪৯ জন সাধারণ নাগরিক। মধ্যরাতের দিকে বিভিন্ন মিডিয়ায় এ অভ্যুত্থানের খবর আসতে থাকে। অভ্যুত্থানকারীরা দেশের প্রধান প্রধান গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেয়। রাত সাড়ে ১১টায় দেশের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম অভ্যুত্থানের বিষয়ে দেশবাসীকে সতর্ক করেন। এরপর পরই এক পুলিশ সদর দফতরে হামলা চালিয়ে ৪২ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়। ১৬ জুলাই শুরু হতেই ১২টা ১৩ মিনিটে আনুষ্ঠানিকভাবে অভ্যুত্থানের ঘোষণা দেয়া হয়। জনগণ এ সময় পর্যন্ত কিছুটা বিভ্রান্ত ছিল। এর কিছুক্ষণ পরই প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান ফেসটাইমের মাধ্যমে একটি লাইভ নিউজে রাস্তায় নেমে এসে গণতন্ত্র রক্ষায় জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। এতে জনগণের বিভ্রান্তি কেটে যায় এবং লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। এরদোগান ওই ঘোষণা দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই অভ্যুত্থানকারীদের একটি অংশ তার অবস্থানস্থলে হামলা চালায়। কিন্তু কয়েক মিনিট আগেই তিনি হোটেল ত্যাগ করায় নিরাপদ থাকেন এরদোগান। ১২টা ৫৫ মিনিটে সেনাবাহিনী জানায়, এতে সেনাবাহিনীর সমর্থন নেই।
এর কিছুক্ষণ পর পার্লামেন্টে দলমত নির্বিশেষে সবাই অভ্যুত্থানের বিপক্ষে গণতন্ত্রের পক্ষে নিজেদের সমর্থন ব্যক্ত করেন। পরদিন সকালে অভ্যুত্থান চেষ্টা যখন এক রকম ব্যর্থই হয়ে যায়, তখন দেখা যায় ক্ষতিগ্রস্ত পার্লামেন্ট, রক্তে ভেসে যাওয়া রাজপথ, ধ্বংস হয়ে যায় পুলিশ সদর দফতর। কিন্তু তারপরও তুরস্কজুড়ে লোকজন উল্লাস প্রকাশ করতে থাকে। আরেকটি অভ্যুত্থান, আরেকটি ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া আনন্দে, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা রক্ষা করার আনন্দে। কারণ কোনো অস্ত্র ছাড়াই তারা ঠেকিয়ে দিয়েছে সেনা ট্যাংক, প্লেন থেকে বোমা হামলাও তাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। দুই বছর পেরিয়ে গেলেও আজো তুর্কিদের হৃদয়ে সে স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে আছে। সে স্মৃতি তরতাজা রয়েছে সে সময় আঙ্কারায় অবস্থান করা বেশ কয়েকজন রাষ্ট্রদূতেরও।
কলম্বিয়ার রাষ্ট্রদূত : তুরস্কে নিযুক্ত কলম্বিয়ান রাষ্ট্রদূত জুয়ান আলফ্রেডো পিন্টো সাভেদ্রা বলেন, নিঃসন্দেহে এটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে নাটকীয় ও কষ্টকর রাত। তিনি বলেন, রাতে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ইস্তাম্বুলের বসফরাস ব্রিজ বন্ধের খবর দেখাতে শুরু করে। কয়েকজন সৈন্য এটি অবরোধ করে রেখেছিল। এরপর আমি উপলব্ধি করতে পারলাম, এটা তো একটা অভ্যুত্থানের চেষ্টা। আমার স্ত্রী ও মেয়ে খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। অভ্যুত্থানের খবর শুনে তারা জানালার পাশে চলে যায় এবং সারা রাত তারা সেখানেই অবস্থান করে।
ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত : ড্যানিস রাষ্ট্রদূত সেন্ড ওলিং জানান, তিনি সে সময় কোপেনহেগেনে ছিলেন। তুরস্কের নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি সর্বশেষ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সে সময় তিনি যখন এ অভ্যুত্থানের খবর শুনলেন, তখন তিনি বসে পড়লেন এবং সারা রাত টিভি নিউজ দেখছিলেন এবং টুইটারে খবর নিচ্ছিলেন। ওলিং বলেন, এ অভ্যুত্থানের প্রকৃতি ভুলে যাওয়া আমাদের উচিত হবে না। সে অভ্যুত্থানে অনেক সাহসী মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন।
সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রদূত : তুর্কি জনগণ বিপুল সংখ্যায় ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারার রাস্তায় নেমে আসে। গণতন্ত্র এবং নির্বাচিত সরকারকে রক্ষা করতে তারা তাদের জীবন দিতে প্রস্তুত ছিল। অভ্যুত্থানের রাতে আঙ্কারায় থাকা সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রদূত এ. সেলেভেরেজাহ এভাবেই সে সময়ের কথা বর্ণনা করেন।
তিনি বলেন, সে সময় অভ্যুত্থান রুখতে বিক্ষোভকারীদের কয়েকজন সেনাবাহিনীর ট্যাংকের সামনে বুক পেতে দিয়ে দেন। তাদেরকে প্রাণ হারাতে হয়। কিন্তু এর ফলে তারা তুরস্কসহ পুরো বিশ্বকে দেখিয়ে দেয়, গণতন্ত্রের পক্ষে তাদের মজবুত সমর্থন রয়েছে। সেই সাথে তারা আরেকটি বার্তাও দেয় যে, তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থানের দিন শেষ। পার্লামেন্টে বোমা বর্ষণের মাধ্যমে তারা তুরস্কের জনগণের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার প্রতি চরম উপেক্ষো দেখিয়েছে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী খুবই দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফেরার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ঘটনার পরের দিনই দেশটির মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায়। লোকজন আবারো রাস্তায় নামে, ব্যবসাবাণিজ্য আবারো চালু হয় এবং আইনশৃঙ্খলাও বলবৎ হয়।
জর্জিয়ার রাষ্ট্রদূত : জর্জিয়ার রাষ্ট্রদূত ইরাকলি কোপলাতাজ বলেন, আমাদের দূতাবাসটি ছিল ঘটনার একটি একটি উপকেন্দ্রে। প্লেনগুলো আমাদের ওপর দিয়ে খুবই নিচু হয়ে উড়ে গিয়ে গোলবাসির পুলিশ ঘাঁটিতে হামলা চালাচ্ছিল। এ বোমাবর্ষণে আমাদের দূতাবাস ভবনগুলো কেঁপে উঠছিল।
অভ্যুত্থানাকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সাধারণ জনগণের প্রশংসা করে তিনি বলেন, তুর্কিরা পুরো বিশ্বের কাছে সাহস, দেশপ্রেম ও ঐক্যবদ্ধতার নজির সৃষ্টি করেছে। খুবই দুঃখজনক হলেও দিনটি একই সাথে ছিল তুর্কি বীরদের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। কারণ তারা সে দিন দেখিয়েছিল, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে কিভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে হয়।
লুক্সেবার্গের রাষ্ট্রদূত : আঙ্কারায় নিযুক্ত লুক্সেবার্গের রাষ্ট্রদূত জর্জেস ফাবের সে দিন তুরস্কের অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টাকারীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে রাস্তায় নেমে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষায় তুর্কি নাগরিকদের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, আমি যতটুকু জানি, তাতে অভ্যুত্থানকারীরা দেশের জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতীক পার্লামেন্টকে আঘাত করে এ ধরনের নজির বিশ্বে এটাই প্রথম।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত : বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আল্লামা সিদ্দিকী বলেন, এটি ছিল গণতন্ত্রের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ। কিন্তু তুর্কি জনসাধারণ তাদের এ ক্ষতিকর পরিকল্পনাটি নস্যাৎ করে দেয়। আবার অন্য দিকে পার্লামেন্টে হামলা সত্ত্বেও পার্লামেন্ট সদস্যরা তাদের স্থান ছেড়ে যাননি। সেই সাথে তারা নির্দেশনা দিয়েছেন কিভাবে গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হবে।
সূত্র : ডেইলি সাবাহ