এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গরা বর্ণবাদ হটিয়ে মানবাধিকার ফিরে পেয়েছে প্রায় দুই যুগ আগে। কিন্তু জমি ও সম্পদের অধিকার ফিরে পায়নি। সাদা জোঁকে চুষে খাচ্ছে কালো মাটি। কালাদের দেশে সাদাদের দাপট এখনও লাগামছাড়া।
আজও দেশটিতে শ্বেতাঙ্গ জমিদারির রমরমা হালচাল। দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী মাত্র ৮ ভাগ শ্বেতাঙ্গদের দখলে দেশের মোট জমির ৭২ ভাগ। আর ৭৬ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক মাত্র ৪ ভাগ জমির মালিক। বর্ণবাদ বিশৃঙ্খলার সুযোগে অধিকাংশ এসব জমি দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গদের কাছ থেকে লুফে নিয়েছে সাদারা। ১৯৯৪ সালে বর্ণবাদ ঝেটিয়ে বিদায় করতে পারলেও রক্তচোষা গুটিকয়েক শ্বেতাঙ্গদের তাড়াতে পারিনি কৃষ্ণাঙ্গরা।
কালোদের হাতে এখন রাষ্ট্রের ঝাণ্ডা। সরকার কৃষ্ণাঙ্গদের জমি ফিরিয়ে দিতে নতুন বিল পাস করেছে। শ্বেতাঙ্গদের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণের জন্য সংবিধান পরিবর্তনের পথে হাঁটছে প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার সরকার।
এর ফলে কোনো ভর্তুকি ছাড়াই দেশটির ১৩৯ শ্বেতাঙ্গ জমিদারের জমি সরকারের দখলে চলে যেতে পারে। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি) সরকারের এ সিদ্ধান্তে প্রতিবেশী দেশে বিক্ষোভ করছেন শ্বেতাঙ্গরা। আর হোয়াইট হাউসে বসে তাদের উসকে দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
গত মার্চে জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত পার্লামেন্টে আনা একটি বিল বিপুল ভোটে পাস হয়েছে। প্রস্তাবটি ২৪১-৮৩ ভোটের ব্যবধানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এ বিলের মাধ্যমে কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়া ছাড়াই শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের জমি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়।
আর এর মাধ্যমে সংবিধানের ২৫নং ধারা পরিবর্তনের চিন্তা করছে রামাফোসা সরকার। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে দেশটির সংবিধান প্রণয়ন করেন। ২০১৬ সালে জমি বাজেয়াপ্তকরণ সংক্রান্ত একটি আইন পাস হয়।
এতে বলা হয়েছিল, কোনো কৃষকের ২৫ হাজার একরের বেশি জমি থাকলে সেই অতিরিক্ত জমি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে অধিগ্রহণ করবে সরকার। তবে তা বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। চলতি বছরের ফেব্র“য়ারিতে রামাফোসা ক্ষমতায় আসার পর শ্বেতাঙ্গ দাপটের বিরুদ্ধে জেগে ওঠে কৃষ্ণাঙ্গরা। সরকারও নড়েচড়ে বসে। আগের ওই আইনকে কেন্দ্র করে সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন রামাফোসা।
৫ কোটি ৬০ লাখ জনসংখ্যার দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। দেশটির প্রায় ৭৬ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকের চাবিকাঠি শ্বেতাঙ্গদের হাতে। দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষিজমির ৭২ শতাংশ এখনও শ্বেতাঙ্গদেরই দখলে। মাত্র ৪ শতাংশ জমি কৃষ্ণাঙ্গদের মালিকানায়।
ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ কালোদের সিংহভাগকেই চরম দারিদ্র্য, ভূমিহীনতা, বেকারত্ব, আশ্রয়হীন, খাদ্যহীন অবস্থায় দিনাতিপাত করতে হয়। দেশটিতে ধনবৈষম্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের খাদ্য ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। শ্বেতাঙ্গদের ‘নীরব দাপটে’ দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে কৃষ্ণাঙ্গদের। রাগে-ক্ষোভে-কষ্টে মাঝে মাঝে শ্বেতাঙ্গ জমিদারদের ওপর গুপ্ত হামলা চালায় তারা।
দক্ষিণ আফ্রিকার স্থানীয় মানবাধিকার গোষ্ঠী আফ্রিফোরামের প্রাথমিক তথ্যানুসারে, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের মধ্যে ৮২ জন শ্বেতাঙ্গ কৃষক দুর্বৃত্ত হামলায় নিহত হয়েছেন। এছাড়া সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গদের ওপর ৬৩৮টি গুপ্ত হামলার ঘটনা ঘটেছে। এএনসি সরকার ২০০৭ সাল থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যান প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এজন্য শ্বেতাঙ্গ হত্যার এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা আফ্রিফোরামের। শ্বেতাঙ্গদের হত্যা করে হলেও তাদের কাছ থেকে সব জমি ছিনিয়ে নেয়া হতে পারে এমন গুঞ্জনও উঠছে বিশ্ব গণমাধ্যমে।
১৯৯৪ সালে জাতিবৈষম্য অবসানের পর এএনসি বলেছিল, ২০১৪ সালের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গদের ৩০ শতাংশ জমি ফেরত দেয়া হবে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি। ১৯৯৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ২০ বছর পর দেশটিতে এ প্রথমবারের মতো ভূমি সংস্কার বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) ভূমি অধিগ্রহণের এ পদক্ষেপকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। সংস্থাটির দক্ষিণ আফ্রিকা প্রতিনিধি মোন্টফোর্ট ম্লাচিলা বলেন, বৈষম্য দূর করার এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছে আইএমএফ।
এদিকে সরকারের এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে বিশ্বের শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ করছে তারা। জিম্বাবুয়ে ও বতসোয়ানায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে শ্বেতাঙ্গরা। তাদের জমি ছিনিয়ে নেয়ার বিষয়ে শ্বেতাঙ্গদের উসকে দিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শুক্রবার এক টুইট বার্তায় ট্রাম্প বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওকে দক্ষিণ আফ্রিকার ভূমি ও কৃষিজমি অধিগ্রহণ এবং ব্যাপক হারে শ্বেতাঙ্গ কৃষক হত্যার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলেছি।’