আলমগীর স্বপন : প্রয়োজনীয় পণ্য ঘরের দুয়ারে পৌঁছে দেয়ার সেবা বা হোম ডেলিভারি সার্ভিস বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে। অনলাইনের মাধ্যমে অর্ডার করলে পিৎজা থেকে বাচ্চার ন্যাপকিন পৌঁছে যাচ্ছে ঘরের দরজায়।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ড্রাইভিং লাইসেন্স, বৈবাহিক সনদ, পাসপোর্ট ও আয়কর সনদের মতো সরকারি সেবাও কল করলে ঘরের দুয়ারে পৌঁছে যাচ্ছে- এমন চিত্রকল্প কি ভাবা যায়?
যেখানে সরকারি সেবা খাতে জুতার তলা ক্ষয় করে এবং ঘুষ দিয়ে কাজ আদায় করা কঠিন, সেখানে এমন সেবা কল্পনা করা আপাতত সত্যিই অসম্ভব? কিন্তু ভারতের দিল্লিতে নাগরিকবান্ধব এমন প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়েছে।
দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের নেতা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সরকার এর বাস্তব রূপ দিয়েছে। ১০ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন হয়েছে সরকারি সেবার হোম ডেলিভারি সার্ভিস প্রকল্প। একটি নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন করলে সহায়তার জন্য পৌঁছে যাবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
যদি কারও ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রয়োজন হয়, তাহলে নির্ধারিত কল সেন্টারে ফোন করে নিজের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় ও ঠিকানা জানাতে হবে। এরপর এজেন্সি থেকে একজন ‘মোবাইল সহায়ক’কে নিয়োগ দেয়া হবে।
সে সরাসরি আবেদনকারী ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র সংগ্রহ করবে। এজন্য আবেদনকারীকে একদিন ড্রাইভিংয়ের পরীক্ষার জন্য মোটর লাইসেন্সিং অফিসে যেতে হবে। এতে পাস করলে বাড়িতেই ৫০ রুপি ফি-এর বিনিময়ে পৌঁছে দেয়া হবে লাইসেন্স।
একইভাবে পাসপোর্ট, আয়কর সনদ, রেশনকার্ডসহ ৪০টি সরকারি সেবা ঘরের দরজায় পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে দিল্লি সরকার। আম আদমী পার্টির সরকার এজন্য সহায়তা নিচ্ছে ভিএফএস গ্লোবাল নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের।
ভারতে সরকারি সেবার ক্ষেত্রে এমন উদ্যোগ এই প্রথম। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেছেন- শুধু ভারত নয়, দুনিয়াতেও এটি প্রথম। সরকারি সেবা জনগণের দুয়ারে পৌঁছে দেয়ার প্রকল্প প্রশাসনিক কার্যক্রমে বিপ্লব আনবে। দুর্নীতিবাজদের জন্য এটি একটি বড় ধাক্কা বলে মনে করেন তিনি।
দিল্লিতে যখন সরকারি সেবা মানুষের দরজায় পৌঁছে দেয়ার নাগরিকবান্ধব প্রকল্প চালু হয়েছে, তখন বাংলাদেশের অবস্থা কী? কী অবস্থা তা আর ঘটা করে বলার প্রয়োজন নেই।
দিল্লি যখন নাগরিকবান্ধব উদ্যোগ নিচ্ছে, এর সপ্তাহ দু’য়েক আগে টিআইবি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের সরকারি সেবা খাতের করুণ চিত্র। ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম ও হয়রানির চিত্র। আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি ৩০ আগস্ট সরকারি সেবা নিয়ে জাতীয় খানা জরিপ-২০১৭ প্রকাশ করেছে।
এতে দেখা যাচ্ছে, সেবা খাতে ২০১৭ সালে ঘুষের লেনদেন হয়েছে ১০ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে খানা বা পরিবার প্রতি গড় ঘুষ দিতে হয়েছে ৫ হাজার ৯৩০ টাকা। সরকারি সেবা পেতে ঘুষের বিনিময়ে কাজ করাতে হয়েছে ৬৬.৫ ভাগ পরিবারকে। দিল্লির মতো ৫০ রুপিতে বাসায় সেবা পৌঁছে দেয়ার স্বপ্ন তো এ বাস্তবতায় শুধুই অলীক কল্পনা!
এ বাস্তবতায় ফিরে যাওয়া যাক ব্রিটিশ শাসনামলে। মাইকেল ক্যারিট ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের আসানসোল মহকুমার প্রশাসক। সরকারি চাকুরে হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দেখেছেন উপমহাদেশের দুর্নীতির স্বরূপ।
চাকরি ছাড়ার প্রায় পঞ্চাশ বছর পর স্মৃতিকথা লিখেছিলেন তিনি। দুর্নীতি কীভাবে এখানকার মানুষের মগজে ঢুকেছে- এর বয়ান আছে তার ‘স্মৃতিকথা’য়। সেখানে ক্যারিট একজন পাঞ্জাবি ঠিকাদারের সঙ্গে তার সাক্ষাৎকারের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে- ইতিমধ্যে পাঞ্জাবি লোকটি কপট বিনয়ের সঙ্গে মাফ চাইল। তারপর সে শান্ত অথচ গম্ভীর কণ্ঠে মুখস্থ বক্তৃতা ঝাড়ল : হুজুর হচ্ছেন মহানুভব ব্যক্তি।
এরপর ক্যারিটের সামনে আসল কথা উপস্থাপনা করলেন সেই পাঞ্জাবি ঠিকাদার। ঠিকাদারি কাজ পেতে এধার-ওধার ঘুষ দিতে হয় সেবা খাতের কর্তাদের। অনেক সময় ঘুষ দিয়েও কাজ হয় না।
সেই অভিজ্ঞতায় মাইকেল ক্যারিটকে ঠিকাদার বললেন- হুজুর! এই দুর্ভাগা দেশে তিন কিসিমের লোক আছে। আছে সজ্জন, যারা ঘুষ খান না; যেমন আপনি। আছে বদলোক, যারা ঘুষ খায় এবং আছে শুয়োরের বাচ্চারা, যারা ঘুষ নেয় অথচ ঘুষ প্রদানকারীকে কোনো সাহায্য করে না।
ড. আকবর আলি খানের ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইয়ের প্রবন্ধ ‘শুয়োরের বাচ্চাদের’ অর্থনীতি পড়তে গিয়ে ক্যারিটের স্মৃতিকথার এসব তথ্য জানতে পেরেছি। তবে ঘুষখোরদের নিয়ে শুধু ক্যারিটেরই যে এমন স্মৃতি আছে, তাতো নয়?
এরকম ‘শুয়োরের বাচ্চা’দের (ঘুষ নিয়েও যারা কাজ করে না) সাক্ষাৎ লাভের ক্ষতিকর অভিজ্ঞতা কমবেশি অনেক মানুষেরই আছে। বাংলাদেশে মনে হয় এ সংখ্যা আরও বেশি।
এখানে সরকারি সেবা খাতে ঘুষ দেয়া অনেকটা বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ঘুষ দিয়েও কাজ হচ্ছে না। এসব আবার সেবা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও নির্বাহীরা অকপটে স্বীকারও করেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না।
অনেক সময় নিজেও এর ভাগীদার হন। আইনের রক্ষক হয়েও ঘুষ-দুর্নীতির ক্ষেত্রে আইন ভাঙার প্রতিযোগিতায় কেন সেরা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি? কেন লাগাম টানা যাচ্ছে না বাহিনীর দুর্নীতিবাজ সদস্যদের? কতটা লাগামহীন হয়েছে বা হচ্ছে, এর বড় উদাহরণ হতে পারেন একজন পুলিশ সুপার পদধারী কর্মকর্তা- যার বিরুদ্ধে দুদক সম্প্রতি মামলা করেছে।
এখানে সেই কর্মকর্তার নাম না উল্লেখ করেই জানাতে চাই- ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে কতটা সম্পদশালী হয়েছে তার পরিবার। ওই কর্মকর্তা ও তার স্ত্রীর নামে রাজধানী ঢাকার তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়ায় ১৮শ’ বর্গফুটের তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
স্ত্রীর নামে মিরপুরের মাজার রোডে ৫ কাঠা জমির ওপর ৩ তলা ভবন, একই এলাকায় ২ কাঠা জমিতে দোকান রয়েছে। কেরানীগঞ্জে ১০ শতাংশ জমিতে ২ তলা ভবন ও ৬৬ শতাংশ জমিও আছে স্ত্রীর নামে। এত কিছুর পরও সেই পুলিশ কর্মকর্তা রাজউকের উত্তরা তৃতীয় ফেজে পেয়েছেন ৩ কাঠার প্লট।
এছাড়া নিজের এলাকার বিভিন্ন মৌজায় আছে প্রায় ছয়শ’ শতক জমি। তার সম্পদের তথ্য আর দিতে চাই না। শুধু বলতে চাই, স্ত্রী ও সন্তানসহ তার নামে-বেনামে চারটি কারখানাসহ প্রায় অন্তত ১০ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ রয়েছে।
অথচ ২০১২ সালে চার-চারজন অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করেও নাকি এ কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদের কোনো তথ্য পায়নি! ফলে সে সময় তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল। অথচ ২০১৮ সালে এসে সেই পুলিশ কর্মকর্তার এত এত সম্পদ পেয়ে গেছে দুদক।
মামলা করেছে। সে সময় যদি দুদক সঠিক অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিত, তাহলে এতদিনে সেই পুলিশ কর্মকর্তা নিশ্চয়ই বিচারের মুখোমুখি হতেন।
ওই পুলিশ কর্মকর্তার অঢেল সম্পদের তথ্য একটি উদাহরণ মাত্র। পুলিশের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ঘুষ দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। টিআইবির জরিপ বলছে- আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সেবা নিতে গিয়ে শতকরা ৭২.৫ ভাগ খানা বা পরিবার কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির শিকার হয়েছে।
ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছে শতকরা ৬০.৭ ভাগ খানা। এক্ষেত্রে গড়ে প্রতি খানাকে ঘুষ দিতে হয়েছে ৬ হাজার ৯৭২ টাকা। তবে আশার বিষয়, বিআরটিএ’র মতো দুর্নীতির বিষয়টি অস্বীকার করেননি মহাপুলিশ পরিদর্শক। এ নিয়ে তিনি তদন্ত কমিটি গঠনের তথ্য জানিয়েছেন। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তিনি পুলিশের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি রোধেও নানা ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
আইনশৃঙ্খলা খাতে এ যখন অবস্থা, তখন টিআইবির জরিপ অনুযায়ী অন্যান্য সরকারি সেবার চিত্রও দেখা যাক। দুর্নীতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা সেরা হলেও ঘুষের ক্ষেত্রে ২০১৭ সালের জরিপে শীর্ষস্থান লাভ করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ- বিআরটিএ।
সড়কে বিশৃঙ্খলা, প্রতিদিন দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা সংস্থা বিআরটিএ-তে ঘুষ ছাড়া কাজই হয় না। আগেই বলেছি, দিল্লি মাত্র ৫০ রুপির বিনিময়ে লাইসেন্স ঘরের দরজায় পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।
অথচ বাংলাদেশে বিআরটিএ’র লাইসেন্স পেতে পরিবার বা খানা প্রতি ঘুষ দিতে হয়েছে ৬ হাজার ১৩৬ টাকা। টিআইবির জরিপ বলছে, রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন পেতেও ঢালতে হয়েছে ৬ হাজার ৭৯৬ টাকা ঘুষ। সব মিলিয়ে বিআরটিএ-তে সেবা নিতে আসা খানা বা পরিবারের শতকরা ৮০.৯ ভাগই ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন।
টিআইবি যে ১৬টি সরকারি সেবা খাতে জরিপ করেছে, এর সব কটিতেই কম বেশি ঘুষ-দুর্নীতি আছে। এর মধ্যে শীর্ষ সাত সেবা খাতের বাকি ৫টি হল : পাসপোর্ট, বিচারিক সেবা, ভূমি সেবা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। জাতীয়ভাবে ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে সেবা খাতে ঘুষের পরিমাণ ১ হাজার ৮৬৭ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার ‘ঘুষ না দিলে সেবা না পাওয়া’র হারও বেড়েছে।
২০১৫ সালে যেখানে ৭০.৯ ভাগ খানা এর শিকার হয়েছে, ২০১৭ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৮৯ ভাগ। তবে দুর্নীতির শিকার খানার হার ২০১৫ সালের তুলনায় কমেছে। জরিপে বিবেচ্য ৭টি খাতের মধ্যে দুর্নীতি কমেছে শিক্ষা, পাসপোর্ট, স্থানীয় সরকার, কর ও শুল্ক ও এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায়।
অন্যদিকে যে ৯টি খাতে দুর্নীতি বেড়েছে, তার মধ্যে রয়েছে গ্যাস, কৃষি, বিচারিক সেবা, বিদ্যুৎ, বিআরটিএ, স্বাস্থ্য, বীমা, এনজিও ও অন্যান্য। তবে সেবা খাতে ঘুষ-দুর্নীতির সার্বিক চিত্র যখন এমন অবনতির পথে, তখন সত্যিই দিল্লি বহুদূর বাংলাদেশ থেকে।
সেবা খাতে যেখানে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, সেখানে কঠোর আইনের চেয়ে দিল্লির আম আদমি পার্টির কেজরিওয়াল সরকারের মতো বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারি সেবা যদি নাগরিকের দুয়ারে নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে দুর্নীতিবাজরা ধাক্কা খাবে। এ ক্ষেত্রে আপাতত দিল্লি বহুদূর হলেও সে পথের যাত্রা অসম্ভব কিছু নয়; বাংলাদেশ এর প্রমাণ অনেক ক্ষেত্রেই দিয়েছে।
আলমগীর স্বপন : সাংবাদিক