এশিয়ানা বাংলা, ঢাকা : বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা স্বর্ণ নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরাও এ ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করেছেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে তার অফিসে ডেকে নিয়ে কথা বলেছেন। রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও এসব বিষয়ে কথা বলছেন। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে থাকা স্বর্ণের মান তৃতীয় কোনো পক্ষ দিয়ে যাচাই করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের তৈরি একটি গোপনীয় তদন্ত রিপোর্টের আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা স্বর্ণের মান নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ভল্টে রাখা তিন কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের চাকতি ও আংটি হয়ে গেছে মিশ্র বা সংকর ধাতু। ২২ ক্যারেটের স্বর্ণ এখন হয়ে গেছে ১৮ ক্যারেট। এর পর থেকে চাঞ্চল্যকর বিষয়টি নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। যা এখন টক অব দ্য কান্ট্রিতে রূপ নিয়েছে।
এদিকে মঙ্গলবার অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করে, শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের প্রতিবেদন সঠিক নয়। অপর দিকে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের প্রতিবেদন সঠিক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে যে স্বর্ণ রাখা হয়েছে সেগুলো ঠিক মতোই আছে। কোনো হেরফের হয়নি। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলেছেন, ঘটনা যাই হোক না কেন নিরপেক্ষভাবে স্বর্ণের মান যাচাই করে কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের এই পাল্টাপাল্টি অভিযোগ চলমান অবস্থায় তৃতীয় পক্ষ দিয়ে স্বর্ণের মান যাচাইয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক শুরু থেকে এ দাবি করে আসছিল। অবশেষে অর্থ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। বুধবার অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নানের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের বৈঠকের সময় তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে স্বর্ণের মান যাচাইয়ে একমত হন তারা। এ সময় সেখানে এনবিআরের চেয়ারম্যানও উপস্থিত ছিলেন। তবে এটি কার্যকর হবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দেশে ফিরলে। অচিরেই তৃতীয় কোনো পক্ষ দিয়ে স্বর্ণের মান যাচাই করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক আণবিক শক্তি কমিশনের মাধ্যমে ভল্টে রাখা স্বর্ণের মান যাচাই করার প্রস্তাব দিয়েছিল শুল্ক গোয়েন্দা তদন্ত অধিদফতরের কাছে। তারা এতে সম্মত হয়নি। ফলে আর সেটি হয়নি। আণবিক শক্তি কমিশনের কাছে বিভিন্ন ধাতুর মান নিরূপণের আধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. ফজলে কবিরকে তার কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে কথা বলেন। ধারণা করা হচ্ছে, যেহেতু স্বর্ণ নিয়ে এখন ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে, সে বিষয়টি নিয়েই তিনি কথা বলেছেন।
যেসব স্বর্ণ ভল্টে আসে : বাংলাদেশ ব্যাংকের সুরক্ষিত ভল্টে সব স্বর্ণ আসে না। বিশেষ করে শুল্ক বিভাগ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যেসব স্বর্ণ আটক করে সেগুলোর বিপরীতে যেসব মামলা হয় এবং ওই মামলায় যেসব স্বর্ণ জব্দ করা হয় কেবল ওইসব স্বর্ণই বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে অস্থায়ীভাবে রাখা হয়। এর বাইরে অন্য কোনো স্বর্ণ জমা রাখা হয় না।
শুল্ক বিভাগ বা অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যেসব স্বর্ণ আটক করে সেগুলো কোর্টের নির্দেশক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে যায়। প্রথমে এগুলো অস্থায়ীভাবে জমা রাখা হয়। যখন কোর্ট এসব স্বর্ণ সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করে তখন এসব স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকে স্থায়ীভাবে রাখা হয়।
ভল্টের নিরাপত্তা : ভল্ট এলাকাকে মহানিরাপত্তা এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এখানে যে ভল্টে স্বর্ণ থাকে সে ভল্টে ঢুকতে গেলে ছয় স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পার হতে হয়। এ ছাড়া গেট পার হতে কার্ড পাঞ্চ করে ভেতরে ঢুকতে হয়। কলাপসিবল গেট তো আছেই। বের হওয়া ও প্রবেশের সময় দেহ তল্লাশি করা হয়। যে ভল্টে স্বর্ণ থাকে তাকে বুলিয়ন ভল্ট বলে। ভল্টের প্রধান ফটক থেকে ভল্ট পর্যন্ত তিনটি দরজা আছে।
প্রতিটিতে আলাদা নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। এই ভল্টের ভেতরে আলাদা আলমারি আছে। সেগুলোর জন্য আছে আলাদা চাবি। এসব চাবি থাকে সিন্ধুকে। এর দায়িত্বে থাকেন দু’জন কর্মী। এর বাইরে সিসিটিভির ব্যবস্থা তো আছেই। ভল্ট বন্ধ হলে এখানে কেউ ঢুকতে পারেন না। শুধু কারেন্সি অফিসার, জয়েন্ট ম্যানেজার বুলিয়ন (স্বর্ণ), জয়েন্ট ম্যানেজার ক্যাশ ও ডিজিএম ক্যাশ ভেতরে ঢুকতে পারেন। এর বাইরে অন্য কেউ ঢুকতে হলে কারেন্সি অফিসারের অনুমতি নিতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে নিরাপত্তার দায়িত্বে ৭০ জন রিজার্ভ পুলিশ রয়েছে। যারা ব্যাংকের বাইরে কোথাও যায় না। তারা শুধু ব্যাংকের ভেতরেই দায়িত্ব পালন করে।
যেভাবে ভল্টে স্বর্ণ যায় : শুল্ক বিভাগ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা স্বর্ণ আটকের পর তার একটি তালিকা করে। পরে তারা এগুলো সংশ্লিষ্ট বিভাগের মেশিন দিয়ে পরীক্ষা করে এর মান লিপিবদ্ধ করে একটি নথি তৈরি করে। এর ভিত্তিতে মামলা করে। এরপর এগুলো থাকে কাস্টমসের গুদামে। পরে তা আদালতের নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা করা হয় অস্থায়ীভাবে। স্বর্ণ জমা করার সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের নিজস্ব স্বর্ণকার দিয়ে এগুলোর মান যাচাই করে প্রতিবেদন তৈরি করে। পরে এতে সবার স্বাক্ষর নিয়ে ভল্টে রাখা হয়।
ভল্টে ঢুকতে হলে : বাংলাদেশ ব্যাংকে ভল্টে কেউ ইচ্ছে করলেই একভাবে ঢুকতে পারবে না। মূল ভল্টে প্রবেশের জন্য তিনটি চাবির দরকার হয়। এগুলো থাকে তিনটি পক্ষের কাছে। এর একটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার, আরেকটি শুল্ক কর্তৃপক্ষের এবং অপরটি তালিকাভুক্ত স্বর্ণকারের জিম্মায় থাকে। এসব চাবি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টের পাশে একটি সিন্দুকে সংরক্ষিত থাকে। তিনটি চাবির জিম্মাদারের কাছে থাকে সিন্দুকের চাবি। ফলে তিনজনের উপস্থিতি ছাড়া ভল্টে প্রবেশ করার কোনো সুযোগ নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে স্বর্ণ গচ্ছিত রাখার বিষয়ে খাতাকলমে এত সব আটঘাট বাঁধা থাকার পরও কেন এর মান ও পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে তা খুবই উদ্বেগজনক। অভিযোগ সত্য হলে এটি হবে বড় ধরনের বিপর্যয়। সে ক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে রক্ষকরাই ভক্ষক। আর তাদের শেকড় খুব গভীরে। যা এখন জনস্বার্থে বের করে আনতে হবে। না হলে জনমনে সংশয় ও প্রশ্ন আরও বাড়তে থাকবে।