এশিয়ান বাংলা, সিলেট : সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের শেষ পর্যায়ে এসে প্রার্থীরা ভোটের হিসাব কষতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে বড় তিন দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের বিএনপির মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে চলছে নানা সমীকরণ। তিন দলই জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। তবে নির্বাচন নিয়ে ভোটাররা অনেকটাই নিশ্চুপ। যে কোনো মূল্যে আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু পরিবেশে করা হবে বলে রিটার্নিং অফিসারের দফতর থেকে বলা হয়েছে।
খুলনা ও গাজীপুরে নৌকার বড় জয়ে সিলেট সিটিতেও জয়লাভে আশাবাদী আওয়ামী লীগ। ১০ বছর ধরে সরকারের দেশব্যাপী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের জনবান্ধব রাজনীতির ইতিবাচক ইমেজ দলটিকে জয়লাভের ব্যাপারে প্রত্যয়ী করে তুলছে। তবে বিগত দিনের ভোটের হিসাব, আরিফুল হক চৌধুরীর মেয়াদে সিলেট শহরের উন্নয়ন এবং খালেদা জিয়ার কারাবাসের ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে বিএনপিও জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। যদিও ভোট সুষ্ঠু হবে কিনা, তা নিয়ে তারা বেশ শঙ্কিত।
বৃহস্পতিবার সিলেটে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে মতবিনিময় করেন নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম। এতে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও যোগ দেন। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোটানুষ্ঠান আয়োজনে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন।
পুলিশের ওপর ককটেল হামলা, জামায়াতের একাধিক সশস্ত্র মহড়া, কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ, বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে মামলা, ধর-পাকড়, বাসা-বাড়িতে হানা-তল্লাশির ঘটনায় ভোটারদের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। এ কারণে নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের আগ্রহ-উদ্দীপনা তুলনামূলকভাবে কম। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দিতে চান ভোটাররা। সিলেটের মানুষ রাজনৈতিক হানাহানি পছন্দ করেন না। রাজনৈতিক সম্প্রীতির শহর হিসেবেও সারা দেশে সিলেটের সুনাম আছে। সেটি যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে সে কথা সব দলই বলে আসছে। এ ব্যাপারে স্থানীয় সুশীলসমাজের পক্ষ থেকেও চাপ আছে। তবে কয়েক দিন ধরে শহরে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা এবং গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় সাধারণ মানুষের মধ্যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের ব্যাপারে উদ্বেগ-শঙ্কাও আছে। একজন আইনজীবী বলেন, কয়েকটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে বড় ধরনের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যে এখানকার নির্বাচন নিয়েও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা সাধারণ মানুষকে হতাশ করেছে। এসব অভিজ্ঞতায় ভোটাররা সুষ্ঠু-স্বাভাবিক নির্বাচনের বিষয়ে আস্থা রাখতে পারছে না। এখন ভোটারদের আস্থা ফিরিয়ে আনাই নির্বাচন কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরান বলেন, সিলেটের মানুষ শান্তিপ্রিয়। এখানকার মানুষের মনমেজাজ আলাদা। সেটা মাথায় রেখেই চলতে হবে। যেহেতু জনগণ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। তাই জনগণের ওপরই আমি আস্থাশীল।
বিএনপির মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, সিলেটের শান্তিপ্রিয় মানুষের চাপই নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠু ভোটানুষ্ঠানে বাধ্য করবে। যদিও অতি উৎসাহী কিছু পুলিশ কর্মকর্তা পরিবেশ নষ্টের চেষ্টা করছেন। কিন্তু সব বাধা উপেক্ষা করে জনগণ ভোট দেবে। রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আলীমুজ্জামান বলেন, ভোটারদের শঙ্কা দূর করতে আমরা নানা ব্যবস্থা নিয়েছি। আচরণবিধি লংঘনকারী কে তা না দেখে শোকজ করছি। কেন্দ্রে ও নগরীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যাপ্ত সদস্য থাকবে। সাড়ে ২৬ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৩৯ জন ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন। ভোটারদের আশ্বস্ত করতেই এত সব আয়োজন। তিনি জানান, সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে মেয়র প্রার্থীরা কোনো প্রতিবন্ধক নন। সংঘাতমুক্ত নির্বাচনের ক্ষেত্রে কাউন্সিলর প্রার্থীরা মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারেন। সে ব্যাপারেও আমরা ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছি।
আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আসাদ উদ্দিন বলেন, নতুন ভোটার ও নারী ভোটাররা নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে মূল প্রভাব রাখবে। এই দুই অংশের ভোট আসলে প্রার্থীর ব্যক্তিগত ইমেজে প্রভাবিত হবে। এটি মাথায় রেখে আমাদের প্রার্থী উভয় অংশের কাছে গেছেন। বাকি দিনগুলোতেও আমরা তাদের কাছে যাব।
বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ বলেন, শহরে জলাবদ্ধতায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহায় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও মায়েরা। গত মেয়াদে তিন বছর আমাদের প্রার্থী কারাগারে ছিলেন। মাত্র দুই বছরে তিনি জলাবদ্ধতা নিরসনসহ শহরের উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করেছেন। এছাড়া সুখে-দুঃখে তরুণ ভোটাররা আমাদের প্রার্থীকে কাছে পেয়েছে।
শহরের একটি কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থী উভয়ই ভালো। ভোটের মাত্র কয়েকদিন বাকি থাকলেও কে কাকে ভোট দেবেন এখনও বলার সময় হয়নি। তিনি আরও বলেন, ভোটে নানা ফ্যাক্টর থাকলেও প্রার্থীদের মূল নজর দলীয় ভোটব্যাংকের দিকে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও প্রতীকে ভোট গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। ব্যক্তিগত ভোটের সঙ্গে প্রতীকের ভোট গুরুত্বপূর্ণ। উভয় প্রার্থীই এই সুবিধা পেতে পারেন। গত নির্বাচনে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় আরিফুল হক উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোট পেয়েছিলেন। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় কার ভাগ্যে কী আছে সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে। গত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা সামনে রেখে সংখ্যালঘু ভোটের ওপর আওয়ামী লীগ বেশ জোর দিয়েছে। দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির একজন সদস্য জানান, বৃহস্পতিবার রাতে নগরীতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তাতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিৎ রায় নন্দী যোগ দেন। সুজিৎ রায় নন্দী যুগান্তরকে বলেন, ভোটে নানা ফ্যাক্টর কাজ করে। বিভিন্ন ভোটার গ্রুপের সঙ্গে বৈঠক করা নির্বাচনী কৌশলেরই অংশ। বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ বলেন, আমরা কাউকে সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরু হিসেবে দেখছি না। কারণ সবাই ভোটার। তবে ২০১৩ সালে নন-মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকাংশ ভোট আমরা পেয়েছি। এবারও তাদের ভোট আমরা পাব বলে আশাবাদী।
হেফাজতে ইসলাম এবং জামায়াতে ইসলামীর দিকে সবার নজর। ধর্মীয় প্রভাবের ভোট পকেটস্থ করতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দল নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। বৃহস্পতিবার নির্ভানা ইনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কার্যালয়ে সিলেটের ইমামদের নিয়ে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগের নেতারা। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক আহমদ হোসেন বলেন, এখানকার আলেম সমাজ নৌকা প্রতীকের পক্ষে আছেন।
এই শহরের মানুষের ওপর হেফাজতে ইসলামপন্থী আলেমদের প্রভাব আছে। সিটি নির্বাচনে হেফাজতের আলেমরা আরিফুল হক চৌধুরীর পক্ষে কাজ করলেও এবারের নির্বাচনে হেফাজতে ইসলাম কাউকে সমর্থন দেয়নি। বুধবার বিবৃতি দিয়ে সংগঠনটির আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী ও মহাসচিব আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী জানান, জাতীয় বা স্থানীয় কোনো নির্বাচনে কাউকে সমর্থন দেবে না হেফাজতে ইসলাম। এ কারণে ইমামদের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। বিএনপির জেলা সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ বলছেন, সিলেটের মানুষ ধর্মভীরু। বিগত দিনে মসজিদ-মাদ্রাসাসহ ধর্মীয় সব কাজে আমাদের প্রার্থী ছিলেন। আমাদের কোনো কূটকৌশলের প্রয়োজন নেই। কে কাজ করতে পারেন তা দেখে মানুষ ভোট দেবে।
এ ব্যাপারে ঘড়ি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী জামায়াতে ইসলামীর মহানগর আমীর এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, কাউকে সুবিধা দিতে বা বেকায়দায় ফেলতে জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন করছে না। দলীয় সিদ্ধান্তেই সিলেটে নির্বাচনে আছি, থাকব। এজন্য জাতীয় রাজনীতিতে কোনো প্রভাব পড়বে না। ‘আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থী’ হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়ানোর প্রশ্নে তিনি বলেন, জামায়াত গণতান্ত্রিক রাজনীতি করে। নির্বাচন গণতন্ত্র চর্চার অন্যতম একটি দিক। আমরা গাজীপুর-খুলনায় জোটগতভাবে নির্বাচন করেছি। বরিশাল-রাজশাহীতেও করছি। সিলেটের কৌশল আলাদা হয়েছে।