সংবাদমাধ্যমে সেদিন আলোকচিত্র শিল্পী শহিদুল আলমের একটি ছবি ছাপা হয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে কয়েকজন পুলিশ মিলে শহিদুল আলমকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে।
তার চেহারা বিপর্যস্ত এবং খালি পা। ছবিটি দেখে আমার বুকটা ধক করে উঠেছে, কারণ আমার মনে হয়েছে এ ছবিটি আমারও হতে পারত। শহিদুল আলম যেসব কাজ করেন আমরাও আমাদের মতো করে সেসব করতে চাই, তার মতো প্রতিভাবান বা দক্ষ নই বলে করতে পারি না।
কখনও আমাদের কোনো কাজ বা কোনো কথা আপত্তিকর মনে হবে না এবং একই ভঙ্গিতে আমাদের গায়ে হাত দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে নেয়া হবে না সেটি কে বলতে পারে?
কিছুদিন আগে আমি ছুরিকাহত হওয়ার পর আমার রক্তাক্ত অর্ধচেতন ছবি খবরের কাগজে ছাপা হয়েছিল, আমার সেই ছবি দেখে আমার আপনজন যতটুকু বিচলিত হয়েছিল, আমি নিশ্চিত তারা যদি দেখত একদল পুলিশ আমাকে আঘাত করে খালি পায়ে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে, তারা তার চেয়েও একশ’ গুণ বেশি বিচলিত হতো।
এ মুহূর্তে শুধু শহিদুল আলমের পরিবারের লোকজন নয়, আমরাও অনেক বিচলিত।
আলোকচিত্র শিল্পী শহিদুল আলমের অপরাধটি কী আমি সেটা বুঝতে পারিনি। তিনি আল জাজিরায় একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। আমি সেটা দেখিনি, তবে বিবিসির খবরে পড়েছি তিনি আন্দোলন দমনের ব্যাপারে সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করেছেন (আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে কখনও বিদেশি সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দিই না, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একজন সাংবাদিক আমি ছুরিকাহত হওয়ার পর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল।
এ মুহূর্তে ‘টাইম’-এর একজন সাংবাদিক আমাকে ই-মেইল পাঠিয়েছে। আমি বিনয়ের সঙ্গে তাদের বলি, বাংলাদেশ সম্পর্কে পশ্চিমা সাংবাদিকদের এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা আছে এবং আমি যেটাই বলি না কেন আমাদের দেশের নেতিবাচক রূপটা দেখানোর জন্য সেটা ব্যবহার করা হবে, তাই আমি তাদের থেকে দূরে থাকি)।
কিন্তু শহিদুল আলমের মতো একজন আন্তর্জাতিক মানুষ, একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ দেশের অবস্থাটি বিদেশি সাংবাদিককে বলতেই পারেন। সেটি যদি সরকারের সমালোচনা হয় সরকারকে সেটা মেনে নিতে হবে। কিছুতেই সেটাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না।
তার দ্বিতীয় অপরাধ হিসেবে ফেসবুক লাইভে তার বক্তব্যের কথা শুনতে পাচ্ছি। ফেসবুক লাইভ বিষয়টি কী আমি সেটা সঠিক জানি না। সেখানে তিনি কী বলেছেন সেটাও আমি জানি না, কিন্তু যেটাই বলে থাকেন সেটা তার বক্তব্য। এই বক্তব্য দিয়ে তিনি বিশাল ষড়যন্ত্র করে ফেলেছেন, সেটি তো বিশ্বাসযোগ্য নয়। আপত্তিকর কিছু বলে থাকলে, কেন সেটি বলেছেন সেটি নিয়ে গবেষণা হতে পারে, আলোচনা হতে পারে, তার চেয়ে বেশি কিছু তো হওয়ার কথা নয়। আমি শুনেছি তার থেকেও অনেক বেশি আপত্তিকর বক্তব্য দেয়ার পরেও অভিনয় শিল্পীদের অনেকে পার পেয়ে গেছেন, তাহলে খ্যাতিমান সর্বজনশ্রদ্ধেয় এই আলোকচিত্র শিল্পীর ওপর এই আক্রমণ কেন? যদি সত্যিই তিনি ষড়যন্ত্র করে থাকেন, আমরা সেটি জানতে চাই।
একজন মানুষ তার সারা জীবনের কাজ দিয়ে একটা পর্যায়ে পৌঁছান। আমরা তখন তাকে একটা শ্রদ্ধার আসনে বসাই। তাকে সম্মান দেখিয়ে আমরা নিজেরা সম্মানিত হই। তখন যদি তাকে অসম্মানিত হতে দেখি, আমরা অসম্ভব বিচলিত হই। শহিদুল আলম যেটাই বলে থাকুন সরকারের সেই কথাটি শোনা উচিত ছিল, কোনোভাবেই সেটাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত হয়নি। আমরা কি সংবাদমাধ্যমে সাংবাদিকদের গায়ে হাত তুলতে দেখিনি? তাদের ক্যামেরা ছিনিয়ে নিতে দেখিনি? সেগুলো কি অপরাধ নয়? কোনো কোনো অপরাধ থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্য কিছুকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হলে এ দেশের মূল ভিত্তিটা ধরেই কি আমরা টান দিই না?
স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা মিলে অসম্ভব সুন্দর একটা আন্দোলন শুরু করেছিল। কেউ মানুক আর নাই মানুক, পৃথিবীর ইতিহাসে এটা একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে। আমরা সারা জীবন চেষ্টা করে রাস্তাঘাটে মানুষের জীবনের নিরাপত্তার যে বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারিনি, তারা সেগুলো আমাদের উপহার দিয়েছে। কিন্তু এ আন্দোলনের শুরু থেকে আমার ভেতরে একটা দুর্ভাবনা কাজ করেছিল। সহজ-সরল কম বয়সী ছেলেমেয়েরা যে বিশাল একটা আন্দোলন গড়ে তুলেছে, তারা কি সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে? আমরা সবাই জানি সেই সহজ-সরল আন্দোলনটি শুধু যে জটিল হয়ে উঠেছিল তা নয়, সেটি ভয়ংকর রূপ নিতে শুরু করেছিল। ঝিগাতলার সেই সংঘর্ষে কারা অংশ নিয়েছিল? স্কুলের বাচ্চা ছেলেমেয়েরা নিশ্চয়ই ঘণ্টার পর ঘণ্টা মারামারি করেনি। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের আন্দোলনে কেন বড় মানুষরা মারামারি করতে এসেছে? তারা কারা? একপক্ষ ছাত্রলীগ, সরকার সমর্থক কিংবা পুলিশ হতে পারে, অন্যপক্ষ কারা? আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শীকে জিজ্ঞেস করেছি তারাও উত্তর দিতে পারেনি।
আমি অস্বীকার করছি না যে, আজকাল মিথ্যা সংবাদ এবং গুজবের কোনো শেষ নেই। কয়েকদিন আগে আমার মৃত্যু-সংবাদ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হয়েছে। কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা যখন নিজেদের ‘আমি রাজাকার’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল তখন আমি আমার প্রবল বিতৃষ্ণা প্রকাশ করেছিলাম। প্রফেসর আনিসুজ্জামানের সাম্প্রতিক একটা লেখা থেকে জানতে পারলাম তার মর্মাহত হওয়ার মতো এ খবরটি তিনি আমার লেখা থেকে জানতে পেরেছিলেন। তাকে কেন এ তথ্যটি আমার লেখা থেকে জানতে হল? দেশের এত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রের কোনোটি কেন এ তথ্যটি প্রকাশ করল না? তাদের কারও কি মুক্তিযুদ্ধের জন্য দায়বদ্ধতা নেই? রাজাকারের জন্য ঘৃণা নেই? যাই হোক, রাজাকারের জন্য আমার ঘৃণা প্রকাশ করার পর কোটাবিরোধী প্রজন্মের প্রায় সবাই আমার মৃত্যু কামনা করেছে। তাই আমার মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা হয়তো স্বাভাবিক ব্যাপার; কিন্তু অসংখ্য মিথ্যা সংবাদ এবং গুজব প্রচার করা কিন্তু তত স্বাভাবিক নয়। সরকার যেভাবে তথ্যগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে এবং আন্দোলন দমন করার জন্য যে পদক্ষেপ নিচ্ছে সেগুলো কিন্তু অনেকের ভেতরেই এক ধরনের ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে। সরকার কি এটি জানে? প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ক্ষমা করে দিলে কী এমন ক্ষতি হতো? ছাত্রলীগের ছেলেরা কি অনেক ক্ষেত্রে তাদের থেকেও বড় অপরাধ করেনি?
যাই হোক, আগস্ট মাস বাংলাদেশের জন্য একটি অশুভ মাস। কেউ বিশ্বাস করবে কিনা জানি না এ মাসটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি এক ধরনের অশান্তিতে থাকি।
এ বছর আমার অশান্তিটি বেশি। আমি যখনই চিন্তা করছি আলোকচিত্র শিল্পী শহিদুল আলমকে শুধু গ্রেফতার করা হয়নি, তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে, আমি বিষয়টি ভুলতে পারছি না। শেষবার সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমাদের অনেক শিক্ষককে ধরে রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল। মনে আছে, আমরা তখন আমাদের সহকর্মীদের জন্য পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করছি। কিন্তু কেউ সেই লেখা ছাপানোর সাহস পাচ্ছে না। আমরা শিক্ষকরা তখন খুব অসহায় বোধ করছিলাম। এখন অনেকদিন পর আবার কেমন যেন অসহায় বোধ করছি। নিজ দেশে কেন আমরা অসহায় অনুভব করব? কী হচ্ছে আমরা কি জানতে চাইতে পারি?
মুহম্মদ জাফর ইকবাল : লেখক; অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়