এশিয়ান বাংলা, ঢাকা: রাজনৈতিক পরিস্থিতি হঠাৎ নাটকীয় মোড় নিতে শুরু করেছে। আকস্মিক আলোচনায় সংলাপ প্রসঙ্গ। শাসক দলের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সংলাপের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মুখে সংলাপের আলোচনা ইতিবাচকভাবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তাদের মতে, শুরুতেই এক টেবিলে বসা না হলেও অন্য যে কোনো মাধ্যমে আলোচনা শুরু হোক। এ ধরনের আলোচনার পালে হাওয়া লাগলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই দু’দলের মধ্যে বরফ গলবে। এ কারণেই ফোনে কথা বলার বিষয়টিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন।
এ ফোনালাপ দু’দলকে এক টেবিলে বসতে সহায়তা করবে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিলেও বিএনপির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক ফোনালাপ হতে পারে বলে শুক্রবার মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তার এমন মন্তব্যকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছে বিএনপি। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দলটির মহাসচিবসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা ক্ষমতাসীন দলের এমন মনোভাবকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, আমরা যে কোনো সময় সংলাপে বসতে প্রস্তুত।
সংলাপ নিয়ে শুক্রবার দু’দলের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরে দু’দলকে আলোচনায় বসতে নানা মহল থেকে প্রস্তাব দেয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। এক টেবিলে না বসায় তাদের মধ্যে দূরত্ব বেড়েই চলেছে। আগামী একাদশ নির্বাচন সন্নিকটে। নির্বাচন নিয়ে দু’দলের মধ্যে এখনও সমঝোতা হয়নি। ভোট ইস্যুতে দু’দলই বিপরীতমুখী অবস্থানে। এ পরিস্থিতিতে সবার মধ্যেই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।
আগামীতে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হবে কিনা- এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মধ্যে। ভোটারদের এমন শঙ্কায় দু’দলের মধ্যে সংলাপের আলোচনা তাদের দূরত্ব কমিয়ে আনবে বলে প্রত্যাশা সবার।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বড় দু’দলের মধ্যে চলমান বিরোধ দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাদের বৈরিতার কারণে দেশ আজ সংকটে। এ সংকট থেকে উত্তরণে দু’দলের মধ্যে সংলাপের বিকল্প নেই। গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। না হলে দেশ আরও গভীর সংকটে পড়বে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, টেলিফোনে আলোচনা
করে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্যে আসা সম্ভব নয়। এজন্য এক টেবিলে বসতে হবে। তবে ফোনালাপের মধ্য দিয়ে দু’দলের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব অনেকটা কমে আসবে বলে আশা করি। যদি ফোনালাপও হয় সেটাও রাজনীতির জন্য ইতিবাচক, যা পরে এক টেবিলে বসতে সহায়তা করবে।
শুক্রবার রাজধানীর আগারগাঁও পরিসংখ্যান রোডে মেট্রোরেলের কার্যক্রম পরিদর্শনে গিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, রাজনীতিতে ওয়ার্কিং আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের (সম্পর্ক) জন্য বিএনপি নেতাদের সঙ্গে ফোনে কথা হতে পারে। তবে এ মুহূর্তে তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপের প্রয়োজন নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার বাকি আর মাত্র পৌনে ৩ মাস। এর মধ্যে আনুষ্ঠানিক সংলাপের কোনো প্রয়োজন আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
সব কিছুই কি আনুষ্ঠানিক হতে হবে? চোখে দেখাদেখি না হোক। টেলিফোনে তো অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তা হতে পারে। এতে নিজেদের দূরত্ব কমে যায়। টেলিফোনে কথা বললে সমস্যা কোথায়? এ প্রসঙ্গে তিনি কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী তাকে ফোন করার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, কাদের সিদ্দিকী তাকে ফোন করে বলেন, কথা বলতে চান। তাকে আমি বলেছি আসেন। অনানুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা হতে পারে। আর কিছু না হোক, চোখ দেখাদেখি না হোক টেলিফোনে তো সংলাপ করা যায়। বিএনপির নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন দেখা না হওয়ায় ‘মানসিক দূরত্ব’ তৈরি হওয়ার কথা তুলে ধরে শুধু আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ না থাকার ওপর জোর দেন ওবায়দুল কাদের।
তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে আমাদের অনেক গ্যাপ, মনের মধ্যে অনেক দূরত্ব হয়ে যায়, সবই কি আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমিত থাকবে? আমরা কি কথাবার্তা বলব না। টেলিফোনে কথা বলতে অসুবিধা কী? আমি বলেছি, বিএনপি মহাসচিব আমাকে কখনও ফোন করেননি। আমি বলিনি যে আমি সংলাপের জন্য আহ্বান জানিয়েছি। এর ভুল ব্যাখ্যা দেবেন না প্লিজ।’
কাদেরের এমন বক্তব্যকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছে বিএনপি। নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা বহুবার আলোচনার জন্য বলেছি এবং আহ্বান করেছি। আজকে আপনাদের মাধ্যমে আবারও আহ্বান করছি। আসেন আমরা কথা বলি। কোথায় বসবেন? কী করবেন বলেন। আমরা সব সময় প্রস্তুত আছি।’
আলোচনার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগকে ফোন করা হবে কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ফোন করলে আমরাও ফোন করব।
১৯ নভেম্বর সৈয়দপুর বিমানবন্দরে ওবায়দুল কাদের ও মির্জা ফখরুলের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর দু’জনে কুশলবিনিময় ও কিছুক্ষণ আলাপ করেন। তাদের এ দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপ নিয়ে তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা গুঞ্জন চলে। তাহলে কি দ্রুতই দু’দলের মধ্যে সংলাপ হচ্ছে- এমন কথাও শোনা যায়। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেটা বেশিদূর এগোয়নি। এরপর মির্জা ফখরুলের মায়ের ইন্তেকালে ওবায়দুল কাদের তাকে ফোন করে সান্ত্বনা দেন।
সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিরসনের জন্য আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেও এক ধরনের চাপ আছে। দলের নেতারা মনে করেন, ক্ষমতার শেষ সময়ে এসে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘাতময় হলে সরকারকেই দায়ভার নিতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে দলগতভাবে আওয়ামী লীগেরও ক্ষতি হবে। এ অবস্থায় সরকারও চায় সমঝোতা। সংলাপের বিষয়টিকে বিএনপিও ইতিবাচকভাবে দেখছে। দলের একাধিক নীতিনির্ধারক বলেছেন, তারা এখন সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবের অপেক্ষায় আছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানও কাদেরের বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা বহুবার বলেছি, জনগণের কিছু দাবি-দাওয়া আছে আমরা তা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। আওয়ামী লীগ যদি আলোচনা করতে আগ্রহী হয় তাহলে আমি মনে করি এটা একটা ভালো লক্ষণ। তবে যিনি এ কথা বলেছেন তিনি কতক্ষণ এ কথার ওপর স্থির থাকতে পারবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। তিনি বলেন, আমরা চাই খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিন। কারণ তাকে ছাড়া আলোচনা ও নির্বাচন- কোনোটাই অর্থবহ হবে না।