এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : চার দিন আগের ঘটনা। ডেডলাইন দিনাজপুর। রবিউল ইসলাম নামে এক সন্দেহভাজন খুনিকে পুড়িয়ে হত্যা করে বিক্ষুব্ধ জনতা। তারা তার বাড়িতেও আগুন দেয়। পালিয়ে অল্পের জন্য রক্ষা পায় রবিউলের পরিবারের সদস্যরা। আগুনে পুড়িয়ে মারাটা বিরল।
কিন্তু জনতার হাতে গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা কম নয়। প্রায়শই ঘটছে এই ধরনের ঘটনা। কিন্তু কেন? ‘পাবলিক কোর্টে’ কেন কার্যকর হচ্ছে এত মৃত্যুদণ্ড। আইনবিদ ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, মূলত বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার কারণেই অনেকে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) দেয়া তথ্যমতে, ২০১১ সাল থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৭১২ ব্যক্তি গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০১১ সালে ১৩৪ জন, ২০১২ সালে ১২৬ জন, ২০১৩ সালে ১২৮ জন, ২০১৪ সালে ১২৭ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। সামপ্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গণপিটুনিতে নিহতের ঘটনা ঘটেছে ২০১৫ সালে। ওই বছর নিহত হয়েছেন ১৩৫ জন। এ ছাড়া ২০১৬ সালে নিহত হয়েছে ৫১ জন এবং ২০১৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত একইভাবে নিহত হয়েছেন আরো ১১ জন। আসকের ভিন্ন একটি তথ্যে দেখা যায়, গত সাড়ে ৬ বছরে গণপিটুনিতে সবচেয়ে বেশি নিহতের ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। এই সময়ে ঢাকা বিভাগে ৩১৭ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চট্টগ্রাম বিভাগে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ১৭৪ জন। এ ছাড়া রাজশাহী বিভাগে ৭১ জন, খুলনা বিভাগে ৮৬ জন, বরিশাল বিভাগে ২৫ জন, সিলেট বিভাগে ১৯ জন এবং রংপুর বিভাগে ২০ জন গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা গেছেন।
মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আট বছরে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ১ হাজার ২৩ জন। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ১২৭ জন, ২০১০ সালে ১৭৪ জন, ২০১১ সালে ১৬১ জন, ২০১২ সালে ১৩২ জন, ২০১৩ সালে ১২৫ জন, ২০১৪ সালে ১১৬ জন, ২০১৫ সালে ১৩৫ জন এবং ২০১৬ সালে ৫৩ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, এটা অনেক বছর ধরেই হচ্ছে। কখনো বেশি কখনো কম। প্রথমত ও প্রধানত, বিচার ব্যবস্থায় বিচার হয় না বা পাবে না এই আশঙ্কা থেকে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। দ্বিতীয়ত, শাস্তি হিসেবে কাউকে নির্যাতন করা বা শারীরিকভাবে কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলাটাকে আমরা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে অতোবড় অন্যায় বা খারাপ কিছু মনে করি না। যদিও সংবিধানে একটা মানুষকে নির্যাতন বা গণপিটুনি দেয়াকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু সংবিধানের নিষেধাজ্ঞা আমরা এখন পর্যন্ত আত্মস্থ করিনি। এসব কারণে গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। এখানে পক্ষে বিপক্ষে সব যুক্তি বা সাক্ষ্যপ্রমাণ বিবেচনা করে শাস্তি নির্ধারণ করার যে বিচার প্রক্রিয়া সেটা হচ্ছে না। অতএব এই বিচার না হওয়াতে অনেক সময় নির্দোষ ব্যক্তিও গণপিটুনির শিকার হয়ে থাকে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, কোনো মানুষেরই নিজের হাতে আইনকে তুলে নেয়ার অধিকার নেই। আইন তার নিজস্ব গতীতে চলবে। আমাদের রাষ্ট্র, সংবিধান ও আইন কানুনে স্পষ্ট করে বলা আছে কোন ধরনের ঘটনায় কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়া যায়। এবং কে কিভাবে ব্যবস্থা নিতে পারে। প্রত্যেকটা স্তরে আইনি প্রক্রিয়াটা অনুসরণ করতে হবে। একজন মানুষকে গণপিটুনি দেয়ার অধিকারতো কারোরই নেই। সে যত বড় অপরাধীই হোক না কেন। যারা পিটাচ্ছে তারা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করেছে।
কারণ কোনো মানুষকে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে বিচার করে মারার অধিকার আইন বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা কাউকে দেয় নি। প্রত্যেকটা মানুষেরই জীবনের অধিকার ও নির্যাতন থেকে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। অতএব এতে প্রমাণিত হয় এগুলো পরিষ্কারভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে এবং যারা এখানে নীরব ভূমিকা পালন করেছে তারাও এই মানবাধিকার লঙ্ঘনকে সমর্থন করেছে। তাই এর সাথে জড়িত লোকদের আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, গণপিটুনির নামে নিজের হাতে আইন তুলে নেয়া নিঃসন্দেহে খুবই ভয়াবহ একটি বিষয়। এবং যারা এই ধরনের কাজ করছে তাদের প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আনা ও বিচার হওয়া উচিত। কারণ তারা কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এক্ষেত্রে দেখা যায় সাধারণত অনেকেই অতিষ্ঠ হচ্ছেন যে বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সঠিক বিচার পাওয়া যায় না। এবং অনেক দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচার পাওয়াটা খুব কষ্টসাধ্য। এ কারণে হয়তো মানুষের মধ্যে এক ধরনের হতশার সৃষ্টি হয়।
কিন্তু সেটা কোনো অজুহাত নয় যে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে হবে। যেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মানুষ যতই অতিষ্ঠ বা ফ্রাস্টেট হোক না কেন কোনো অবস্থাতেই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার অধিকার কারোর নেই। সুনির্দিষ্ট আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলা আমাদের সকলেরই দায়িত্ব। এক্ষেত্রে সঠিক বিচার ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ভেতরে হতাশা অনেকটা কমিয়ে আনতে পারে। এবং এতে করে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হবে।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, বিশ্বের আর কোথাও গণপিটুনির মতো কাজটা করা হয় না। কারণ তারা জানে এটার বিচার হবে। যার যেমন শাস্তি পাওয়ার কথা সে তেমন শাস্তি পাবে। কিন্তু আমাদের দেশে এক্ষেত্রে একেবারে উল্টা বা বিপরীত চিত্র। কারণ আমাদের দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচারের অনিশ্চয়তা দেখা যায়। আর এই অনিশ্চয়তা থেকেই মানুষ ভেবে নেয় দোষীরা বিচারের কাঠগড়ায় গেলেও আবার বেরিয়ে এসে বরং একইভাবে ক্রাইম করবে। এজন্য নিজেরাই বিচার কার্যক্রম শুরু করে দেয়। এটা হচ্ছে মূল কারণ। অর্থাৎ বিচারের অনিশ্চয়তার কারণেই এই ঘটনাগুলি বেশি ঘটে থাকে।