এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : একাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো অবশেষে এক কাতারে আসছে। ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া’ নামে ওই নতুন প্ল্যাটফর্ম দৃশ্যমান হচ্ছে শনিবার।
ওইদিন ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া’র ঢাকায় মহানগর নাট্যমঞ্চে সমাবেশ আছে। সেখানে যোগ দেবেন নেতারা। তবে এই ঐক্যের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা সেদিন নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে চলতি মাসের শেষে এ ঘোষণা দেয়ার সম্ভাবনা আছে।
ঐক্য প্রক্রিয়ার সংশ্লিষ্ট দলগুলোর একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য। তারা আরও জানান, নতুন প্ল্যাটফর্মের গঠন প্রক্রিয় সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সংশ্লিষ্ট দলগুলোর নেতারা প্রায় প্রতিদিনই দফায় দফায় বৈঠক করছেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুক্তরাষ্ট্র ও লন্ডন থেকে ফেরার পর গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে দু’দফা বৈঠক হয়েছে। বুধবার ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের অন্যতম নেতা জোনায়েদ সাকি। বাম গণতান্ত্রিক জোটের আট দলের সঙ্গে আজ যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরাম নেতাদের আরেকটি বৈঠক আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গঠনের পর সরকারের বাইরে থাকা সব দল ও জোট অভিন্ন দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন করবে। অক্টোবরের মাঝামাঝিতে অভিন্ন ইস্যুতে একই মঞ্চ থেকে কর্মসূচি পালনের পরিকল্পনাও আছে।
জানা গেছে, বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রে সরকারের বাইরে থাকা দল ও জোটগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার পাশাপাশি কয়েকজন বুদ্ধিজীবী। তাদের মধ্যে একজন গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
তিনি বুধবার রাতে বলেন, জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে আমি আশাবাদী; কারণ এছাড়া কোনো পথ নেই। সরকারের বাইরে থাকা দলগুলোর দাবি তো একই। তাই আশা করতেই পারি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে বিএনপিসহ বিরোধী সব দল এক মঞ্চে আসবে। শিগগিরই ঐক্যের বিষয়ে ভালো কিছু জানা যাবে।
বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সংশ্লিষ্ট এক নেতা বুধবার জানান, আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক সব আলোচনায় সরকারের বাইরে থাকা দল ও জোটগুলোর মধ্যে অন্তত ৫টি সাধারণ দাবিসহ কয়েকটি লক্ষ্যে মতৈক্য হয়েছে। ওইসব দাবি ও লক্ষ্য নিয়েই এক কাতারে আসছে সবাই। ঐক্য প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে আছে। দল-জোটগুলোর মধ্যে শুধু ক্ষমতা পরিবর্তন নয়, শাসন পদ্ধতি পরিবর্তনের বিষয়টি আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে।
বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এ মাসেই হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
বিএনপিসহ সরকারের বাইরে থাকা বিভিন্ন দল ও জোটের পাঁচটি মূল দাবি হচ্ছে, তফসিল ঘোষণার আগে সরকারের পদত্যাগ, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করা ও নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন।
সূত্র জানিয়েছে, বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত সম্মত হয়েছে বিএনপি, গণফোরাম, যুক্তফ্রন্টে থাকা বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) ও নাগরিক ঐক্য এবং বাম গণতান্ত্রিক ধারার পৃথক ৪টি দল।
এছাড়া আট দলের সমন্বয়ে গঠিত বাম গণতান্ত্রিক জোট ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশকেও একই প্লাটফর্মে আনার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। বাম গণতান্ত্রিক জোটের সঙ্গে আজ সকালে বৈঠকে বসছেন যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরাম নেতারা। শিগগিরই ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গেও বৈঠকের আশা করছেন বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত নেতারা।
সূত্র আরও জানায়, এই ঐক্যে ২০ দলীয় জোটে থাকা জামায়াতে ইসলামী ছাড়া নিবন্ধিত অন্য দলগুলো থাকছে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ঐক্যে থাকছে না। যদিও কাদের সিদ্দিকীকে ঐক্যে নিয়ে আসার জন্য ড. কামালকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এরই মধ্যে ড. কামাল হোসেন বৈঠকও করেছেন কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে। সূত্র জানায়, সেই বৈঠকে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী জানিয়েছেন, বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার দাবিগুলোর সঙ্গে তিনি একমত। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে হটানো যদি এই ঐক্যের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তিনি তাতে থাকবেন না।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, তাদের এসব দাবির সঙ্গে একমত বাম গণতান্ত্রিক জোটের আট দল ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে বিএনপির পক্ষে বাম গণতান্ত্রিক জোটের সঙ্গে আলোচনা করছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, বিরোধী সব দলের দাবি একই। বাম গণতান্ত্রিক জোটেরও তাই। ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন হতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো কিছু চূড়ান্ত হয়নি।
আরও জানা গেছে, গত দুই মাসে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ, দলের ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা।
এসব বৈঠকে প্রায় সব নেতা আন্দোলনে নামার আগে বৃহত্তর ঐক্য গঠনের ওপর জোর দেন। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মতামত লন্ডনে চিকিৎসাধীন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে অবহিত করেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পরে এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কিছু নির্দেশনা দেন মহাসচিবকে।
লন্ডন থেকে ফিরে রোববার রাতেই মির্জা ফখরুল যান ড. কামাল হোসেনের বেইলী রোডের বাসায়। সেখানে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গঠন নিয়ে আলোচনা করেন দুই নেতা। এরপর দ্বিতীয় দফায় সোমবার রাতেও এ দুই নেতার বৈঠক হয়েছে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এদিকে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গঠনের ব্যাপারে যুক্তফ্রন্টে থাকা তিন দলের নেতারাও নিজেদের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক করছেন। বুধবার বিকলে যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান ও বিকল্প ধারার সভাপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে তার বারিধারার বাসায় বৈঠক করেছেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না।
সূত্র জানায়, ওই বৈঠকে ২২ সেপ্টেম্বরের সমাবেশ ও বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ২২ সেপ্টেম্বরের সমাবেশে যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ আমরা উপস্থিত থাকব। বিএনপিসহ বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের বিষয়টি নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে। চলতি মাসে ঘোষণার সম্ভাবনা আছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সম্ভাবনা আছে।
এদিকে মঙ্গলবার বিকালে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে তার বেইলী রোডের বাসভবনে বৈঠক করেছেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের থাকা গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি।
বৈঠকের ব্যাপারে জোনায়েদ সাকি বলেন, সংঘাত-বিভেদের জায়গায় বর্তমানে অবস্থান করছে রাজনীতি। সেটা থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নতুন জাতীয় সনদের ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্য দরকার। এ ব্যাপারে আমাদের কিছু প্রস্তাব আছে। সে বিষয়ে তার (ড. কামাল) সঙ্গে আলোচনা করেছি।
তিনি বলেন, বিদ্যমান সংঘাত পরিস্থিতি উত্তরণের ব্যাপারে আমাদের প্রস্তাব নিয়ে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনা করব। এ ব্যাপারে সরকারের সংলাপের উদ্যোগ নেয়া উচিত। না হলে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জায়গায় যেতে হবে।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘২২ তারিখের সমাবেশের আমন্ত্রণ আমরা পেয়েছি। আগামীকাল (আজ) সন্ধ্যায় যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরামের নেতারা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে পল্টনের সিপিবি অফিসে আসবেন। এ ব্যাপারে জোটের আমাদের দাবিগুলো ন্যায্য ও যৌক্তিক। দাবি আদায়ে আমরা ইতিমধ্যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছি।’
সমাবেশের প্রস্তুতি: বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে ৫ দফা দাবি ও ৯টি লক্ষ্য ঘোষণা করা হয় ১৫ সেপ্টেম্বর। এরপর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সমাবেশ প্রস্তুতিতে গতি এসেছে। ২২ সেপ্টেম্বরের পূর্বঘোষিত ওই সমাবেশ সফল করতে গঠিত হয়েছে ৭টি উপকমিটি। কমিটিগুলো মঙ্গলবার কাজ শুরু করেছে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠনের নেতা ও বিশিষ্টজনদের আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। তাতে আমন্ত্রণ পাচ্ছে না কেবল জামায়াতে ইসলামী। এখন পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি পাওয়া যায়নি।
তবে রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চে ওই সমাবেশ করার প্রস্তুতি চলছে। যদিও সেখানে সমাবেশের কোনো লিখিত অনুমতি পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে। শুরু থেকে এই ঐক্যপ্রক্রিয়ায় রয়েছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম। পাঁচ দফা দাবিতে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে তিন দলের সমন্বয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্ট।
জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার সদস্য সচিব আ ব ম মোস্তাফা আমিন বলেন, ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চের সমাবেশে ব্যাপক জনসমাগমের প্রস্তুতি চলছে। জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন সেখানে সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকে চিঠি দিয়ে দলীয় কর্মীসহ আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে।
এছাড়া চিঠির মাধ্যমে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবীসহ বিশিষ্ট নাগরিকদেরও আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। সমাবেশ থেকে বৃহত্তর ঐক্যপ্রক্রিয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। একই সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্যের লক্ষ্যে আরও বড় পরিসরে যাত্রা শুরু হবে। এটা রাজনৈতিক ঐক্যপ্রচেষ্টা নয়, হবে সামাজিক ঐক্যপ্রক্রিয়া।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ঐক্যপ্রক্রিয়ার সমাবেশে ব্যাপক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন নেতারা। সমাবেশ সফলের লক্ষ্যে প্রায় প্রতিদিন নিজেদের মধ্যে চলছে আলাপ-আলোচনা।
মঙ্গলবার বেলা ১১টার পর রাজধানীর মতিঝিলে প্রবীণ আইনজ্ঞ ও ঐক্যপ্রক্রিয়ার উদ্যোক্তা ড. কামাল হোসেনের চেম্বারে সংশ্লিষ্ট নেতারা আলোচনায় অংশ নেন। সেখানে ২২ সেপ্টেম্বরের সমাবেশ সফল করতে ৭ উপকমিটি গঠন করা হয়।
২২ সেপ্টেম্বরের সমাবেশে সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন। সমাবেশে ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকবেন মোস্তাফা মোহসীন মন্টু ও সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ। সভা পরিচালনা করবেন, জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার সদস্য সচিব আ ব ম মোস্তাফা আমীন।
এদিকে নাট্যমঞ্চ ঘিরে সমাবেশের প্রস্তুতি নিলেও এখন পর্যন্ত লিখিত অনুমতি পাননি তারা। এ বিষয়ে জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার নেতারা জানান, ৬ আগস্ট সমাবেশ করার জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়ার কাছে লিখিত আবেদন করা হয়। কিন্তু তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানান। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশের বাইরে ছিলেন। পরে ডিএমপির পক্ষ থেকে মৌখিক অনুমতি দেয়া হয়। সূত্র : যুগান্তর