এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরের সম্ভাব্য নাশকতা প্রতিরোধ ও ভোটের পরিবেশ সুষ্ঠু রাখতে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তার জন্য মাঠে নামছে ক্ষমতাসীনদের লক্ষাধিক কমিটি।
আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগসহ দলটির সবগুলো সহযোগী ও অঙ্গসংগঠন আলাদাভাবে দেশের প্রায় ৪৩ হাজার ভোট কেন্দ্রের প্রতিটিতে একটি করে কমিটি গঠনের কাজ শুরু করেছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৪২ হাজার কমিটি গঠন চূড়ান্ত করেছে আওয়ামী লীগ। বাকি সংগঠনগুলোর কমিটি গঠনের কাজ চলতি মাসেই শেষ হবে।
আর সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে সারা দেশে শুরু হবে কমিটিগুলোর কার্যক্রম। দলটির ধানমণ্ডির ৩/এ-এর নির্বাচন পরিচালনা (নতুন বিল্ডিং) কার্যালয় থেকে এসব কমিটির সার্বিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে দলটির নির্বাচন পরিচালনা কমিটি।
আওয়ামী লীগের একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য। তারা আরও জানান, ভোট কেন্দ্রভিত্তিক যেসব কমিটি গঠন করা হচ্ছে, সেগুলো একান্তই আওয়ামী লীগের নিজস্ব কমিটি।
ভোট কেন্দ্রে অবস্থান করা, পোলিং এজেন্টদের পরিচালনা করা ও কেন্দ্রের বাইরের পরিবেশ সুষ্ঠু রাখার জন্য মূলত এসব কমিটি গঠন করা হচ্ছে। নির্বাচনের আগে ভোটের পরিবেশ স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়ার কাজটিও করবে কমিটির সদস্যরা।
তারা পাড়া-মহল্লায় ভোটারদের সাহস ও সতর্ক করার পাশাপাশি এলাকায় যাতে কেউ কোনো ধরনের গুজব ছড়াতে না পারে, সেদিকেও তীক্ষ্ণ নজর রাখবেন।
নীতিনির্ধারকরা আরও জানান, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াও এখনও কেউ ভোলেনি। এই তিক্ত ও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা এড়াতে এবার দলের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
ভোট কেন্দ্রভিত্তিক যেসব কমিটি গঠন করা হচ্ছে, সেগুলো নাশকতা প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করবে। পাড়া-মহল্লায় টহল দেবে। অপরিচিত, সন্দেহভাজন লোকজন চিহ্নিত করে প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করবে। এছাড়া তারা পাড়া-মহল্লায় উঠোন বৈঠক করে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন প্রচার ও নৌকার পক্ষে ভোট প্রার্থনা করবে। পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াতের বিগত জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের যাবতীয় তথ্য ভোটারদের মধ্যে তুলে ধরবেন।
প্রসঙ্গত, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে আন্দোলনের মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। দলটির হাইকমান্ডের এমন কঠোর মনোভাব নেতাকর্মীদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
বিএনপির এমন কঠোর আন্দোলনের হুমকিতে মোটেও বিচলিত নয় আওয়ামী লীগ- এমন মন্তব্য করেছেন দলটির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান।
তিনি শনিবার বলেন, বিএনপি-জামায়াত গণতান্ত্রিক দল নয়। এরা বারবার সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ বানচাল ও প্রতিহতের চেষ্টা করে এবং ব্যর্থ হয়। আবার আন্দোলন-সংগ্রামের নামে নির্বাচন প্রতিহতের চেষ্টা করলে নির্বাচন কমিশন ও সরকার তাদের প্রতিহত করবে। দল হিসেবে আমরা সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ বজায় রাখতে প্রস্তুত থাকব, সাধারণ মানুষকে সজাগ করব।
শিগগিরই তৃণমূল পর্যন্ত ভোট কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠনের কাজ সম্পন্ন হবে।
এছাড়া আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল মতিন খসরু শনিবার বলেন, সারা দেশে প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের পৃথক কমিটি থাকবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের এই কমিটি গঠন চূড়ান্ত পর্যায়ে।
অনানুষ্ঠানিকভাবে ৩ জুন কমিটির তালিকা হস্তান্তর কার্যক্রম উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ওইদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক ভোট কেন্দ্রভিত্তিক নাশকতা প্রতিরোধ কমিটির একটি তালিকা হস্তান্তর করেন।
এছাড়া যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট একটি তালিকা জমা দেন। সেখানে ঢাকা দক্ষিণ মহানগরের ১৩টি সংসদীয় আসনের ১০০টি ভোট কেন্দ্রভিত্তিক কমিটির তালিকা হস্তান্তর করেন।
এছাড়া যুবলীগ উত্তরের সভাপতি মাইনুল হোসেন খান নিখিলও একটি তালিকা জমা দেন। আর গাজীপুর মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক মো. কামরুল আহসান সরকার রাসেল ৫৭টি ওয়ার্ডের ৪২৫টি ভোট কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি তালিকা ওবায়দুল কাদেরের কাছে হস্তান্তর করেন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকা কুষ্টিয়া-৩ আসনের প্রতিটি ভোট কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। সারা দেশে এ কমিটি গঠন প্রায় শেষের দিকে।
কমিটিগুলো সরকারের উন্নয়ন প্রচার, বিএনপি-জামায়াতের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন সম্পর্কে ভোটারদের অবহিতকরণ, ভোটারদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কাজ করবে।
যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ বলেন, ঢাকা মহানগরের প্রতিটি ভোট কেন্দ্র কমিটির কাজ শেষ হয়েছে। সারা দেশের কাজও শেষ পর্যায়ে।
ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন বলেন, আমাদের কাজ নির্বাচনের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ করতে সাধারণ মানুষ ও ভোটারদের কাছে যাওয়া। তাদের ভোট কেন্দ্রে যেতে উৎসাহ দেয়া। এ লক্ষ্যে সারা দেশে ছাত্রলীগের কর্মীদের দিয়ে ভোট কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠনের কাজ শুরু করেছি।
আন্দোলনে নামলে অস্তিত্বের সংকটে পড়বে বিএনপি-জামায়াত এমন দাবি করে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও গাজীপুর সিটির নবনির্বাচিত মেয়র অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গাজীপুর মহানগরের প্রতিটি মানুষের জানমাল রক্ষা করা আমার দায়িত্ব। এজন্য যে কোনো সহিংস আন্দোলন দমনে যা যা করণীয় সব করব।
তিনি বলেন, ইতিমধ্যে আমি শুধু গাজীপুর মহানগরেই ৪২৫টি কেন্দ্রভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেছি। প্রতিটি কমিটির সদস্য সংখ্যা শতাধিক। যদি গাজীপুরে বিএনপি-জামায়াত আন্দোলনের নামে মাঠে নেমে মানুষের জানমালের ক্ষতি করার চেষ্টা করে, তাহলে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ ও সিটি কর্পোরেশন মিলে প্রতিহত করবে।
আরও জানা গেছে, ২০১৫ সালে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামায়াতের অবরোধ, চোরাগোপ্তা হামলা ও জ্বালাও-পোড়াও ঠেকাতে গঠিত ১৪ দলীয় জোটের প্রতিরোধ কমিটিও সেপ্টেম্বর থেকে মাঠে থাকবে।
এ বিষয়ে জোটের অন্যতম শরিক জাসদের একাংশের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া শনিবার জানান, বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন সংগ্রাম নিয়ে আমরা ১৪ দল ভীত, সন্ত্রস্ত নই। চিন্তিতও নই। তবে আমরা সজাগ থাকব। তবে আমাদের সবকিছু ভোট কেন্দ্রভিত্তিক হবে। এসব কমিটিই তাদের সহিংসতার জবাব দেবে।
কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন করতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের স্বাক্ষরিত একটি চিঠি ৩ ফেব্রুয়ারি তৃণমূলে পাঠানো হয়। চিঠিতে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে জনমত গঠন, ভোট কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন, পোলিং এজেন্ট প্রশিক্ষণ, উঠোন বৈঠক ও সদস্য সংগ্রহ অভিযান অব্যাহত রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল।
তৃণমূল আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, চিঠি দেয়ার পর কেন্দ্র থেকে মৌখিকভাবে জানানো হয়, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামায়াত ফের নাশকতা করার চেষ্টা করলে সে ব্যাপারে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। ঈদুল আজহার পরপরই এসব কমিটি যেন সক্রিয় হয় সে নির্দেশও দেয়া হয় জেলাগুলোকে। কেন্দ্রের পাঠানো চিঠির নির্দেশনা মোতাবেক ইতিমধ্যে ভোট কেন্দ্রভিত্তিক নাশকতা কমিটি গঠন শুরু করে তৃণমূল নেতারা।
নাশকতা প্রতিরোধ কমিটি গঠন ও প্রশিক্ষণের কাজ শেষের দিকে জানিয়ে পঞ্চগড় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আনোয়ার সাদাত সম্রাট শনিবার বলেন, পঞ্চগড় জেলা, প্রতিটি উপজেলা, ইউনিয়ন এমনকি ওয়ার্ড পর্যন্ত আমরা ভোট কেন্দ্রভিত্তিক সহিংস প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেছি। এখন এসব কমিটিকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। আজও (শনিবার) সদর উপজেলার কামাত হাজল দীঘি ইউনিয়নে নাশকতা প্রতিরোধ কমিটির প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগামী নির্বাচনে যে কোনো সহিংস আন্দোলন প্রতিহতে আমরা প্রস্তুত বলেও জানান তিনি।
কেন্দ্রের নির্দেশে ভোট কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠনের কাজ শুরু করেছে কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ। জেলার সাধারণ সম্পাদক জাফর আলী বলেন, কুড়িগ্রাম জেলায় কখনই বিএনপি-জামায়াত মাথা চাড়া দিতে পারেনি। আগামীতেও পারবে না। নির্বাচনকে সামনে রেখে নাশকতা প্রতিরোধ কমিটি গঠনের কাজ এ মাসেই সম্পন্ন হবে বলেও জানান তিনি।