এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : চিকিৎসকদের চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে চলে গেলেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি। ভারতীয় সময় বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টা ৫ মিনিটে নয়াদিল্লির এইমস হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। বিজেপির প্রথম প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ির মৃত্যুতে সাত দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে ভারত সরকার। আজ দিল্লির রাজঘাটে তার শেষকৃত্য হবে। দিল্লির বাড়িতে তার মরদেহ রাখা হয়েছে সবার শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। যমুনাতীরে তার স্মৃতিতে স্মৃতিসৌধ হবে বলে কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাজপেয়ি ছিলেন কট্টর সমর্থক এবং ভারতীয় সংসদে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সংগ্রাম-লড়াইয়ের সপক্ষে সওয়াল করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীকে দুর্গা বলে তিনি সম্বোধন করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে সমর্থনের জন্য। বাজপেয়ির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি কোবিন্দ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। শোক জানিয়েছেন সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী থেকে শুরু করে মমতা ব্যানার্জি, ফারুখ আবদুল্লা, গোলাম নবি আজাদ।
১১ জুন অসুস্থ হয়ে অটর বিহারি বাজপেয়ি এইমসে ভর্তি হন। কিন্তু বুধবার রাত থেকে তার শরীরের অবনতি হয়। একে একে বিকল হতে থাকে তার দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। দুটো ফুসফুস সংক্রমিত হয় নিউমোনিয়ায়। সংক্রমণ ছড়ায় গোটা শরীরে। এদিন বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ প্রকাশিত মেডিকেল বুলেটিনে এইমস জানায়, বাজপেয়ির অবস্থা আরও সংকটজনক। তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। খবর পেয়ে এইমসে হাজির হন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডু, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, কেন্দ্রীয় বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ, বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও বিকালেই পৌঁছে যান দিল্লিতে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশকুমার, আসামের মুখ্যমন্ত্রী সোনওয়াল থেকে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও হাসপাতালে যান। জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা বাঙালি জননেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সচিব হিসেবে বাংলার সঙ্গে তার যে যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল আমৃত্যু তা অটুট ছিল প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির। বাঙালির খাবার, পোশাকই শুধু পছন্দ করতেন না, বাড়িতেও বাঙালিয়ানার মোড়ক ছিল ১০০ শতাংশ। বাঙালি রঞ্জন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন পালিত কন্যা নমিতার। কলকাতা থেকে কেউ দিল্লির বাড়িতে দেখা করতে এলে খবর নিতেন বাংলার দই ও আম এনেছেন কিনা। কলকাতায় এলে তিনি উঠতেন সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের বারিয়াল হাউসে। তার মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে আসে ওই বাড়ির সদস্যদের মধ্যে।
১৯৬৮ সালে জনসংঘের সর্বভারতীয় সভাপতি নির্বাচিত হন বাজপেয়ি। ১৯৭৭ সালে নির্বাচনে জিতে জনতা পার্টি ক্ষমতায় এলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের মন্ত্রিসভায় বিদেশমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বাজপেয়ি। ১৯৮০ সালে বাজপেয়ি বন্ধু ও সহকর্মী আদভানির সঙ্গে ভারতীয় জনসংঘ থেকে তৈরি করেন ভারতীয় জনতা পার্টি। তিনিই বিজেপির প্রথম সর্বভারতীয় সভাপতি ছিলেন। ভারতের দশম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটল বিহারি বাজপেয়ি। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। প্রথমবার তিনি মাত্র ১৩ দিন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বাজপেয়ি। ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা হিসেবে এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বাইরে থেকে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি পূর্ণ মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। তাকে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান ‘ভারতরত্ন’-এ ভূষিত করা হয়।
১৯২৪ সালে গোয়ালিয়রে জন্ম বাজপেয়ির। বাবার নাম কৃষ্ণ বিহারি বাজপেয়ি। মা কৃষ্ণ দেবী। স্নাতকোত্তর পর্যন্ত গোয়ালিয়রেই পড়াশোনা করেন তিনি। স্নাতকোত্তর পড়তে তিনি উত্তরপ্রদেশের কানপুরে আসেন। রাজনীতিতে বাজপেয়ির পদার্পণ ১৯৪০ সালে। সেই সময় আরএসএসের সংস্পর্শে আসেন বাজপেয়ি। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৯৪২ সালে তিনি ও তার দাদা প্রেম জেলে যান। বন্দি ছিলেন ২৩ দিনের জন্য। তারপরেই নজরে আসেন বাজপেয়ি। ১৯৪৪ সালে আর্যসমাজের গোয়ালিয়র যুবশাখা আর্য কুমার সভার সাধারণ সচিব নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৫১ সালে তিনি আরএসএসের নবগঠিত রাজনৈতিক দল ভারতীয় জন সঙ্ঘের জাতীয় স্তরের সচিব নির্বাচিত হন। পার্টির নেতা শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ ও কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন তিনি।
দীনদয়াল উপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর তার কাঁধেই এসে পড়ে পার্টির দায়িত্ব। এর বছর কয়েক পরেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঘোষিত দেশের জরুরি অবস্থা চলাকালীন গ্রেফতার হন বাজপেয়িসহ অন্য নেতারা। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত বন্দি ছিলেন তারা।
প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার শোক : বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে তাকে বাংলাদেশের একজন মহান বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
আজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে পাঠানো এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, ‘অটল বিহারি বাজপেয়ি আমাদের একজন মহান বন্ধু এবং বাংলাদেশে তিনি খুবই শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।’ সুশাসন এবং ভারতসহ এতদঞ্চলের সাধারণ মানুষের শান্তি ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য অটল বিহারি বাজপেয়ি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে অমূল্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার অটল বিহারি বাজপেয়িকে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা প্রদান করে। আজ বাংলাদেশের সবার জন্যও এটি একটি শোকের দিন। ‘আমরা তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।’
আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের শোক : ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির মৃত্যুতে বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। বৃহস্পতিবার এক শোক বাণীতে তিনি বাজপেয়ির বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।